কানে শুনতে পায় না বলেই অধিকাংশ বধির ছেলেমেয়ে কথা বলা শেখে না। কিন্তু এ রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে বধিরদের শুনতে সাহায্য করা বা স্পিচ থেরাপির তেমন পরিকাঠামো নেই বলে ডিসেম্বরে স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল মূক ও বধিরদের নিয়ে কাজ করা কলকাতার তিনটি বেসরকারি সংস্থা। তাদের সঙ্গে ছিলেন মূক-বধির শিশুদের ৮ জন অভিভাবক।
সমস্যা খতিয়ে দেখে স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নতুন বছরের প্রথমেই সরকারি হাসপাতালে বিনা পয়সায় চশমা দেওয়ার মতো বধিরদের নিখরচায় হিয়ারিং এড-ও দেওয়া শুরু হবে। দারিদ্রসীমার নীচে থাকা পরিবারের যে সব ছেলেমেয়ের মারাত্মক বধিরতায় ভুগছে, তারা এই সুবিধা পাবে। বিশ্বরঞ্জনবাবু বলেন, “হিয়ারিং এড কেনার সামর্থ্য না থাকায় গরিব বধির শিশুর শব্দের ধারণা তৈরি হয় না। এরা কথা বলা শেখে না। নিখরচায় হিয়ারিং এড পেলে এমন শিশুদের অল্প বয়স থেকে শব্দের সঙ্গে পরিচয় হবে।”
কিন্তু স্বাস্থ্য অধিকর্তার এই আশ্বাসে অভিযোগকারীরা নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। সমস্যা মেটার আশা দেখছেন না ইএনটি বিশেষজ্ঞ ও স্পিচ থেরাপিস্টরাও। এসএসকেএমের ইএনটি বিশেষজ্ঞ অরুণাভ সেনগুপ্তের কথায়, “সরকার কম দামের অ্যানালগ হিয়ারিং এড দেবে ঠিক করেছে। কিন্তু আমরা স্বাস্থ্য ভবনে প্রস্তাব দিচ্ছি ডিজিটাল হিয়ারিং এড দিতে। তাতেই একমাত্র কাজ হবে।”
সরকারি স্তরে দ্রুত বধিরতা চিহ্নিত করতে না-পারাটাও বড় সমস্যা। ইএনটি বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর দত্তের কথায়, “শিশুর ছ’মাস বয়স থেকে তিন বছর পর্যন্ত শেখার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই বধিরতা চিহ্নিত করে শক্তিশালী হিয়ারিং এড দিতে হয়। শুরু করতে হয় লাগাতার স্পিচ থেরাপি।”
স্পিচ থেরাপিস্ট সোমনাথ মুখোপাধ্যায় বা কুন্তল সরকারেরা বলেন, এসএসকেএম ছাড়া রাজ্যের প্রায় কোনও সরকারি হাসপাতালে সদ্যোজাতদের বধিরতা পরীক্ষার ‘অটো অ্যাকাউস্টিক এমিশন টেস্ট’-এর ব্যবস্থা নেই। চিকিৎসকেরা আরও জানান, ‘ককলিয়ার ইমপ্ল্যান্ট’ নামে এক ধরনের অস্ত্রোপচারে বধিরতা অনেকটা ঠিক করা যায়। কিন্তু রাজ্যের কোনও সরকারি হাসপাতালে এখনও তা চালু হয়নি। একমাত্র মেডিক্যাল কলেজে পরীক্ষামূলক ভাবে একটি-দু’টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। বেসরকারি জায়গায় এই অস্ত্রোপচারে ৫-৭ লক্ষ টাকা খরচ হয়, যা সকলের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
সরকারি হাসপাতাল ও সরকারপোষিত মূক-বধির স্কুলগুলির আর একটি বড় সমস্যা দক্ষ স্পিচ থেরাপিস্টের অভাব। এসএসকেএম, মেডিক্যাল কলেজেও মাত্র এক জন করে স্পিচ থেরাপিস্ট আছেন। গড়পারে রাজ্যে মূক ও বধিরদের সবচেয়ে বড় সরকারপোষিত স্কুলের অধ্যক্ষ সমীর সামন্ত বলেন, “আমাদের ৩৫০ জন ছাত্রছাত্রীর জন্য এক জন স্পিচ থেরাপিস্ট। শিক্ষকপদ খালি ৩০টি। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর হিয়ারিং এড কেনার টাকা নেই। এ ভাবে তারা কথা বলা শিখবে কী ভাবে?”
আট বছর হল যাদবপুরে নিজেদের সংগঠন তৈরি করেছেন কিছু মূক ও বধির ছেলেমেয়েদের মায়েরা। ৪০টি পরিবার এই সংগঠনের সদস্য। তাঁরা জানান, অধিকাংশ সরকারি স্কুলে স্পেশ্যাল এডুকেটর বা স্পিচ থেরাপিস্ট নেই। এই শিশুদের কী ভাবে পড়াতে হবে, সে সম্পর্কে বেশির ভাগ শিক্ষক অজ্ঞ। অনেকে হয়তো ছাত্রদের দিকে পিছন ঘুরে বোর্ডে লিখতে-লিখতে পড়াচ্ছেন। বধির ছাত্র-ছাত্রী তাঁর মুখ-ই দেখতে পারছে না ও ঠোঁট পড়তে পারছে না। হয়তো শিক্ষকের বলা লম্বা বাক্য বধির ছাত্রের বোধগম্য হচ্ছে না।
অভিভাবকদের কথায়, অনেক সময়ে বাচ্চাদের কান থেকে হিয়ারিং এড খুলে যায়। শিক্ষক সে দিকে নজর দেন না। অনেক শিক্ষক আবার বোর্ডে বা ডায়েরিতে না লিখে মুখে বলে দেন, যা বধির শিশু বুঝতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy