চিত্রপরিচালক আশীষ অভিকুন্তক। ছবি: শুভময় সিংহ রায়।
সাম্প্রতিক কালে ভারতীয় সমাজ এবং রাজনীতিতে হিন্দুত্বের প্রভাব খুব স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। ভারতীয় চেতনায় এই প্রভাব কি আকস্মিক? নাকি এর পেছনে সুপরিকল্পিত কোনও চেষ্টা লুকিয়ে আছে?
হঠাৎ করে হিন্দুধর্ম ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠল, এমনটা আমি মনে করি না। সব সময়ই তাই ছিল। ভারতীয় সভ্যতার অন্তরাত্মাই হল ধর্ম। বৈদিক সভ্যতা (১৮০০-৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ), ব্রাহ্মণ্য পর্ব (৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-৪০০ খ্রিস্টাব্দ), বৌদ্ধ পর্ব (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-২০০ খ্রিস্টাব্দ), তন্ত্র পর্ব (৪০০-১১০০ খ্রিস্টাব্দ) এবং মুসলিম শাসনকাল (১০০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দ), এই বিশাল সময়কালের কখনওই রাজনীতি, ধর্ম ও সমাজের মধ্যে স্পষ্ট কোনও বিভেদরেখা ছিল না। ধর্ম সব সময়ই ভারতীয় সভ্যতার চেতনা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। ব্রিটিশ শাসনকালে হঠাৎ করেই বদলে যায় সেই চিত্র। আধুনিকতার উত্থানে চাপা পড়ে যায় ভারতবর্ষের ধর্মীয় সত্তা। ভারতীয় চেতনায় ধর্মের প্রভাব কতটা সুদূরপ্রসারী, তা বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং মহাত্মা গাঁধী। আর সেটা কোনও একটি নির্দিষ্ট ধর্ম ছিল না। গাঁধীর প্রতিটি জনসভা শুরু হতো বিভিন্ন ধর্মের ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় সভ্যতার ভাগ্য যে ধর্মের হাতে বাঁধা, তা চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন গাঁধী। এখানে কিন্তু আমি সামগ্রিক ভারতীয় সভ্যতার কথা বলছি, সাম্প্রতিক ভারত রাষ্ট্র ভেবে নিলে খুব ভুল হয়ে যাবে। দেশভাগের পর নেহরু-র ভারতে আরও ব্রাত্য হয়ে যায় ধর্ম। তার জন্য দায়ী দেশভাগের যন্ত্রণা। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতি মিশলেই আবার দেখা দিতে পারে হিংসা, এই আতঙ্ক থেকেই আরও দূরে সরে যায় ধর্ম। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল ভাষার রাজনীতি, যার একটা পর্ব শেষ হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধর্মের রাজনীতি বেশ শক্তি নিয়েই ভারতে হাজির হয় ১৯৯২ সালে। এর আগেই জিয়াউল হকের জমানায় পাকিস্তানও একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল। ২০১৮তেও আমরা একই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে। খুব নির্দিষ্ট ভাবে বললে, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ইসলাম আর ভারতে হিন্দুত্বই আমাদের উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট করে দেবে।
আমি আপনাকে চিনি একজন ফিল্মমেকার হিসেবেই। বৃন্দাবনী বৈরাগ্য, কল্কিমন্থনকথা, আপৎকালীন ত্রিকালিকা, রতি চক্রব্যূহ। আপনার সিনেমাতে হিন্দু ধর্মের উপস্থিতি এক প্রকার অনিবার্য। কী ভাবে ধর্ম এতটা প্রভাবিত করল আপনাকে?
প্রথমত, আমাকে এ ভাবে চিহ্নিত করা যাবে না। আমি দীর্ঘ দিন নানা সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে আছি। একই সঙ্গে আমি একজন প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং নৃতত্ত্ববিদ। যদিও ফিল্মমেকার হিসেবেই আমার পরিচিতি বেশি। কিন্তু আমি যা কিছু শিখেছি, সব কিছুর প্রভাব আমার ফিল্মে পড়েছে। একই ভাবে আমি হিন্দু ধর্মের দ্বারা প্রভাবিত, এটা ঠিক কথা নয়। আমি একজন জন্মহিন্দু। এটা প্রভাব নয়, এটাই আমার পরিচিতি, আমার ব্যক্তিত্ব। কলকাতায় এক অবাঙালি হিন্দু পরিবারে আমার জন্ম। কলকাতার আরও অনেকের মতো আমার বাবা-মাও দেশভাগ পরবর্তী উদ্বাস্তু সমাজের অংশ। বাবার জন্ম আজকের পাক-আফগান সীমান্তের উপজাতি অধ্যূষিত খাইবার পাখতুন খোয়া এলাকায়, মা-র জন্ম লাহৌরে। উদ্বাস্তু হিসেবেই তাঁরা কাজের খোঁজে কলকাতায় এসেছিলেন। বাবা ছিলেন হিন্দু ধর্মের সংস্কারপন্থী আর্যসমাজ দ্বারা প্রভাবিত, আর মা ছিলেন সনাতনী হিন্দু। আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোথাও শাক্ত মতে বিশ্বাসী। তাই আমার ওপর হিন্দু ধর্মের প্রভাব আছে, কথাটা ভুল। হিন্দু ধর্মই আসলে আমার পরিচিতি।
আরও পড়ুন: মুসলিমরা রামের বংশধর, ফের বিতর্কিত মন্তব্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহের
আপনি নিজেকে গাঁধীবাদী বলে থাকেন। আজকের ভারতে মহাত্মা গাঁধীর হিন্দুত্ব কতটা প্রাসঙ্গিক?
গাঁধীবাদী বলতে যদি আপাদমস্তক গাঁধীর ভাবধারায় বিশ্বাস করা বোঝায়, তাহলে আমি গাঁধীবাদী নই। গাঁধীর কিছু চিন্তাভাবনা আজকের দিনে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং আমি সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি। তার মধ্যে অন্যতম হল— ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে ধর্মের ভূমিকা সঠিক ভাবে বুঝতে পারা। ধর্ম কখনওই আমাদের দেশে পাশ্চাত্যের মতো ব্যক্তির বিষয় নয়। হিন্দুধর্ম আর ইসলাম হল বেঁচে থাকার উপায়। যা ঠিক করে দেয় আমাদের সমাজের গতিপথ। আধুনিকতার সর্বোচ্চ পর্যায়েও, এই ডিজিটাল জমানা ও পুঁজিবাদী আবহেও ধর্ম আমাদের দেশের একজন ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। এটা বুঝতে পেরেছিলেন গাঁধী। নেহরু-র মতো সমাজজীবনে ধর্মের ভূমিকাকে অস্বীকার করেননি তিনি। সেটা আমাদের এখন স্বীকার করার সময় এসেছে। এখানেও খুব স্পষ্ট ভাবে বলে দিতে চাইছি, হিন্দু ধর্ম এবং সাম্প্রতিককালে যে হিন্দুত্বের উত্থান দেখা দিচ্ছে, এই দু’টি বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। সাম্প্রতিক কালে যে হিন্দুত্ব মাথাচাড়া দিচ্ছে তা বিকৃত, অসুস্থ এবং দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। এই হিন্দুত্বকে কেউ হিন্দু ধর্মের সঙ্গে এক করে দেখাতে চাইলে আমাদের রাজনৈতিক পদক্ষেপ করতে হবে। সেই রাস্তাই দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন গাঁধী। ফ্যাসিবাদী হিন্দুত্বের কাছে বশ্যতা স্বীকার না করেও রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক ভাবে এবং ব্যক্তিজীবনে গর্বের সঙ্গে হিন্দু হয়ে থাকা যায়। শুধু ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার হলেই এই উগ্র হিন্দুত্বকে সরানো যাবে না, হিন্দু হয়েও এই ফ্যাসিবাদীদের মোকাবিলা করার রাস্তা আছে, যা দেখিয়েছেন গাঁধী।
দাঙ্গাবিধ্বস্ত নোয়াখালিতে মহাত্মা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
আপনি খাদি আন্দোলনের একজন কর্মী। সব সময় খাদির পোশাক পরেন। ঢাকুরিয়ার বাড়িতে আপনাকে চরকা কাটতেও দেখেছি। কলকাতার একটি শপিং মলে খাদির ধুতি পরে যাওয়ার জন্য আপনাকে ঢুকতে না দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সব সময় খাদির প্রতীক সঙ্গে নিয়ে চলা কি গাঁধীভক্ত হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার একটা চেষ্টা?
প্রথমে বুঝতে হবে, চরকা কাটা শুধুমাত্র গাঁধীর প্রতিনিধিত্ব করা নয়। এটা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার রাজনীতির অংশ। গাঁধীর জন্মের বহু আগে থেকেই চরকা ও খাদি আছে। গাঁধীর কৃতিত্ব এটাই যে, উনি ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে চরকাকে প্রতীকী অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরতে সফল হয়েছিলেন। যদিও শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক শাসনকে উচ্ছেদ করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। ইংল্যান্ডের কারখানায় তৈরি জামাকাপড় প্রত্যাখ্যানের মধ্যে দিয়ে উনি যে আন্দোলনের শুরু করেছিলেন, তা ছিল পৃথিবীর প্রথম পরিবেশ আন্দোলনের সূচনা। মেশিনে তৈরি জামাকাপড়, উদাহরণ হিসেবে সিন্থেটিক জামা বা জিনস ধরলে দেখা যাচ্ছে, তা উৎপাদন করতে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। এই শক্তির ব্যবহার সর্ব অর্থে ধ্বংসাত্মক। তার জন্য বাঁধ বানাতে হচ্ছে, জঙ্গল ধ্বংস হচ্ছে, উৎখাত করা হচ্ছে মানুষকে। তাপ বিদ্যুৎ বলুন বা পরমাণু বিদ্যুৎ, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছেই। সেখানে খাদি হাতে বানানো হয়, ধ্বংসাত্মক শক্তির ব্যবহার না করেই। খাদি আমার কাছে তাই একটা রাজনৈতিক বক্তব্য। এটা শুধুমাত্র ফ্যাশন স্টেটমেন্ট নয়। এটা আমার প্রতিদিনের রাজনীতি, একদিনের শখ না। এটা আমি করে আসছি ৩০ বছর ধরে। যে দিন থেকে বুঝতে পেরেছি আমার ইচ্ছে মতো পোশাক পরা পরিবেশের কী ভীষণ ক্ষতি করতে পারে, সে দিন থেকেই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি— আমি আমেরিকায় আছি প্রায় আঠারো বছর, কিন্তু এখনও আমার গাড়ি নেই। আমি আমেরিকাতেও পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করি। আমার মনে হয়, এই ছোট ছোট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো আজকের পৃথিবীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশকে যে ভাবে আমরা ধ্বংস করেছি তার ফল ইতিমধ্যেই ভোগ করা শুরু হয়ে গিয়েছে। কলকাতার অবস্থা দেখলে তা আরও স্পষ্ট হয়। কিন্তু কলকাতার দূষণ নিয়ে চিৎকার করে কোনও লাভ নেই। কলকাতায় রাস্তা প্রতি গাড়ির সংখ্যা খুব বেশি। কলকাতার বাতাসে দূষণ কমাতে হলে প্রাইভেট গাড়ি কমিয়ে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। সেটা এক জন ব্যক্তি খুব সহজেই মেনে চলতে পারেন। গাঁধীর কাছ থেকে এটাই আমাদের শেখার। নিজেকে বদলালে তবেই সমাজ বদলানোর কথা ভাবা যেতে পারে।
আপনি প্রায় তিন বছর নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন। এই মুহূর্তে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ। রাস্তায় নামছেন কৃষকেরা, সংরক্ষণের দাবিতে সরব মারাঠা-পাতিদার সম্প্রদায়ের মানুষ। দেশের একাংশে সক্রিয় সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী মাওবাদীরাও। গাঁধীর জীবনটাই আন্দোলনের। আজকে আমাদের দেশ যে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে গাঁধী যে ধারার আন্দোলন করতেন তার কোনও প্রাসঙ্গিকতা আছে? নাকি অহিংস আন্দোলন একটা মহান ভাবনা, যার বাস্তবের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।
আপনি যে আন্দোলনগুলির কথা বললেন সেগুলোর মধ্যে অনেক ফারাক আছে। সংরক্ষণের দাবিতে জাতপাতের আন্দোলনের সঙ্গে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন এক করলে ভুল হয়ে যাবে। জাতপাতের আন্দোলন কোনও একটা সুবিধে চায়। মহারাষ্ট্রে মারাঠারা, গুজরাতে পাতিদাররা, হরিয়ানায় গুজ্জররা শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি। এই গোষ্ঠীর হাতে জমির মালিকানা আছে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা তফশিলি জাতির তালিকায় নেই, ওবিসি তালিকাতেও নেই। নিম্নবর্গের মানুষের একটু এগিয়ে আসাতেই তাঁরা আতঙ্কিত। সুবিধে ভোগ করায় অভ্যস্থ সমাজের এই অংশটি নিজেদের সুবিধের জায়গায় কোনও কাঁটা রাখতে চায় না। এটাই এই সব আন্দোলনের পটভূমি।
অন্য দিকে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন সাম্যের রাজনৈতিক পটভূমিতে তৈরি হয়েছিল। এই আন্দোলন ছিল উপজাতিদের, যাঁরা ভারতীয় সমাজের সব থেকে বঞ্চিত অংশ। ভারত রাষ্ট্র তাঁদের নিজেদের জমি থেকে জোর করে উচ্ছেদ করছিল। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন প্রশ্ন তুলেছিল, কার উন্নয়ণ? সর্দার সরোবরে বাঁধ বানানো হলে উন্নয়নের সুফল কারা পাবেন? উত্তরটা আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম। এই বাঁধের সুফল পুরোটাই পাচ্ছিলেন শিল্পপতি, কারখানা মালিক, বড় জমির অধিকারী আখচাষি এবং শহরের নাগরিকেরা। অথচ তাঁরা এমনিতেই যথেষ্ট সুবিধাভোগী এবং শক্তিশালী। আজ আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট, উন্নয়ণ আসলে ধনী ও শক্তিশালীদের জন্যই। নয়ের দশক পর্যন্ত উপজাতি ও গরিবদের ত্যাগ স্বীকার করতে হতো রাষ্ট্রের জন্য। আজকে তাঁদের উৎখাত করা হচ্ছে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার মুনাফার জন্য। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম তার বড় উদাহরণ। তামিলনাড়ুর থুথুকুডিতে নিরস্ত্র মানুষকে পুলিশের গুলি চালিয়ে মারার মতো ঘটনা এখন অত্যন্ত স্বাভাবিক। নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন প্রথম— কার উন্নয়ন— এই প্রশ্নটা তুলেছিল। এর সঙ্গে আজকের পাতিদার, মারাঠা বা গুজ্জরদের আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক নেই।
হিংসার প্রশ্নে আমি আপাদমস্তক গাঁধীর অহিংস আন্দোলনের সমর্থক। কিন্তু মানুষ আন্দোলনের কোন রাস্তা বেছে নেবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনওটাই আমার নেই। দরিদ্র, অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া, প্রান্তিক, উপজাতিরা যখন বাঁচার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেন, তখন বুঝতে হবে তাঁদের পিঠ একদম দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। তাঁদের সামনে আর কোনও বিকল্প নেই। তাঁদের পছন্দকে প্রশ্ন করার অধিকারও আমার নেই। আমি আসলে সমাজের সুবিধাভোগী অংশের মধ্যেই পড়ি। তাই দরিদ্র ও বঞ্চিত মানুষেরা কোন জায়গায় গিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছেন, সেটা বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসন পরবর্তী যে মানুষেরা বঞ্চনার প্রতিবাদে অহিংস ভাবে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন বা নিচ্ছেন, তাঁদের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা আছে। বিচারবিভাগীয় হেফাজতে মৃত্যু এবং আফস্পা বিরোধী আন্দোলনে যে অসীম সাহস ও বীরত্ব দেখিয়েছিলেন মণিপুরের মীরা পাইবি, তা আমাদের সবার কাছে একটা অসাধারণ উদাহরণ। এ রকম শক্তিই দেখিয়েছিলেন নিয়মগিরি-র উপজাতিরা, যা ভারত সরকারকে বাধ্য করেছিল বহুজাতিক খনি সংস্থা বেদান্তকে জঙ্গল বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। তাঁরাই গাঁধীর আন্দোলনের ধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন আমাদের দেশে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলনে তাঁরাই আমাদের পথ প্রদর্শক।
নোয়াখালিতে শরৎচন্দ্র বসুর সঙ্গে মহাত্মা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।
আরও পড়ুন: হিন্দুত্ববাদ সম্পর্কে গাঁধীজি বলেছিলেন...
নিম্নবর্গ এবং মহিলা। ভারতীয় সমাজের এই দু’টি অংশ ঐতিহাসিকভাবে অবহেলিত, বঞ্চিত এবং পিছিয়ে পড়া। সমাজের একদম তলানিতে তাঁদের অবস্থান। তাঁদের নিয়ে গাঁধীর ভাবনার সঙ্গে আপনি সহমত?
নিম্নবর্গ এবং মহিলাদের প্রশ্নে আমি গাঁধীকে শোচনীয় ভাবে ব্যর্থ বলে মনে করি। সারা জীবন এই দু’টি বিষয় নিয়ে অসংখ্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন গাঁধী। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই উনি ব্যর্থ হয়েছেন। এ নিয়ে গাঁধী আমাদের কোনও দিশা দেখাতে পারেননি। নিজের স্ত্রী বা মনু বেন, মহিলাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খুবই সমস্যার। আর দলিত বা নিম্নবর্গ নিয়ে গাঁধীর ভূমিকা জানতে হলে আমাদের বুঝতে হবে অম্বেডকরকে। অম্বেডকর ছাড়া গাঁধী অসম্পূর্ণ। ভারতীয় সভ্যতার রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝতে যেখানে সীমাবদ্ধ গাঁধী, সেখানেই হাজির অম্বেডকর। অম্বেডকর মানে শুধু নিম্নবর্গের বিষয় নয়। দুঃখের বিষয়, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সে ভাবে অম্বেডকরকে বোঝার চেষ্টা করা হয় না। গাঁধীর পাশাপাশি ভারতের সব থেকে শক্তিশালী রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক অম্বেডকরই।
সব শেষে বলতে চাই, একটা বা দু’টো কারণে আজও ভীষণ ভাবে গাঁধীকে দরকার ভারতবর্ষের। প্রথমত, আধুনিকতা ও যান্ত্রিক সভ্যতার জাঁতাকলে পিষ্ট মানব সভ্যতাকে পরিবেশবান্ধব ভাবে বাঁচার ভাবনা ভাবতে শিখিয়েছিলেন গাঁধী। দ্বিতীয়ত, তাঁর অহিংস সত্যাগ্রহ। আজকের পৃথিবীকে সুন্দর করতে হলে এই দু’টি পথেই হাঁটতে হবে মানুষকে, যা গাঁধী আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। গাঁধীকে প্রত্যাখ্যান করা খুব সাধারণ ঘটনা আমাদের দেশে, যে ভাবে আমরা অন্যদেরও করে থাকি। বাকি সবার মত তাঁরও কিছু ব্যর্থতা আছে। কিন্তু ভুললে চলবে না, সময়ের অনেক আগেই সভ্যতার কিছু ভুল ত্রুটি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, সাধ্যমতো তা রোখার রাস্তাও দেখিয়েছিলেন। গাঁধী আজ তাই আমাদের বাঁচার জন্য জন্য আগের থেকেও অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।
(আশীষ অভিকুন্তক স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন নৃতত্ত্ববিদ্যায়। আগে পড়াতেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই মুহূর্তে তিনি ইউনিভার্সিটি অব রোড আইল্যান্ডের হ্যারিংটন স্কুল অব কমিউনিকেশন-এ ফিল্ম ও মিডিয়া বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। পড়ানোর পাশাপাশি অন্য ধারার সিনেমা নির্মাণ করেন আশীষ। তাঁর সিনেমার মাধ্যম বাংলা। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন চলচ্চিত্র উৎসবে প্রশংসিত হয়েছে তাঁর ছবি।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy