দেশের নানা প্রান্তে ডিটেনশান ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে এনআরসি-র আগাম প্রস্তুতি নিতে, জানিয়েছেন অমিত শাহ। ফাইল চিত্র
বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জী) সঙ্ঘাত আরও বাড়ার পথে। এক জন অনুপ্রবেশকারীকেও থাকতে দেব না— চলতি মাসের প্রথম দিনেই কলকাতায় সভা করে হুঁশিয়ারি দিয়ে গিয়েছিলেন অমিত শাহ। এ বার এক সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা বিজেপি সভাপতি জানালেন, শুধু বাংলায় নয়, গোটা দেশেই এনআরসি হবে। এনআরসি প্রক্রিয়ার গতিও যে বাড়ানো হচ্ছে, সে ইঙ্গিতও স্পষ্ট ভাবেই দিলেন তিনি। আর বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে শাহের মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দিল তৃণমূল। বাংলায় কিছুতেই এনআরসি হতে দেওয়া হবে না, জানাল রাজ্যের শাসক দল।
অসমে এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হওয়ার আগেই অনেকের নাগরিকত্বকে ‘সন্দেহজনক’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের ‘ডি-ভোটার’ করে দেওয়া হয়েছিল। অনেককেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল ডিটেনশন ক্যাম্পে। কোকরাঝাড় এবং গোয়ালপাড়া জেলায় কয়েকটি সংশোধনাগারের মধ্যেই সেই ডিটেনশন ক্যাম্পগুলি তৈরি করা হয়েছিল। তবে এ বার গোয়ালপাড়ায় আলাদা জমি চিহ্নিত করে সেখানে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি শুরু হয়েছে।
শুধু অসমে নয়, কর্নাটক এবং মহারাষ্ট্রেও তৈরি হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্প। দুটোই বিজেপি শাসিত রাজ্য। কর্নাটকে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি হচ্ছে বেঙ্গালুরু থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে সোন্ডেকোপ্পায়। সে রাজ্যের প্রশাসন যদিও ওই পরিকাঠামোর বিষয়ে বলার সময়ে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ শব্দটি ব্যবহার করছে না। বলা হচ্ছে ‘গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র’ (মুভমেন্ট রেস্ট্রিকশন সেন্টার)। আর মহারাষ্ট্রের নভি মুম্বইতে যে ডিটেনশন সেন্টার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, সে বিষয়ে মন্তব্য করার বিষয়ে রাজ্য প্রশাসন আরও সতর্ক। বলা হচ্ছে, বেআইনি পাসপোর্ট মামলায় অভিযুক্তদের ওখানে রাখা হবে।
আরও পড়ুন: ‘‘শুধু সাভারকার নয়, ভারতরত্ন দিন নাথুরাম গডসেকেও’’, বিজেপিকে তোপ ওয়েইসির
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিন্তু রাখঢাক করেননি। নিউজ ১৮-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, দেশের নানা প্রান্তে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরি করা হচ্ছে কারণ, সরকার গোটা দেশে এনআরসি চালু করার জন্য ‘আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে’।
অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে নাগরিকত্ব খারিজ করার প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন করার দায়িত্ব ফরেনার’স ট্রাইবুনালের— সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন অমিত শাহ। কিন্তু তার পরের পর্বটার জন্য সরকারকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন। অমিত শাহ বলেছেন, ‘‘প্রক্রিয়াটা সবে শুরু হয়েছে।’’
অমিত শাহের সাক্ষাৎকারটিতে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, সারা দেশের জন্যই এনআরসি চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। সরকার সেই পথেই এগোবে। সেই প্রক্রিয়ার গতি যে এ বার বাড়ানো হচ্ছে, তা-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
প্রত্যাশিত ভাবেই তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শাসক শিবিরে। এ রাজ্যে কিছুতেই এনআরসি করতে দেওয়া হবে না বলে বার বার মন্তব্য করছেন তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিক সভা-সমাবেশে বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন। বলেছেন— বাংলায় তিনি এনআরসি করতে দেবেন না। টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনও দেওয়া শুরু হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। কারও ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, রাজ্য সরকার যতক্ষণ না চাইছে, ততক্ষণ রাজ্যে এনআরসি করার ক্ষমতা কারও নেই— বিজ্ঞাপনে এই বার্তাই দেওয়ার চেষ্টা করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু অমিত শাহের সাক্ষাৎকার আবার বুঝিয়ে দিয়েছে, এনআরসি নিয়ে পিছু হঠার কথা একেবারেই ভাবছে না কেন্দ্রীয় সরকার।
আরও পড়ুন:মোদী জমানায় গণপিটুনি বাড়েনি, প্রয়োজন নেই নতুন আইন, দাবি অমিত শাহর
১ অক্টোবর কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সভা করেন বিজেপি সভাপতি। সে সভায় অমিত শাহ বলেন, ‘‘পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, খ্রিস্টানরা ভারতে চলে এসেছেন, তাঁদের সকলকেই শরণার্থী হিসেবে ধরা হবে এবং নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। তার জন্য নগরিকত্ব সংশোধন বিল সংসদে পাশ করানো হবে।’’ সুতরাং এনআরসি নিয়ে অ-মুসলিমদের ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই— বার্তা ছিল শাহের। সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারটিতে তিনি আরও স্পষ্ট ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এনআরসি নিয়ে বিজেপি এগোবেই।
অমিত শাহের মন্তব্যে বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। সে আতঙ্ক ক্রমশ আরও বেড়েছে। অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের নাগরিকত্ব না হয় কেড়ে নেওয়া হবে, যে মুসলিমরা অনুপ্রবেশকারী নন, তাঁদের কী হবে? দেশভাগের আগে থেকেই বংশপরম্পরায় এ দেশে রয়েছেন, সেই মুসলিমদের নাগরিকত্ব সরকার সুনিশ্চিত করবে তো? নাকি নথিপত্র দেখাতে না পারলে তাঁদেরও ‘অনুপ্রবেশকারী’ তকমা দেওয়া হবে? প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন অনেকেই।
স্বাভাবিক কারণেই তীব্র প্রতিক্রিয়া দিতে শুরু করেছে তৃণমূল। অমিত শাহের সাক্ষাৎকারের প্রেক্ষিতে তৃণমূলের তরফে বলা হয়েছে, ‘‘বাংলায় এনআরসি হবে না। প্রবল প্রতিরোধ হবে।’’ কিন্তু ‘প্রতিরোধ’ করে কী কেন্দ্রকে রুখতে পারবে তৃণমূল? অসমের ক্ষেত্রেও তো প্রতিরোধের কথা বলা হয়েছিল। এনআরসি শেষ পর্যন্ত রোখা তো যায়নি। এ প্রশ্নের উত্তরে তৃণমূল বলছে— অসমের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল, তাই এনআরসি হয়েছে। বাংলায় এনআরসি করার কোনও নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট দেয়নি। অমিত শাহ কী ভাবে বাংলায় এনআরসি চালু করার কথা বলছেন, তা আমাদের জানা নেই— বলছেন তৃণমূল নেতারা। এনআরসি নিয়ে সংসদে কোনও আইন পাশ করানোর চেষ্টা বা সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা হলে তৃণমূল সর্বশক্তি দিয়ে তার বিরোধিতা করবে— এমনও জানানো হয়েছে।
সংসদে ঠিক কী পরিস্থিতি তৈরি হবে, তার আঁচ আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনেই হয়তো মিলবে। কিন্তু এনআরসি নিয়ে অমিত শাহের সাম্প্রতিকতম মন্তব্য এবং দেশের নানা প্রান্তে ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির কাজ শুরু করার কথা স্বীকার করে নেওয়ায় বাংলার রাজনীতিতে আরও বাড়তে চলেছে উত্তাপ। এনআরসি ইস্যুতে বাংলায় তৃণমূল এবং বিজেপির সঙ্ঘাত লাফিয়ে বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy