ছবি পিটিআই।
চব্বিশ নম্বর জাতীয় সড়কের উপরে প্রকাণ্ড উড়ালপুল। দু’ধারে ডিসেম্বরের রোদে ঝলমল করছে কংক্রিটের উন্নয়ন। উপর থেকে দেখলে মালিন্যের চিহ্নও মিলবে না। কিন্তু ওই উড়ালপুলের পেটে গত ৪৮ ঘণ্টায় গড়ে উঠেছে গ্রাম থেকে আসা ট্রাক্টরের অসুখী ও অশান্ত এক সংসার। উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের গম, ধান, আখের খেত থেকে যোজন পথ পেরিয়ে আসা ট্রাক্টরগুলির ট্রেলার খড় বিছিয়ে এখন রাতের শয়নযান কৃষকদের। অনেকে চাটাই পেতে রাস্তাতেও।
এ রকমই এক জন বিজনৌর থেকে আসা ধরমবীর সিংহ। ধান চাষ করেন। যদিও তাঁর নিজের চেহারাতেই অন্নের অভাব স্পষ্ট। চোখ জ্বলছে হয়তো ক্রোধ আর ক্ষুধার মিশেলে। “আমরাই তো মোদী, অমিত শাহকে গদিতে বসিয়েছিলাম। ওরা যদি আমাদের কথা শোনে, ভাল। না-হলে এখানেই ২৬ জানুয়ারি পালন করব। আরও লোক আসছে। কালা কানুন ফিরিয়ে না-নিলে ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাব।”
ব্যারিকেডে ঘিরে দেওয়া হয়েছে সীমানা। দিল্লিতে যাতে পৌঁছতে না-পারেন বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা। ১৪৪ ধারাও জারি করা হয়েছে। কিন্তু যে পোস্টারগুলি ব্যারিকেডের উপরে ঝুলিয়ে দিয়েছেন কৃষকেরা, সেখানে দেখা যাচ্ছে, কোনও এক নিজস্ব ‘২৮৮ ধারা’র কথা লেখা। জটলার মধ্যে থেকে ত্রিলোকিনাথের চিৎকার, “এর মানে, ওরা যা বারণ করবে তা আমরা দ্বিগুণ করে করব! যখন বিহারে ভোট হয়, তখন প্রচারে ভিড় জমানোর সময়ে ওদের করোনার কথা মনে থাকে না? পেটে লাথি খেয়ে আমরা তার প্রতিবাদ করলে করোনার দোহাই দিচ্ছে। করোনায় না-মরলেও আমরা না-খেয়ে মরতে বসেছি।”
গোটা চত্বরে যে বারুদ জমে উঠেছে, তা কিন্তু নিছই তিনটি কৃষি আইনের কারণে বলে মনে হল না। এই ক্ষোভ গত কয়েক বছর ধরে পুঞ্জীভূত। যার নিশানা, মোদী ও অমিত শাহের পাশাপাশি একই ভাবে যোগী আদিত্যনাথের সরকারও। না হলে যে মহেন্দ্র সিংহ টিকায়েত মুজফ্ফরনগরে সাম্প্রদায়িক অশান্তির সময় হিন্দুত্বের ছাতার তলায় এসে পাশে থেকেছেন অমিত শাহের, আজ তাঁরই নির্দেশে গাজিপুরে হাজির ভারতীয় কিসান ইউনিয়নের অন্তত শ’দুয়েক সদস্য। তাঁদের এক জন যোগিন্দর সিংহ বলছেন, “আমরা এখানে পড়ে থাকলে অবশ্যই চাষের ক্ষতি হবে। ছেলে বৌ-রা যতটা পারছে সামলাচ্ছে। কিন্ত আসার সময়ে বলে এসেছি, একটা সুযোগ এসেছে লড়াই করার। তার জন্য কষ্ট সহ্য করতে হলে করব।”
ভিড় এবং উত্তেজনা থেকে একটু দূরে সরে এসে কথা বলা গেল মুজফ্ফরনগরের অন্তর্গত একটি ব্লক প্রেসিডেন্ট কুশলবীর সিংহের সঙ্গে। তিনি সমস্যার স্তরগুলি ব্যাখ্যা করতেই স্পষ্ট, তর্জনি অনেকটাই যোগীর ‘কুশাসন তথা দুর্নীতি’-র দিকে। তাঁদের ফলানো আখ কেনে এলাকার বড় বড় চিনি কারখানা। কুশলের ব্লক চরখাওয়ার জন্য দু’টি চিনি কল নির্ধারিত রয়েছে দেওবন্দ এবং তিতরিতে। সরাসরি এই ফসল চিনি কলে বিক্রি করতে পারেন না কৃষকেরা। সরকারের তৈরি করা সমিতির মাধ্যমে বেচতে হয়। অভিযোগ, মাসের পর মাস সেই টাকা আটকে রাখে সমিতি। কৃষকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে যে টাকা যাওয়ার কথা, প্রায়শই তা যায় না। গেলেও দেরিতে এবং প্রাপ্যর তুলনায় কম। কুশলবীরের কথায়, “আমার নিজেরই দু’লাখ টাকা বাকি রয়েছে। বোনের বিয়ে, অসুস্থ ভাইয়ের চিকিৎসা তো দূরস্থান, ফসল ফলিয়ে আজ আমাদেরই পেটে দানাপানি ফেলা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।”
করোনার ভয়ডরের লেশমাত্র নেই এই ‘জয় জওয়ান জয় কিসান’ ধ্বনিতে গমগম করা পাঁচতারা শহুরে সড়কে। কিছু ক্ষণ আগে ঘুরে গিয়েছেন ভীম আর্মির নেতা চন্দ্রশেখর আজাদ। মাটিতে মাদুর পেতে একটি হুঁকো ভাগ করে নিচ্ছেন জনা দশেক ব্যক্তি। তাঁদেরই এক জন, হাপুর জেলার বৃদ্ধ কৃষক ধনবীর শাস্ত্রী বলছেন, “ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে এমনিতেই কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি আমরা। রাখার জায়গা নেই। ফসল বড় মান্ডিতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও নেই। এ বার সরকারের আইনে তো পুঁজিপতিরাই সব তুলে নিয়ে যাবে ইচ্ছামতো দামে। চার মাস গুদামে রেখে দেওয়ার ক্ষমতা ধরে তারা। তার পর পাঁচগুণ বেশি দামে বেচবে। আমাদের অবস্থা আরও খারাপ হবে।”
উত্তরাখণ্ডের উধম সিংহ নগর থেকে আসা অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন কৃষকেরা লঙ্গর খুলেছেন রাস্তার ধারে। দীর্ঘ লড়াইয়ের প্রস্তুতি হিসেবে আরও আটা আর ডাল আসছে বলে জানালেন দলজিৎ সিংহ রনধাওয়া। “কারণ আমাদের আন্দোলন কত দিন চলবে, তার তো ঠিক নেই। মোদী বলেছিলেন কৃষকদের রোজগার দ্বিগুণ করে দেবেন। আসলে তা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। নতুন যে বিল এসেছে, তাতে আমাদের মান্ডি খতম হয়ে যাবে। বড় বেসরকারি সংস্থার পায়ের তলায় পড়ে মরব আমরা। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নিছক এক ঠাট্টা ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy