বিভিন্ন জায়গায় ইলিশ খাওয়ার চল বিভিন্ন
ইলিশ মাছ পূর্ববঙ্গে খাওয়া হতো পয়লা বৈশাখের দিন। পয়লা বৈশাখ থেকেই এই ইলিশ খাওয়া শুরু। আমরা আগেই বলেছি যে জুলাই মাস থেকে ইলিশ খাওয়া উচিত। কিন্তু পয়লা বৈশাখে বহু জায়গাতেই ইলিশ মাছ দিয়ে পুজো করা হতো। তা সেটা খোকা ইলিশই হোক না কেন! পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজা ব্রেকফাস্টে খাওয়া হতো এবং সেটা দিয়েই বাঙালি নতুন বছরকে আহ্বান জানাত। বিয়েতে জোড়া ইলিশ, এমনকি সরস্বতী পুজোর দিনও জোড়া ইলিশ।
বাঙালির এই ইলিশ নিয়ে আদিখ্যেতার আর শেষ নেই! সরস্বতী পুজোয় ইলিশ দেওয়া হলে মা লক্ষ্মী যদি রাগ করেন! সেই জন্য লক্ষ্মীপুজোতেও কিন্তু আজকে অনেক বাড়িতেই ইলিশ দেওয়া হয়। তত্ত্বে ইলিশ বা গায়ে হলুদে ইলিশ বাংলাদেশের এক অত্যন্ত প্রচলিত প্রথা। আমাদের এখানেও যে সেটা একদম মানা হয় না, তা নয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে বিয়ে বাড়ির তত্ত্বে ইলিশের থেকে রুই মাছের প্রচলনটা একটু বেশি। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজকের দিনে গরীব মধ্যবিত্ত বাঙালি বাজারে যে ইলিশ মাছগুলিকে দেখতে পাই, দেড় কিলো বা দু’কিলোর যে জলের রুপোলি শস্য আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসেন, তারা কিন্তু আজকের দিনে ধরাছোঁয়ার বাইরে। যা দাম বাজারুরা হেঁকে বসেন, তাতে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আমাদের খুব কিছু করার থাকে না। বরং আমাদেরই যে বন্ধুবান্ধবরা বিলেতে চলে গেছেন, সেখানে লন্ডন বা নিউ ইয়র্কের বাজারে ইলিশের সহজলভ্যতা এক আনন্দের বিষয়।
আমেরিকাতে, বা বলা ভাল উত্তর আমেরিকাতে, যেখানে ইলিশ মাছ খুব একটা পাওয়া যায় না। ইলিশের সাবস্টিটিউট হিসাবে শ্যাড মাছকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উত্তর আমেরিকার ইস্ট কোস্টে এই মাছটি পাওয়া যায়। ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ এই শ্যাড বা ইলিশ, লিভারের পক্ষে অত্যন্ত ভাল। বাঙালির হৃদয় যে বড়, সেটা আমরা প্রেমের কবিতা বা প্রেমের গদ্যেই জানতে পারি। কিন্তু তার পেছনে কতটা ইলিশ আছে আর কতটা অন্য কিছু আছে, সেটা বলাটা কিন্তু একটু মুশকিল। এমনকি, বলা হয় এক মুঘল সম্রাটের মৃত্যুর পেছনেও ইলিশের হাত আছে। প্রাতঃস্মরণীয় সৈয়দ মুজতবা আলির চাচা কাহিনি পড়েছেন, পাঠক? এক বার এক জেলে অচেনা এক মাছকে নদী থেকে ধরে মহম্মদ বিন তুঘলক সাহেবের কাছে নিয়ে আসেন। তুঘলক তো অবাক! এ কেমন মাছ?! তবে নবাব সাহেব কিন্তু এক্সপেরিমেন্টে বিশ্বাসী ছিলেন। গোটা মাছটি তাঁর খানসামাকে দিয়ে রাঁধিয়ে খেয়েও ফেলেন। এবং সেই তৈলাক্ত মাছ খেয়ে পরের দিন নবাব সাহেব পটল তোলেন। আলি সাহেবের মতে, ইলিশ খেয়ে নবাব সাহেব স্বর্গেই বোধ হয় গিয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনাটির ঘটে মহম্মদ বিন তুঘলকের ব্যর্থ কচ্ছপ অভিযানের পর। বলা হয়, বিবেকানন্দ মারা যাওয়ার আগে ইলিশের ঝোল খেয়েই মারা গিয়েছিলেন।
এমনকি কবি বুদ্ধদেব বসু ইলিশ মাছকে বলেছেন জলের ‘রুপালি শস্য’। তিনি লিখেছেন –
আকাশে আষাঢ় এলো; বাংলাদেশ বর্ষায় বিহ্বল।
মেঘবর্ণ মেঘনার তীরে-তীরে নারিকেল সারি
বৃষ্টিতে ধূমল; পদ্মাপ্রান্তে শতাব্দীর রাজবাড়ি
বিলুপ্তির প্রত্যাশায় দৃশ্যপট-সম অচঞ্চল।
মধ্যরাত্রি; মেঘ-ঘন অন্ধকার; দুরন্ত উচ্ছ্বল
আবর্তে কুটিল নদী; তীর-তীব্র বেগে দেয় পাড়ি
ছোটে নৌকাগুলি; প্রাণপণে ফেলে জাল, টানে দড়ি
অর্ধনগ্ন যারা, তারা খাদ্যহীন, খাদ্যের সম্বল।
রাত্রি শেষে গোয়ালন্দে অন্ধ কালো মালগাড়ি ভরে
জলের উজ্জ্বল শস্য, রাশি-রাশি ইলিশের শব,
নদীর নিবিড়তম উল্লাসে মৃত্যুর পাহাড়।
তারপর কলকাতার বিবর্ণ সকালে ঘরে ঘরে
ইলিশ ভাজার গন্ধ; কেরানীর গিন্নির ভাঁড়ার
সরস সর্ষের ঝাঁজে। এলো বর্ষা, ইলিশ -উৎসব।
ইলিশ নিয়ে গানও আছে। সরস্বতী পুজোর দিন জোড়া ইলিশ এনে সিঁদুর হলুদ মাখিয়ে ধান দূর্বা দিয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা আর নোয়াখালির জেলেদের বউরা ইলিশ বরণ করেন, সঙ্গে গান –
ইলিশ মাছে কাটে বউ
ধার নাই বঁটি দিয়া
ইলিশ মাছ রান্দে বউ
কচু বেগুন দিয়া।
কিন্তু পেঁয়াজ অর নো পেঁয়াজ- সেই তক্কে যাব আমরা বাংলাদেশের মাওয়াঘাট অঞ্চলে এর পরের পর্বে।
এই প্রতিবেদনটি সংগৃহীত এবং ‘আষাঢ়ের গল্প’ ফিচারের অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy