মঞ্চ প্রস্তুত ছিল। আগেই বসেছিল ‘গণ বিচারশালা’। সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যুর তদন্তে রিয়া চক্রবর্তীর গ্রেফতার এ বার খুলে দিল ঘেন্না, বিষোদ্গারের সুনামি। সবে তদন্ত শুরু হয়েছে। বিচারের বহু দেরি। তবু গণ-আদালতে এক নারীকে অবিসংবাদিত খলনায়িকা ঠাউরে চলছে পীড়নের উৎসব।
ঘটনাক্রম দেখে কার্যত এমনই অভিমত নানা জনের। যেমন, বুধবার সকালেই ছড়িয়ে পড়ে অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর টুইট। তাঁর আক্ষেপ, ‘সতীদাহ ঘিরে উল্লাসের যে বর্ণনা পড়েছি, রিয়া চক্রবর্তীর গায়ে গণ হারে অপরাধী তকমা দেগে দেওয়া দেখে তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আধুনিক ভারতে এমনটা ঘটতে দেখা মর্মান্তিক। এটা আইনি ভিত্তির প্রশ্ন নয়, সামাজিক আচরণের প্রশ্ন। নৈতিক আদর্শের উচ্চ মানের মাপকাঠি তৈরি করবেন, এমন নেতাদের এখন দরকার।’
কিন্তু সমাজের মন বদল তো দূর অস্ত্! এর পিছনে সমাজের গভীরে প্রোথিত নারী-বিদ্বেষের শিকড় দেখছেন সমাজতত্ত্ববিদ অভিজিৎ মিত্র। তিনিও বলছেন, ‘‘আপাত ভাবে সতীদাহের উদ্দেশ্য আলাদা। কিন্তু এক জন মেয়েকে পীড়ন করার দৃশ্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগের মনটা আলাদা নয়।’’ তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘নারী নরকের দ্বার-মার্কা মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা এখনও রয়েছে। আজকের মেয়েরা নানা দিকে এগিয়ে গেলেও সুযোগ পেয়ে তাঁদের ধস্ত করার মনটা বিলক্ষণ রয়েছে।’’
মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘সুশান্ত সিংহ রাজপুতের মৃত্যু একটি অমীমাংসিত ঘটনা। এর নিষ্পত্তির খোঁজেই একটি খলনায়িকা চরিত্রও দরকার। কে কী দোষ করেছে, সত্যি-মিথ্যে কোনটা, তা তদন্তসাপেক্ষ। কিন্তু আমাদের তর সইছে কই! রিয়া আপাতত সার্বিক ভাবে সমাজের ঘেন্না, রাগ উগরে দেওয়ার আধার। সব খারাপ প্রেমিকার প্রতিনিধি।’’ রাজনীতির ইন্ধনও রিয়ার দিকে আঙুল তোলার একটা কারণ হতে পারে বলে তিনি মনে করছেন।
সতীদাহ ঘিরে উল্লাসের যে বর্ণনা পড়েছি, রিয়া চক্রবর্তীর গায়ে গণ হারে অপরাধী তকমা দেগে দেওয়া দেখে তার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আধুনিক ভারতে এমনটা ঘটতে দেখা মর্মান্তিক। এটা আইনি ভিত্তির প্রশ্ন নয়, সামাজিক আচরণের প্রশ্ন। নৈতিক আদর্শের উচ্চ মানের মাপকাঠি তৈরি করবেন, এমন নেতাদের এখন দরকার।
কৌশিক বসু
সতীদাহের উপমাটি সার্থক বলে মনে হচ্ছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক শমিতা সেনেরও। ‘‘মৃত প্রেমিকের বেদীতে প্রেমিকাকে বলি দিয়ে সমাজের একাংশ যেন শান্তি পাচ্ছেন’’— বলছেন তিনি। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মৈত্রেয়ী চৌধুরী এই ঘটনাক্রমে অনেকগুলি পরত দেখছেন। তাঁর কথায়, ‘‘রিয়া ‘অবলা নারী’ নন, অতএব খারাপ মেয়ে, এমন ধারণা চাউর করে ‘ভাল ছেলে’ সুশান্তের বিপ্রতীপে তাঁকে দাঁড় করানো হচ্ছে। আবার তথাকথিত প্রতিবাদী কঙ্গনা রানাউতকে রিয়ার বিরুদ্ধে লড়িয়ে ছদ্ম নারীবাদের ভান করা হচ্ছে।’’
সংবাদমাধ্যমের একাংশ ও তদন্তকারী সংস্থাগুলির দৈন্যও প্রকট বলে মনে করছেন শিক্ষক থেকে সমাজকর্মীরা। নারী অধিকার রক্ষা কর্মী তথা লেখক ফারহা নকভির ব্যাখ্যা, ‘‘ডাইনি-শিকার এবং নারী-বিদ্বেষের মন মিলেজুলে একাকার। সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাও জঘন্য। রিয়াকে অপবাদে ছিন্নভিন্ন করে সুশান্তের জন্য সুবিচার মিলবে না!’’ শমিতাও বলছেন, ‘‘মেয়েরা হয় অপাপবিদ্ধা, নইলে চরম পাপিষ্ঠা। এর বাইরে মিডিয়াও সচরাচর ভাবতে পারে না।’’
অবশ্য এই পটভূমিতেও রিয়াকে কার্যত খুনি সাব্যস্ত করে চিৎকৃত প্রচারে সরব একটি সংবাদ চ্যানেলের কর্মী শান্তশ্রী সরকার এ দিনই টুইট করে নৈতিক কারণে ইস্তফার কথা লিখেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘ওই চ্যানেলে সাংবাদিকতা মৃত। জনৈক মহিলাকে প্রকাশ্যে অপমান এবং মিথ্যে খবর তৈরির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি।’’
রিয়ার পাশে দাঁড়ানো বলিউডি তারকাদেরও নিশানা করেছে নেট-নিগ্রহ বাহিনী। মাদক নিয়ন্ত্রণ দফতরে যাওয়ার সময়ে রিয়ার টি-শার্টের লেখায় পিতৃতন্ত্র বিরোধী স্বরের উদ্ধৃতি দেন, শাবানা আজ়মি, বিদ্যা বালন, করিনা কপূর, অনুরাগ কাশ্যপ, ফারহান আখতার, জ়োয়া আখতার, সোনম কপূর প্রমুখ।
তবে এই সূত্রে ‘পেট্রিয়ার্কি’ (পিতৃতন্ত্র) শব্দটির মানে জানতেও নেট-তল্লাশির হিড়িক। তাতে হয়তো কারও চৈতন্য হবে, ম্লান হাসছেন সমাজকর্মীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy