বহুদিক থেকে বাঙালিদের মতো মালয়ালীরাও বৃষ্টিকে বিভিন্ন রূপে খুঁজে পেয়েছে। কখনও আপন করে নিয়েছে। কখনও বৃষ্টির প্রতি রাগ উগড়ে দিয়েছে। কখনও বা সাহিত্যের সঙ্গী থেকেছে বৃষ্টি।
মালায়ালাম সাহিত্যে বৃষ্টির ছোঁয়া
আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি দিল্লিতে একটি মালয়ালাম পরিবারে জন্মগ্রহণ করা গায়ক কৃষ্ণকুমার কুন্নাথকে। আচ্ছা, একটু ভেবে দেখুন না, বিখ্যাত হিন্দি ছবি ‘লাইফ ইন আ মেট্রো’তে তাঁর গাওয়া বিখ্যাত হিন্দি গান ‘আলবিদা’র দৃশ্যগুলি? গানের সে দৃশ্যগুলিতে শরমন যোশি ওরফে রাহুলকে যতবারই দেখা গিয়েছে, প্রায় প্রত্যেকবারই ছবির সঙ্গত দিয়েছে বৃষ্টি। ছাতা ধরা রাহুল হাঁটছে বা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে, এই দৃশ্য আমাদের মাথায় এমনভাবেই গেঁথে রয়েছে যে এখনও আমরা কোনও এক বৃষ্টির মুহূর্তকে একান্তে অথবা প্রিয়জনের সঙ্গে উপভোগ করতে মোবাইলে চালিয়ে দি ‘আলবিদা আলবিদা, মেরি রাহেঁ আলবিদা...’।
বাঙালির বৃষ্টি উপভোগের অনুভূতি আর মালয়ালাম গায়কের গলা এইভাবে একাত্ম হয়ে যাওয়ার নেপথ্যে সব থেকে বড় কারণ হল এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের নির্বিশেষে বর্ষা ঋতুকে উদযাপন। বর্ষাকাল পশ্চিমবঙ্গের মতো কেরলবাসীদেরও মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। আবার কখনও ভরিয়ে দেয় আনন্দে। এর কিছু অন্যতম উদাহরণ আছে মালয়ালাম গ-সাহিত্যে। বিশেষ করে মালয়ালাম ছোটগল্প, উপন্যাসে।
ভাষা প্রসঙ্গে কথা বললে, একটু ইতিহাস বা ভূগোলের দিকে তাকাতেই হয়। খ্রিষ্টীয় নবম শতকের একটি তামপট্টলেখ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সম্ভবত ওই সময়েই প্রাচীন তামিল ভাষার থেকে মালয়ালাম ভাষা পৃথক হয়েছে। প্রাচীনকালে তামিল ভাষা-অঞ্চল মূলত তিনভাগে বিভক্ত ছিল, যার মধ্যের একটি অঞ্চলকে বলা হত ‘চের’ বা কেরল। মালয়ালাম হল এই অঞ্চলেরই ভাষা। ‘মালয়ালাম’ বা ‘মলয়ালম’ শব্দটিকে ভাঙ্গলে এর অর্থ পাওয়া যায়, মল/মলৈ = পর্বত, আলম্ = উপত্যকা। অর্থাৎ পার্বত্য উপত্যকার ভাষা। এই অঞ্চলটি যেহেতু পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দ্বারা বিচ্ছিন্ন এবং এখানে প্রথমে পার্বত্য অঞ্চলেই অধিকাংশ মানুষ থাকত সেহেতু এখানের পার্বত্য উচ্চভূমির ভাষাকে নামকরণ করতে এই ‘মালয়ালাম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। তবে খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতক পর্যন্ত এই ভাষার কোনও সাহিত্যিক নিদর্শন পাওয়া যায় না। তাই ধরা নেওয়া হয় যে মালয়ালাম সাহিত্যের পথ চলা শুরু হয়েছে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এই ভাষার প্রথম সাহিত্যিক নিদর্শন ত্রিবাঙ্কুরের কোনও এক নৃপতি রচিত ‘রামচরিত’ (১৩০০ খ্রিঃ)। মালয়ালাম ভাষাটি মূলত কেরলের ভৌগলিক সীমানার মধ্যে বহুল প্রচলিত। এর লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। এই দ্রাবিড়ীয় ভাষাটির অনেকগুলো উপভাষা আছে যার মধ্যে একটি বিচিত্র উপভাষা হল ‘আরবি-মালয়ালাম’ যা আরবি আর মালয়ালাম ভাষার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে।
এবার ফেরা যাক বর্ষার উপভোগে। বলা যায়, মালয়ালাম গদ্য-সাহিত্যের জগতে ছোট গল্পের পথচলা শুরু হয় ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে। যদিও মালয়ালাম উপন্যাসের আবির্ভাব হয়েছে এর পূর্বেই। মালয়ালাম সাময়িকপত্র ‘বিদ্যাবিনোদিনী’তে প্রকাশিত কুনহিরমন নায়ানারের লেখা ‘বাসনাবিকৃতি’ গল্পের মাধ্যমে ছোটগল্পের এই ধারা শুরু হয়। তবে মালয়ালাম সাহিত্যের এই ধারাটিকে পুরোপুরি বিকশিত হতে সময় লেগেছিল আরও বেশ কয়েক দশক, প্রায় ১৯৩০ খ্রিঃ অবধি। এই সময়ে এবং এর পরে ধীরে ধীরে উঠে এলেন তাকাষী শিবশঙ্কর পিল্লাই, পি. কেশবদেব, ভৈকম মহম্মদ বশীর, অনেক পরে এম. টি. বাসুদেবন নায়ার, টি. পদ্মনাভন, ও. ভি. বিজয়ন এবং আরও অনেক অসাধারণ গল্পকার।
গদ্যকার তাকাষি শিবশঙ্কর পিল্লাই (১৯১২-১৯৯৯) রচিত ‘মাত্তনের গল্প’তে উঠে এসেছে মালাবার উপকূলের কোনো এক মাঝি মাত্তন ও তার পরিবারের গল্প। মাঝিমাল্লার জীবনে বা পরিবারে বৃষ্টি বরাবরই দুশ্চিন্তা বহন করে নিয়ে আসে। এই গল্পেও তাই দেখা যায়। গল্পের শুরুতেই দেখা যায় কোনও এক ভরা বৃষ্টির রাতে মাত্তনের পরিবার তার বাড়ি ফেরা নিয়ে চিন্তিত। তাঁর মেয়ে টেরেসা বলে উঠেছে, ‘এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় গেল বাবা? ভিজলে যে জ্বর হবে!’ (অনুঃ দিব্যেন্দু পালিত) মাত্তন ঘরে ফিরে আসে আর দেখে এই বৃষ্টির জন্য তার পরিবার খাবার সংগ্রহ করতে পারেনি, তার বাড়িতে জ্বালানোর জন্য আগুনটুকুও নেই। এত কিছু দেখে সে অঝোর ধারার বৃষ্টি উপেক্ষা করেও বেড়িয়ে পড়ে মাঝ রাতে আগুনের ব্যবস্থা করতে। যে ভাবে মাঝির কর্মজীবন বৃষ্টি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলতে থাকে।
তাকাষির কালজয়ী উপন্যাস ‘চেম্মিন’ বা ‘চিংড়ি’ (বাংলা অনুবাদ) এও বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে কেরালের উপকূলের মাঝি/ মাছ চাষিদের জীবন। যাদের রোজকার কর্মজীবনে, ব্যক্তিজীবনে, পারিকুট্টি-কারুতাম্মা-পালানির প্রেম-বিরহ, সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে বর্ষা নেমে এসেছে। সব শেষে দেখা যায় প্রবল ঝড়ের যে রাত উপন্যাসের পরিণতি নিয়ে আসে তাতে এক দিকে সমুদ্রের মধ্যে পালানি আর অন্য দিকে পারিকুট্টি আর কারুতাম্মা এক সঙ্গে উত্তাল ঝড়বৃষ্টির স্বীকার হয়, বৃষ্টি এখানে মৃত্যুর বাহক।
আবার, গল্পকার ভৈকম মহম্মদ বশীরের (১৯০৮-১৯৯৪) লেখা ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ গল্পে বৃষ্টি ফিরে ফিরে এসেছে বারবার। কাগজের সম্পাদক গোপীনাথ আর শারদার মিলন সম্ভব হয়েছে ‘এক ঝড়-বাদলের’ রাতে, যখন কাগজের অফিস থেকে বাড়ি ফিরে সে দেখে তার দরজার সামনে ‘বর্ষায় ঠাণ্ডা আর ভিজে হাওয়ায় দাঁড়িয়ে কাঁপছিল’ (অনুঃ দিব্যেন্দু পালিত) যুবতি শারদা। সেই বৃষ্টির রাতই প্রথম অবিবাহিত গোপীনাথের ঘরে নিয়ে আসে নারী-শরীরের সুগন্ধ। বৃষ্টির রাতে আশ্রয় দেওয়া থেকে গোপীনাথের নিজের জীবনে শারদাকে আশ্রয় দেওয়ার গল্পে যেন বৃষ্টি এক দৌত্যের কাজ করে। তার পরে তাদের দাম্পত্য জীবনে কখনও ঝগড়ার মধ্যে এক অনাহুত অতিথি হয়েই হোক কিংবা গোপীনাথের স্মৃতিরোমন্থন করতেই হোক গল্পে বারবার বৃষ্টি আর ঝড়ের রাত ফিরে ফিরে এসেছে। বশীরের এই গল্পে বৃষ্টি যেন এক অন্তরঙ্গতার প্রতীক হয়ে উঠেছে বারবার।
এমনই আরও নানা গল্প/ উপন্যাস যেমন, এস. কে. পোট্টেকাটের (১৯১৩-১৯৮২) ‘বধূ’ গল্পটি শুরুই হয়েছে ‘বৃষ্টির পর পরিস্কার হ’ল আকাশ। প্রকৃতির সৌন্দর্য্য এখন স্পষ্ট। সন্ধ্যা ও মেঘের মধ্যে চলছিল লুকোচুরি খেলা।’ – এইভাবে, যেখানে বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে সে তার প্রভাব রেখে গেছে। যেমন দেখা যায়, ও. ভি. বিজয়নের (১৯৩০-২০০৫) যুগান্তকারী মালয়ালাম উপন্যাস ‘খাসাককিন্তে ইতিহাসম্’ বা ‘দি লেজেন্ড অফ খাসাক’ উপন্যাসের শুরুতেই নায়ক রবি যখন খাসাক গ্রামে যাচ্ছে তখন তার পথ প্রদর্শক বৃদ্ধ তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন বৃষ্টির ব্যাপারে। কী ভাবে অধিক বৃষ্টি তাঁদের গ্রামে আগের বছর বন্যা নিয়ে এসেছিল সেই কথা উঠে এসেছে। উপন্যাসের মধ্যেও বৃষ্টির পর খাসাকে ‘ওনাম’ উদযাপনের এক অপার চিত্র উঠে এসেছে।
এমনই বহু দিক থেকে বাঙালিদের মতো মালয়ালীরাও বৃষ্টিকে বিভিন্ন রূপে খুঁজে পেয়েছে। কখনও আপন করে নিয়েছে। কখনও বৃষ্টির প্রতি রাগ উগড়ে দিয়েছে। কখনও বা সাহিত্যের সঙ্গী থেকেছে বৃষ্টি। মালয়ালাম গদ্য-সাহিত্য যেন তার জলজ্যান্ত ধারক।
এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং 'আষাঢ়ের গল্প' ফিচারের অংশ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy