কে বানালেন স্মোকড ইলিশ?
খানিকক্ষণ আগে ওই যেটা বলছিলাম, এপার বাংলার বেঙ্গল ক্লাব আর ওপার বাংলায় ঢাকা ক্লাব এই দু’টি জায়গার মধ্যে এক বিরাট ঝগড়া লেগে আছে যে স্মোকড হিলশাটা কে বানিয়ে ফেলেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে অনেকে বলে থাকেন যে, কলকাতার বহু প্রাচীন ‘দ্য ওবেরয় গ্র্যান্ড হোটেলের’ রান্নাঘরেই এই পদটির উদ্ভাবনা হয়।
গোয়ালন্দ স্টিমারও এই ব্যাপারে পিছিয়ে নেই। অনেক রহস্যময় জিনিসের মতো গোয়ালন্দ স্টিমারে মগ কুকরা এই স্মোকড হিলসা আবিষ্কার করেন, এমন একটা তথ্যও বিভিন্ন জায়গায় চলে থাকে। কে করেছেন, সেই আলোচনায় বা সেই যুদ্ধে আমরা যাব না। তবে এটুকু আমরা বলতেই পারি যে চাটগাঁর বড়ুয়া মগ কুক এবং ঢাকার ক্রিশ্চান ডমিঙ্গো কুক এদের হাতেই এই স্মোকড হিলসার সূত্রপাত। সে যাকগে... ইলিশ নিয়ে এত জ্ঞানের পরে বলতেই হবে যে গত বছর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের ওপর ইলিশ নিয়ে একটু পড়াশোনা করতে।
তা দুর্জনের মুখে ছাই দিয়ে বা সুজনের মুখে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে, আমি গিয়েছিলাম। আমরা সবাই জানি যে বাংলাদেশে ইলিশ মাছ খাওয়ার প্রচলন এদেশের থেকে অনেক বেশি। ইলিশ মাছ নিয়ে পাগলামো এদেশের থেকে বেশি বৈ কম নয়। কিন্তু আমার যেটা নিজস্ব ভাবে জানা ছিল না, সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে ইলিশ মাছ কী ভাবে খায়। ভেজে... সাঁতলে... পুড়িয়ে... তার জন্যই ঢাকা শহর থেকে আমাকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় ঘণ্টা দু’য়েকের দূরত্বে একটি জায়গায়, যার নাম হচ্ছে মাওয়া ঘাট।
এই মাওয়া ঘাট জায়গাটি আবার ভারি মজা। সেখানে পদ্মা নদীর পাড়ে সারি সারি হোটেল। বড় বড় জাহাজ বা স্টিমার নামছে সেই স্টিমার ঘাটে। পদ্মা নদী থেকে যে ইলিশ মাছ ধরা হচ্ছে, সেই ইলিশকে সেই সারি সারি পাইস হোটেলের মধ্যে রেঁধে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। গোটা ইলিশ আপনার সামনে দেখানো হবে। সেই ইলিশগুলির মধ্যে কোনটিকে আপনি ভক্ষণ করবেন খানিকক্ষণ ধরে সেটি ভাবতে পারেন। তার মধ্যে মাওয়া ঘাটের ইলিশ আছে, একটু পেট মোটা চাঁদপুরের ইলিশ আছে। যে কোনও একটি আপনি খেয়ে নিতে পারেন। মাওয়া ঘাটে আপনি যেই ঢুকবেন, গাড়ি রাখার পরেই দেখবেন চতুর্দিক থেকে আপনার দিকে ডাক আসছে যে “মামা আসেন”।
বাংলাদেশিরা আতিথেয়তার জন্য বিখ্যাত। তাদের রান্নার স্টাইল আপনার পছন্দও হতে পারে, অপছন্দও হতে পারে। কিন্তু তাঁদের আতিথেয়তা নিয়ে দ্বিমত হবে - এ সম্ভাবনা খুবই কম। তো ‘মামা আসেন’-এর ডাক শুনে বা হোটেলের চেহারা দেখে আপনি যে কোনও একটা হোটেলে ঢুকে পড়তেই পারেন। ঢুকে প্রথম যেটা বুঝতে হবে যে আপনি কোথাকার ইলিশ খাবেন - চাঁদপুর নাকি মাওয়া ঘাট? এখন আমাদের তালকানা চোখে দু’টোর মধ্যে যে খুব একটা কিছু তফাৎ ধরা পড়ে, তা নয়। আর আমরা তো আর সেই বাবু কালচারে অভ্যস্ত নই, যেখানে বাবুরা বলতেন যে, বাগবাজারের ইলিশ নাকি এমন শক্ত হয় চোয়াল ব্যথা করে। তাঁদের অন্যান্য ঘাটের ইলিশ খেয়ে খেয়ে সোনার বদন রাখতে হতো। মাওয়া ঘাটে গিয়ে যেটা জানতে পারি যে, ইলিশ মাছের পেটের রঙের ওপর নির্ভর করে সেটি কোন জায়গার ইলিশ। পদ্মার ইলিশে যেমন একটু হলদেটে ভাব থাকে, তেমনি চাঁদপুরের ইলিশে একটা রুপালি আভা থাকে। তাছাড়া পদ্মার ইলিশের অনেক চওড়া পেটি হয়, তেল বেশি। কিন্তু আবার বলা হয়, চাঁদপুরের ইলিশের নাকি স্বাদ বেশি।
তা সে যাকগে, আপাতত যেটা দেখে বুঝতে পারলাম, আমরা যেমন ইলিশ মাছকে বেশি ভাজাটা মোটেই খুব একটা পছন্দ করি না... অল্প সাঁতলেই আমাদের এখানে ঝোল হয় বা সর্ষে বাটা হয়; এমনকি ইলিশ পোলাওতেও আমরা এখানে অল্প ভেজেই রান্না করি, বাংলাদেশিরা কিন্তু দু’টি ভাবধারায় বিশ্বাসী, হয় তারা ইলিশ ভাপে রান্না করেন বা স্টিম করেন অথবা তারা ইলিশটিকে বেশ বেশি করে ভেজে ফেলেন। এখানে কিন্তু বলে রাখা ভাল, আমি বাংলাদেশে সারা জীবনে একবার বা দু'বারই গেছি এবং খুব বেশি জায়গায় খেয়েছি, এমন সাহস করে বলার ক্ষমতা আমার নেই। ফলে আমার অভিজ্ঞতা কিন্তু খুবই সামান্য। যদি কেউ তার অন্য কোন দিকে আলোকপাত করতে চান, খুব খুশি হব।
ইলিশ দিয়ে এবং ইলিশের ব্যাপারে এপার বাংলায় যেটা আমরা দেখতে পাই না, সেটি হল, ওপার বাংলায় ইলিশে প্রচুর পেঁয়াজ এবং রসুন ব্যবহার করা হয়। ফলে মাওয়া ঘাটে আপনি যদি ইলিশের ভর্তা দেখেন, সেখানে ইলিশ মাছকে বেছে, কাঁটা ছাড়িয়ে, পেঁয়াজ, রসুন ভাজা, কাঁচা লঙ্কা কুচি এবং তারা যেটাকে বলে মরিচ আমাদের ভাষায় শুকনো লঙ্কা, সেটিকে থেঁতো করে গুঁড়িয়ে যে ইলিশের বলটি বানানো হয়, গরম ভাতে হালকা করে মেখে খেলে আপনার একদম তুরীয় আনন্দ হবে এবং সেই আনন্দের স্বাদ জীবনে খুব একটা বেশি আপনি পাবেন না।
দেখেছেন, শুরু করেছিলাম বৃষ্টি দিয়ে - হিল্লিদিল্লি থুড়ি এপার বাংলা ওপর বাংলা ঘুরে চলে এলাম পেটুক মানুষের আবেগ ইলিশে। তা রোজ খাওয়া তো আর এই গরিবের হয় না -দু’ছত্র পরেই আনন্দ। ভাল থাকবেন - অলমিতি
এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং আষাঢ়ের গল্প’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy