Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
Babri Masjid Demolition Case

এত দিনে বাবরি ধ্বংসের রায়! অক্ষমের উল্লাস ছাড়া আর কী?

একটা মামলার রায় বেরোচ্ছে ২৮ বছর পরে। বিচার করতে ২৮ বছর সময় লেগে গেল! এত জটিল মামলা ছিল নাকি?

বিচার করতে ২৮ বছর সময় লেগে গেল, তাও নিম্ন আদালতের চৌকাঠেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

বিচার করতে ২৮ বছর সময় লেগে গেল, তাও নিম্ন আদালতের চৌকাঠেই। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অরুণাভ ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২৩:০০
Share: Save:

ঘটনা ঘটেছিল প্রায় তিন দশক আগে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মসজিদ ধ্বংসের চক্রান্তকারী বা প্রত্যক্ষ মদতদাতা হিসেবে নাম জড়িয়েছিল বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবারের তৎকালীন সামনের সারির নেতাদের— লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশী, গোবিন্দাচার্য, উমা ভারতী, অশোক সিঙ্ঘল, কল্যাণ সিংহ, সাধ্বী ঋতম্ভরা, বিনয় কাটিয়ার প্রমুখ। তাঁরা দোষী কি না, সে বিষয়ে লখনউ-এর বিশেষ সিবিআই আদালত রায় দিতে চলেছে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে পৌঁছে!

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচার করে দেখা যাক। এটা আদৌ বিচার? নাকি বিচারের নামে প্রহসন?

প্রথমত, একটা মামলার রায় বেরোচ্ছে ২৮ বছর পরে। বিচার করতে ২৮ বছর সময় লেগে গেল! এত জটিল মামলা ছিল নাকি? অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির গড়ার দাবিতে আন্দোলনটা তো আডবাণীরা লুকিয়ে-চুরিয়ে শুরু করেননি। ঢাকঢোল পিটিয়ে রামরথ যাত্রা হল। পরে সর্বসমক্ষেই অযোধ্যায় করসেবার ডাক দেওয়া হল। প্রকাশ্য দিবালোকে লাখ লাখ করসেবক অযোধ্যায় ভিড় জমালেন। সঙ্ঘ এবং বিজেপি-র সামনের সারির প্রায় সব নেতা সে জমায়েতকে উদ্বুদ্ধ করতে অযোধ্যায় হাজির হয়ে গেলেন। উত্তরপ্রদেশের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহের পুলিশ-প্রশাসন কতটা ‘সক্রিয়’ থাকল, তা-ও সকলে দেখলেন। অবশেষে উন্মত্ত করসেবকদের প্রচণ্ড তাণ্ডবে বাবরি মসজিদের একটার পর একটা গম্বুজ ধসে পড়তে লাগল। চোখের সামনে এত কিছু ঘটতে দেখল গোটা দেশ। তার পরেও এই মামলাটার বিচার করতে এত দিন লাগতে পারে!

দ্বিতীয়ত, রায় কী হবে, এখনও জানি না। ধরে নিলাম আডবাণী-জোশীদের আদালত দোষী সাব্যস্ত করবে। শাস্তিও ঘোষণা করবে। কিন্তু সে শাস্তি আদৌ কার্যকরী হবে? সবে তো নিম্ন আদালতে বিচার হল। এই আদালত আডবাণীদের শাস্তি ঘোষণা করলে সঙ্গে সঙ্গে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর আদালতে আবেদন জমা পড়বে। সেখান থেকে আরও উচ্চতর আদালত। শেষে সুপ্রিম কোর্ট। এখনও অনেক দরজা খোলা। অতএব এখনও অন্তত ২০ বছর অনায়াসে এই আইনি টানাপড়েন চালিয়ে যাওয়া যাবে। তত দিনে অভিযুক্তরা শাস্তি ভোগ করার মতো অবস্থায় থাকবেন তো?

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আডবাণী এখন প্রধানমন্ত্রী পদে থাকলে এখনও এই মামলার রায় ঘোষিত হত না। ছবি: শাটারস্টক।

তৃতীয়ত, বাবরি ধ্বংস মামলার রায় দেওয়ার আগেই রামমন্দির মামলা মিটিয়ে ফেলা হয়েছে। বাবরি ধ্বংস মামলা নিম্ন আদালতের চৌকাঠও পেরোতে পারেনি। কিন্তু রামমন্দির মামলা বিচার ব্যবস্থার নানা স্তর অতিক্রম করে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত নির্দেশ আদায় করে নিয়েছে। অযোধ্যায় যে ভূখণ্ড নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়ে ভূমিপূজা করে রামমন্দির নির্মাণের শিলান্যাস করেছেন। মন্দির তৈরির কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। এখন বাবরি ধ্বংস মামলার রায় দিয়ে কী লাভ? সে রায়ের প্রাসঙ্গিকতাই বা কোথায়? একটা জমিতে একটা মসজিদ ছিল। সেটা মন্দিরের জমি বলে দাবি করে একদল লোক মসজিদটা ভেঙে দিল। তার পর দেশের সুপ্রিম কোর্ট বলে দিল, ওই জমিতে মন্দির হবে। বিতর্কিত জমিতে মন্দির হওয়ার রায় দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট তো বলেই দিয়েছে যে, ওই জমি মন্দিরের। তা হলে আর মসজিদ ভাঙায় অপরাধ কীসের?

আরও পড়ুন: অবশেষে কাল বাবরি মসজিদ মামলার রায়, চার নজরে ২৮ বছর

আরও পড়ুন: বাঙালি হিন্দুর সঙ্গে বৈষম্য নয়, টুইটে যোগীকে বার্তা স্বপন দাশগুপ্তর​

চতুর্থত, বাবরি ধ্বংস মামলার এই অভিযুক্তরা এক সময় বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের প্রথমসারির নেতা-নেত্রী ছিলেন। কিন্তু এখন আর তাঁরা তা নন। এখন তাঁদের দল বা সংগঠন ক্ষমতায় থাকলেও তাঁরা ব্যক্তিগত ভাবে ক্ষমতার ভরকেন্দ্র থেকে অনেক দূরে। গোবিন্দাচার্য বা অশোক সিঙ্ঘল ইতিমধ্যেই প্রয়াত। আডবাণী, জোশী অতিপ্রবীণ। উমা ভারতী রাজনীতিতে রয়েছেন নামমাত্র, প্রায় অবসৃতই বলা চলে। কল্যাণ সিংহ বয়সের ভারে ন্যূব্জ, মূলধারার রাজনীতিতে প্রায় বিস্মৃত। সাধ্বী ঋতম্ভরা কোথায় থাকেন, কী করেন, কেউ আর সে ভাবে খোঁজ রাখেন না। বিনয় কাটিয়ারের বয়স অপেক্ষাকৃত কম। কিন্তু তাঁকেও আর রাজনীতির ময়দানে সামনের সারিতে দেখা যায় না। তাই কি এত দিনে আদালত তাঁদের ব্যাপারে রায় দিতে পারছে? আদালত আডবাণীদের দোষী সাব্যস্ত করলেও কি ন্যায় মিলল বলে ধরে নেওয়া যাবে? মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা পড়লে সেটা তো আসলে হবে অক্ষমের উল্লাস। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আডবাণী এখন প্রধানমন্ত্রী পদে থাকলে এখনও এই মামলার রায় ঘোষিত হত না। সবে তো ২৮ বছর। সে ক্ষেত্রে আরও ৫৬ বছর লেগে যেত।

(লেখক কলকাতা হাইকোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ও কংগ্রেস নেতা। মতামতের জন্য আনন্দবাজার ডিজিটাল দায়ী নয়)

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE