Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
India-China Clash

সাংবাদিক সেজে ঘুরছে চিনা স্পাই! কড়া নজরদারিতে রয়েছি আমরাও

সাংবাদিকের ছদ্মবেশে স্পাই ঢুকেছে এলাকায়। স্যাটফোন ব্যবহার হচ্ছে, এমন অকাট্য প্রমাণ আছে সেনার কাছে।

কারাকোরামের কোলে লেহ্ শহর। জোড়া সঙ্কটে এখন থমথমে। ছবি: এএফপি।

কারাকোরামের কোলে লেহ্ শহর। জোড়া সঙ্কটে এখন থমথমে। ছবি: এএফপি।

স্যমন্তক ঘোষ
লাদাখ শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০২০ ১৫:৩৪
Share: Save:

“১৪ দিন কোয়রান্টিন... ১৪ দিন...”

বিমান সেবিকা শীতল গলায় প্রথমে হিন্দি, তার পর ইংরেজি এবং শেষে লাদাখি গলায় বলেই চলেছেন, “লেহ্ বিমানবন্দর একটি সামরিক ঘাঁটি। এখানে ছবি তোলা নিষেধ”। এ দিকে লালচে, লাভা রঙের পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে গ্লাইড করছে বোয়িং বি ৭৩৭-৭০০। মিনিট খানেকের মধ্যেই পাহাড়ের পা বরাবর ক্রিকেট পিচের মতো দেখা যাবে কালো বিটুমিনের এয়ারস্ট্রিপ। আর তার সমান্তরালে সবুজ সর্পিল লেহ্ শহর।

দুর্গম লুকলা বিমানবন্দর দেখিনি। তবে রানওয়ের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল নেপালের পোখরায়। বিমানবন্দর না বলে এক ফালি রানওয়ে আর একটা হল ঘরের এনক্লোজার বলাই যুক্তিসঙ্গত। রানওয়ে ঘিরে চোখ ধাঁধানো অন্নপূর্ণা রেঞ্জ।

ধড়মড় করে বিশাল জাহাজের চাকা যে বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল, তা পোখরার থেকে সামান্যই বড়। দৃশ্য সমতুল্য। ইতিমধ্যেই অবাধ্য ক্যামেরায় ধরা পড়ে গিয়েছে পাহাড়ের স্ট্র্যাটেজিক ছায়ায় বায়ুসেনার হেলিপ্যাড, এমআই ১৭ হেলিকপ্টার, অ্যাপাচে, তেজস যুদ্ধবিমান আর আইএল ৭৬ ক্যারিয়ার বিমান। আকাশ থেকেই দেখা যাচ্ছে, বায়ুসেনার ব্যস্ত ঘাঁটি। একটু বেশিই যেন ব্যস্ত।

রানওয়ে ধরে তখনও ছুটে চলেছে বোয়িং। ডান দিকের জানলা বরাবর একের পর এক বাঙ্কার। পাথর, বালির ক্যামোফ্লাজ। যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এ সব দৃশ্য সাংবাদিকের অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণের জন্য যথেষ্ট।

লেহ্ বিমানবন্দর। এখন এখানে যুদ্ধ-যুদ্ধ পরিস্থিতি। ছবি: জেট ফোটোজ়।

প্লেন থামল পাহাড় ঘেরা লেহ্ বিমানবন্দরে। স্টক খাংড়ির বরফ চূড়ায় মেঘ। দিল্লিতে ৪৩ ডিগ্রিতে অভ্যস্ত শরীর বিমান থেকে নেমে বাসে ওঠার সময় মুহূর্তের জন্য শিহরিত হয়। গরম কফিতে ছ্যাঁৎ করে ঠোঁট পুড়ে যাওয়ার অনুভূতি। লাউঞ্জ পর্যন্ত বাসের পৌঁছতে সময় লাগল খুব বেশি হলে সাড়ে তিন মিনিট। সবুজ টিনের চালের বারান্দায় সার দিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসে আছেন কয়েকজন। মুখ ঢাকা। সবুজ টিনের উপর সাদা হরফে লেখা ‘কুশক বাকুলা রিনপোচে টার্মিনাল’। ক্যামেরা সে ছবিও ধরে রাখল।

বাস নামিয়েছে খোলা জমিতে। সস্তার সাইফাই ছবির পাগলা বিজ্ঞানীর মতো সাদা পিপিইধারী কয়েক জন অত্যন্ত অসম্মানসূচক ভঙ্গিতে হাতে বন্দুকের মতো থার্মাল স্ক্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে। পরে শুনেছি তাঁরা ডাক্তার। গোটা এলাকায় কেবল তাঁরাই পিপিই পরিহিত।

বিমানবন্দরের বাইরে, ২৫ জুন ২০২০। ছবি: পিটিআই।

গোল গোল লক্ষ্মণরেখায় দাড়িয়ে যাত্রীরা। থার্মাল স্ক্যানার কপালে ঠেকিয়ে পিপিই ফেসশিল্ড পরিহিত কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন— “ফরটিন ডেজ কোয়রান্টিন। ফরটিন ডেজ।” পায়ের রক্ত মাথায় উঠতে পারত। এড়ানোর একমাত্র উপায়, কিছুই শোনা যায়নি ভান। প্রতিক্রিয়াহীন সেই মুখ নিয়েই পৌঁছনো গেল টিনের চালের তলায় টেবিলের সামনে। আইডি-সহ নাম নথিভুক্তিকরণের সময় জানানো গেল, ফেরার টিকিট এক সপ্তাহ পরে।

এই করোনাকালে ফৌজি, সাংবাদিক, বিআরও, ইন্ডিয়ান অয়েলের লোক ছাড়া দিল্লি থেকে লেহ্ শহরে আর বিশেষ কেউ যাত্রা করছেন না। ফেরার টিকিট আছে শুনেই টেবিলবাবু মুখ তুললেন। “সাংবাদিক?”

অগত্যা উত্তর— হ্যাঁ।

“ডক্টর কা বাত সুন লিয়া না?”

কৌন ডক্টর? কৌনসি বাত?

লাদাখের মাথায় এখন ফাইটার জেট। এটি সুখোই-৩০ এমকেআই, ২৬ জুন ২০২০। ছবি: এএফপি।

ফের আগমন ঘটল সেই পিপিই পরিহিতের। ফেসশিল্ড খুললেন— “১৪ দিনের কম থাকলে ৭ দিন কোয়রান্টিন। বাধ্যতামূলক। আমরা খবর রাখব।” হোটেলের নাম, ঠিকানা সবই উঠে গেল খাতায়। বিপুল আওয়াজে কানের মাথা খেয়ে উড়ে গেল তেজস। এক, দুই, তিন।

টেবিলের কাজ সেরে ফের দাঁড়াতে হল সাংবাদিকদের জন্য আলাদা লাইনে। বেশির ভাগই কাশ্মীরের সহকর্মী। শ্রীনগর-লেহ্ রুট বন্ধ, তাই দিল্লি ঘুরে আসছেন। তারই মধ্যে সিআইএসএফের এক জওয়ান অধমকে লাইন থেকে বার করে নিয়ে গেলেন। স্কুলের প্রেয়ার লাইন থেকে দুষ্টু ছেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মতো। মোবাইলের গ্যালারি খুলে দিতে বললেন। সঙ্গে বিরক্ত প্রশ্ন, “ফ্লাইটে বলেনি, এখানে ছবি তোলা নিষেধ?” প্রথমে গ্যালারি, তারপর ট্র্যাশ থেকে ডিলিট হল একের পর এক ছবি। ফের লাইনে। গন্তব্য আরও এক চিকিৎসকের ঘর।

কার্গিল থেকে লেহ্-র পথে চলেছে সেনা ট্রাক, ২৯ জুন ২০২০। ছবি: এএফপি।

ব্যাঙ্কোয়েট হলের মতো বিমানবন্দরের লাউঞ্জের বাঁ দিকে লাগেজ বেল্ট। ডান হাতের ছোট্ট ঘরে পিপিই পরে বসে আছেন ডাক্তার এবং তাঁর সহকর্মী। লেহ্ বিমানবন্দরে সাংবাদিক নামলে নাকের ভিতর রড ঢুকিয়ে করোনা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। হ্যাঁ, রডই। নাকের গভীরে, প্রায় গলার কাছে তুলো দেওয়া কাঠি যখন ঘুরতে শুরু করল, মনে হচ্ছিল ব্রহ্মতালুতে ড্রিল হচ্ছে। হাত টানটান করে ধরে রেখেছেন চিকিৎসকের শাগরেদ। টনটনে নাক নিয়ে এ বার চিকিৎসককেও দিতে হল আর একপ্রস্থ ডিটেল। পরিচয় এবং হোটেলের ঠিকানা লেখা হল টেস্টটিউবের গায়ের লেবেলে।

নাহ্, তাতেও নিস্তার নেই। এ বার পুলিশের পালা। ফের সেই রুটিন প্রশ্ন। পরিচয়পত্র দেখানো এবং চেতাবনি— “এক সপ্তাহ বাধ্যতামূলক কোয়রান্টিন। মনে রাখবেন। নইলে বিপদে পড়বেন।” বিপদ শব্দটি যে যথেষ্ট আপত্তিকর, সে কথা জানিয়ে বিমানবন্দরের বাইরে হাঁটা লাগানো গেল।

কোয়রান্টিন যে ভোগাতে পারে, ড্রিল হয়ে তত ক্ষণে তা মাথায় গেঁথে গিয়েছে। ট্যাক্সিতে উঠেই চালকের কাছে অনুরোধ, বিমানবন্দরের গা ধরে যে রাস্তা গিয়েছে, সে পথে চলুন। হোটেলে গিয়ে ফেঁসে গেলেও, চারগাছি ছবি অন্তত ধরানো যাবে অফিসকে। চালক জানালেন, সে পথে বেশি দূর যাওয়া যাবে না, নাকাবন্দি আছে। তবু যত দূর যাওয়া যায়। কাঁটাতারের এ পারে সাংবাদিকের গাড়ি ছুটছে, ও পারে বায়ুসেনার সাঁজোয়া মহড়া। একের পর এক ফাইটার উড়ে পুব বরাবর গিয়ে পাহাড়ের কোলে হারিয়ে যাচ্ছে। ফের ডাঁয়ে হেলে উদয় হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে। ওই দিকেই গালওয়ান ভ্যালি। এক রাউন্ডে একটা ফাইটার সময় নিচ্ছে সব মিলিয়ে মিনিট আটেক। সিনেমার মতো কাট টু কাট দৃশ্যে যবনিকা পড়ল আধঘণ্টার মাথায়, অচেনা ফোনে— “লেহ্ ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে বলছি, আপনি এখনও হোটেলে পৌঁছননি কেন? চালককে ফোন দিন।”

করোনার মধ্যেই চিন টেনশন। গোটা লেহ্ যেন কোয়রান্টিনে, ২৮ জুন ২০২০। ছবি: এএফপি।

রানওয়ে ছেড়ে লেহ্ গেট পার করে হোটেলে পৌঁছতে চালক সময় নিয়েছিলেন বড়জোর ৪০ মিনিট। গোটা রাস্তায় স্টিয়ারিংয়ে বার দশেক মাথা ঠুকে চালক প্রতিজ্ঞা করেছিলেন— যাই ঘটে যাক, লকডাউনের বাজারে এক পয়সাও না জুটুক, কোনও সাংবাদিককে আর গাড়িতে তুলবেন না।

চালকের প্রতিজ্ঞা নেহাত অমূলক ছিল না। হোটেলের বাইরে পুলিশের গাড়ি। ফাইল হাতে আইবি এবং ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের লোক। সাংবাদিক নয়, তাঁদের টার্গেট চালক। কেন বিমানবন্দর থেকে সোজা হোটেলে আনা হল না সাংবাদিককে। কোথায় কত দূর যাওয়া হয়েছিল। ‘ছবি দেখান। ডিলিট করুন, এখনই!’

হোটেলে আরও এক দিল্লির সাংবাদিক এক দিন আগে পৌঁছেছেন। মজা নিচ্ছিলেন ঘটনার। খানিক পরে তিনিই নতুন সহকর্মীকে নিয়ে যাবেন ছাদে। আশপাশের হোটেলের ছাদে দেখিয়ে দেবেন জাতীয় গণমাধ্যমের আরও বহু সহকর্মীকে। চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে যাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইভ দিয়ে যাচ্ছেন। প্রত্যেক তিনটি বাক্যে একবার করে জানিয়ে দিচ্ছেন, গ্রাউন্ড জিরো থেকে বলছি। লেহ্ শহর থেকে গালওয়ানের দূরত্ব যদিও অন্তত আট ঘণ্টার। কিলোমিটারের হিসেব দিয়ে লজ্জা না বাড়ানোই ভাল। বস্তুত, সাংবাদিকদের এই কাণ্ড রীতিমতো গসিপের বিষয় হয়ে উঠেছে লেহ্ শহরের স্থানীয় আড্ডায়।

পর্যটক নেই। আনলক শুরু হলেও বিক্রিবাটায় ভাটা। লেহ্-র বাজারে, গত ২৭ জুন। ছবি: এএফপি।

লেহ্-তে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১২০। বুঝতে অসুবিধা হয় না, কোয়রান্টিনের তৎপরতার নেপথ্যে কেবল করোনা নয়। আরও গভীর কোনও কারণ আছে। স্থানীয় সোর্স জানালেন, লেহ্ শহরের আশপাশে আট কিলোমিটারের মধ্যে প্রতিটি রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে সেনা। বিশেষত সাংবাদিকদের জন্য। বাজারে খবর, সাংবাদিকের ছদ্মবেশে স্পাই ঢুকেছে এলাকায়। স্যাটফোন ব্যবহার হচ্ছে, এমন অকাট্য প্রমাণ আছে সেনার কাছে। রাজধানী থেকে আনা মোবাইল নেটওয়ার্কে এই প্রথম চোখ পড়ল। মোমের আগুনের মতো দবদব করছে।

ওয়েলকাম টু লাদাখ। হোটেলের কোয়ারান্টিন ঘরের রেজিস্টার এগিয়ে দিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝকঝকে পড়ুয়া, অধুনা হোটেলকর্মী।

দূরে স্টক খাংড়ির গা ঘেঁষে একে একে বাসায় ফিরছে বায়ুসেনার হেলিকপ্টার। বুডবুড বুডবুড শব্দ এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে বাউন্স করছে স্কোয়াশের বলের মতো।

অন্য বিষয়গুলি:

India China Leh Ladakh India-China Clash
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy