অচেনা শত্রুর সঙ্গে সহবাসই হতে চলেছে নতুন বছরের কঠোর বাস্তব। ফাইল চিত্র
কিছু প্রশ্ন এবং তার সম্ভাব্য উত্তর দিয়ে শুরু করা যাক।
প্রশ্ন ১: ২০২০-র শেষের দিকে ব্রিটেন বা আমেরিকায় যে করোনা টিকা দেওয়া শুরু হল, তার ফলে কি অতিমারি রোখা সম্ভব হবে?
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ, ওই টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থার এক শীর্ষকর্তা বলেছেন, সংক্রমণ রুখতে কতটা কার্যকর হবে এই টিকা, সে বিষয়ে তিনি সন্দিহান।
প্রশ্ন ২: ভারত তথা বঙ্গদেশেও হয়তো শীঘ্র আসতে চলেছে করোনা টিকা। কিন্তু যে রাজ্যে সংক্রমণ পাঁচ লক্ষ ছাড়িয়েছে ২০২০-র ডিসেম্বরের গোড়াতে, সেখানে এই টিকা নিকষকালো সুড়ঙ্গপথে কি একচিলতে আলোকরেখা সঞ্চার করবে?
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ সম্প্রতি ভারত বায়োটেকের টিকার তৃতীয় দফার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে অংশ নিয়েও করোনা সংক্রমিত হয়েছেন হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজ। এই টিকা নেওয়ার পর যে বাংলায় এমন অবস্থা কারও হবে না, তা হলফ করে কি বলা যায়!
কতদূর কার্যকর হবে কোভিড টিকা, তার সদুত্তর নেই। — ফাইল চিত্র
প্রশ্ন ৩: কোভ্যাক্সিন প্রতিষেধক দ্রুত এলে কি অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বল পাওয়া যাবে?
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ, কোভ্যাক্সিনের প্রতিষেধক দু’ডোজের। প্রথম ডোজ নেওয়ার ২৮ দিন পরে দ্বিতীয়টি নিতে হয়। দ্বিতীয়টির ১৪ দিন পরে শরীরে করোনা সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা। অর্থাৎ মোট ছ’সপ্তাহের প্রোটোকল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ছ’সপ্তাহের মধ্যে সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
প্রশ্ন ৪: ফাইজার-বায়োএনটেকের যে টিকাকে ব্রিটেন বা আমেরিকা ছাড়পত্র দিয়েছে, তাকে ভারতও অনুমতি দিতে পারে। তা হলে কি কিছুটা হলেও সমস্যার সমাধান হবে?
নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। কারণ, যেহেতু এই টিকা হিমাঙ্কের নীচে ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ভারতের মতো গ্রীষ্মপ্রধান দেশে এই টিকা সংরক্ষণ নিয়ে সমস্যা হতে পারে। আগে সংরক্ষণ, তার পরে তো তার কার্যকারিতার প্রসঙ্গ। ইতিমধ্যেই করোনার দ্বিতীয় স্ট্রেন এসে পড়েছে। তার মোকাবিলায় এই সব টিকা কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে সদুত্তর নেই।
প্রশ্ন ৫: অতঃপর, ২০২১ সালে তাহলে আমরা কোথায় পা রাখতে চলেছি?
করোনা টিকা নিয়ে যে আশাবাদের কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে মনে হতেই পারে এ হয়তো সুড়ঙ্গপথে দূর থেকে দৃশ্যমান এক চিলতে আলোকরেখা। কিন্তু এটা বিভ্রম নয়তো? কে বলতে পারে, আসলে সেই আলোকরেখা হয়তো সুড়ঙ্গের উল্টোদিক থেকে আসা কোনও ট্রেনের আলো!
কোভিডে মৃত্যু হলে শেষ দেখা দেখতে পান না পরিবারের সদস্যরা। এটাই বাস্তব। — ফাইল চিত্র
কোভিডের দ্বিতীয় বা তৃতীয় তরঙ্গ ইউরোপ তথা বিশ্বের সর্বত্র ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলেছে। নয়া স্ট্রেন চিন্তা বাড়িয়েছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি জার্মানিতে নতুন করে শুরু হয়েছে লকডাউন। আমেরিকায় দৈনিক সংক্রমণ ২ লক্ষ ছাড়িয়েছে। সুদূর আমেরিকা কেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখা গেল একটা ছোট্ট ভাইরাস কেড়ে নিল পরিবারের এক সদস্য পঁয়ত্রিশের চিকিৎসক অনিকেত নিয়োগীর প্রাণ। অথচ, মৃত্যুর আগেও কত রোগীর সেবা করেছিলেন অনিকেত! এত দিন জেনে এসেছেন জীবন অনিত্য। এখন জানতে পারলেন তো, জীবন শুধু অনিত্য নয় চরম অনিশ্চিত। তদুপরি বিপন্ন।
এই বিপন্নতা সর্বত্র। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনীতি, ক্রীড়াক্ষেত্র, বিনোদন—যে দিকে তাকাবেন এক ছবি। সাম্প্রতিক আনন্দবাজার ডিজিটালের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, বিপন্ন নাগরিকদের দৈনন্দিনতার এক ছবি। বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না! চিকিৎসকদের অনেকে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য রোগীর বাড়ি যেতে চাইছেন না। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর চার ঘণ্টা পরও মিলছে না ডেথ সার্টিফিকেট। আইন ব্যবসায়ী বন্ধু জানাচ্ছেন, গত এক বছরে বয়ষ্ক মানুষদের উইল করার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁরা চাইছেন ইচ্ছাপত্রের কাজ দ্রুত শেষ করতে। কারণ, আয়ু সম্পর্কে নিশ্চিত কোনও ধারণা নেই।
শিক্ষাক্ষেত্রেও চরম অনিশ্চয়তা। স্কুল বন্ধ। অনলাইন ক্লাসই হতে চলেছে অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ। যাঁরা বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য সুযোগ পেয়েছেন, তাঁদের অনেকের সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়েছে। ২০২০ সালে অলিম্পিক বাতিল হয়েছে। ২০২১-এ হওয়ার কথা। কিন্তু যে ভাবে করোনার তৃতীয়-চতুর্থ তরঙ্গ ফিরে এসেছে বিশ্বজুড়ে, তাতে কি নিশ্চিতভাবে বলা যায় নতুন বছরে অলিম্পিক হবেই? ২০২০ সালে উইম্বলডন হয়নি। বিভিন্ন খেলার বিশ্বমিট বাতিল হয়েছে। তবে ক্রিকেট ফিরেছে। অস্ট্রেলিয়ায় সিরিজে খেলতে গিয়েছে ভারতও। সেটা আশাপ্রদ। কিন্তু সর্বত্র ভরা গ্যালারিতে খেলা হয়নি। ইংল্যান্ড-দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ বাতিল হয়েছে। নিউজিল্যান্ডে খেলতে গিয়ে বহু পাকিস্তানি ক্রিকেটার কোভিডে আক্রান্ত।
নিয়ম করে জ্বর মাপা এখন নিউ নর্মাল। কিন্তু তাতেও কি রোখা যাচ্ছে এই বিপদ? — ফাইল চিত্র
এই অনিশ্চয়তার সঙ্গে সহবাসই হতে চলেছে নতুন বছরের কঠোর বাস্তব। শত্রুর সঙ্গে বসবাসই যেন ভবিতব্য! কিন্তু সেই শত্রু এমন একজন, যাকে আমরা চিনি না। যখন কোনও বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি, তখনই হয়তো নিঃশব্দে সেই ঘাতক ভাইরাস যেন প্রবেশ করছে দেহে। কারও প্রাণ কাড়ছে। কারও শরীর থেকে যা যাওয়ার পরও রেখে যাচ্ছে একাধিক প্রাণঘাতী উপসর্গ।
সাবেক ধারণা ছিল মহামারি, অতিমারি সব গরিব মানুষদের হয়। কিন্তু কোভিড দেখাল তা নয়। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে হরিপদ কেরানি—সবাই এক আসনে। কেউ জানে না আগামিকাল কী হবে।
তা হলে বাস্তব কী? বাস্তব হল ফেলে আসা বছর যেখানে শেষ করেছিলেন, নতুন বছর ঠিক সেখান থেকেই শুরু। করোনা রাতারাতি উধাও হয়ে যাবে না। আগামী বছর আমরা এক নতুন বিশ্বে প্রবেশ করতে চলেছি— এই সব ইউটোপিয়ায় যাঁরা বিশ্বাস করছেন, তাঁদের জন্য বলা যাক, নতুন বছরে কেউ কোথাও যাচ্ছে না। যেখানে, যেভাবে ছিল, সেখানে সেভাবেই থাকতে চলেছেন। ২০২০ সালে এক অপার অনিশ্চয়তা আমাদের সঙ্গী হয়েছিল। জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে আমরা সচেতন ছিলাম। কিন্তু অনিশ্চয়তা সম্পর্কে ততটা নয়। ২০২০ সাল জীবনের সেই অনিশ্চয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
নতুন বছর সঙ্গী হতে চলেছে যে অনিশ্চয়তা— এটাই একমাত্র বাস্তব। কঠোর বাস্তব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy