থিয়েটার আসলে এক যৌথ যাপন। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
দর্শকাসন থেকে যতটা চোখ যায় মঞ্চ জুড়ে থাকেন অভিনেতারা। মঞ্চের আলোর বৃত্তে তাঁদের অবাধ যাতায়াত। দর্শকের হাততালি আর অসংখ্য শুভেচ্ছা যাঁদের রোজকার প্রাপ্তি। কিন্তু মঞ্চের পিছনে যদি একবার উঁকি দেওয়া যায়, দেখা যাবে অন্ধকারে মিশে আছেন এক দল মানুষ। নাটক চলাকালীন যাঁদের দম ফেলার সময় নেই। কেউ দ্রুত হাতে কস্টিউম ইস্তিরি করে ফেলছেন, নাটকের প্রতিটি দৃশ্যে কেউ বা এগিয়ে দিচ্ছেন প্রপস্। অভিনয় না করলেও নাটকের সঙ্গে তাঁদের আত্মিক সম্পর্ক। থিয়েটার আসলে এক যৌথ যাপন। অভিনেতা থেকে শুরু করে ব্যাকস্টেজের প্রতিটি কর্মী— নাটক গড়ে ওঠার অপরিহার্য উপাদান। নেপথ্যে থাকা মানুষগুলির রুটিরুজিও এই থিয়েটারই। তাঁরা অন্য কোনও চাকরি করেন না, বড় পর্দায় তাঁদের কাজের সুযোগ থাকে না। বড় জোর বিভিন্ন নাট্যদলের হয়ে কাজ করে থাকেন। কিন্তু দিন শেষে তাঁরা আসলে আদ্যপান্ত থিয়েটার কর্মী। কোভিডের কারণে প্রায় দু’বছর বন্ধ ছিল থিয়েটারের শো। চরম দুর্ভোগে পড়েছিলেন থিয়েটারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত সেই মানুষগুলি।
কেমন ছিল লকডাউনের দিনগুলি?
১৯৮৭ সালের ‘নান্দীকার’-এর নাটকের উৎসব থেকেই অ্যাকাডেমির কাউন্টারে নাটকের টিকিট দেওয়ার দায়িত্ব সামলান চেতলার বাসিন্দা চন্দন সেনগুপ্ত। তিনি জানালেন, ‘‘লকডাউনে হঠাৎ করে সব মঞ্চগুলির মতো অ্যাকা়ডেমিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মাসিক কোনও বেতন নেই। শো থাকলে তখনই পারিশ্রমিক পাই। কোভিডের আগে প্রতি দিনই কোনও না কোনও দলের শো থাকত। আমার একার জীবন চালাতে কোনও সমস্যাই হত না। কিন্তু করোনা এসে সব ওলট পালট করে দিল। নাটকের শো বন্ধ হয়ে গেল। হলের দরজায় চাবি পড়ে গেল। আমরাও কাজ হারালাম। এক সময়ে ভেবেছিলাম থিয়েটার নামক শিল্পটি উঠেও যাবে বোধহয়। আর কোনও দিনই হবে না। তবে কষ্ট হলেও অন্য কোনও কাজ করার কথা ভাবিনি। তা ছাড়া কাজই বা কোথায়! বাকি যে কটা দিন বাঁচব আমি নাটকের সঙ্গেই থাকতে চাই।’’
লকডাউনে কাজ হারিয়েছিলেন নাটকের আলো প্রক্ষেপণ শিল্পী তাপস ভট্টাচার্যও। পেট চালাতে তিনি এবং তাঁর অন্য নাটকের সহকর্মীরা মিলে পরিকল্পনা করে অভিনব একটি পথ বেছেছিলেন। তিনি বললেন, ‘‘করোনা সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তেই স্কুল, কলেজের মতো ধীরে ধীরে শহরের প্রত্যেকটি থিয়েটার হল বন্ধ হয়ে গেল। নাটক নেই। আমরাও বেকার হয়ে গেলাম। কিন্তু আমি এবং আমার অন্য সহকর্মীরা মিলে ঠিক করলাম বসে থাকলে হবে না। পেট চালাতে কিছু একটা করতেই হবে। সেই ভাবনাই থেকে জন্ম নিয়েছিল ‘মঞ্চ থেকে মাসকাবারি’। লকডাউনে বাড়ি বাড়ি মুদিখানার জিনিসপত্র পৌঁছে দিতে লাগলাম। সেই সঙ্গে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজও শুরু করলাম। থিয়েটারের অনেকেই আমাদের কাছ থেকে তখন মুদিখানার জিনিসপত্র নিয়েছিলেন। পেটের দায়ে করলেও আমরা তো দিনের শেষে থিয়েটারের মানুষ। নাটক বন্ধ থাকলে মন খারাপ হয়। আবার মঞ্চ খুলছে। শো হচ্ছে। এখন আবার কাজের চাপ আরও বেড়ে গিয়েছে। থিয়েটার আর নতুন কাজ দুটোই সামলাতে হচ্ছে।’’
সরাসরি নাটকের সঙ্গে যুক্ত নন, অথচ বিগত ৩৩ বছর ধরে থিয়েটারই ধ্যানজ্ঞান গিরিশ মঞ্চের অস্থায়ী কর্মী শিখা দাসের। তাঁর কথায়, ‘‘গিরিশ মঞ্চ তৈরি হওয়ার বছরখানেক পর থেকেই আমি নাটকের বিরতির সময়ে চা আর জলখাবার সরবরাহের কাজ করি। দু’বছর আগে এক দিন আমাকে গিরিশ মঞ্চ থেকে ফোন করে বলা হল আগামী সাত দিন কাজে আসতে হবে না। কী একটা রোগ এসছে নাকি। তাই সব কিছু বন্ধ। শুনে তো মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা। এক দিন কাজে না গেলে যেখানে খাওয়া জোটে না, সেখানে এক সপ্তাহ বসে থাকলে খাব কী! সেই সাত দিন দু’বছরে এসে গড়িয়েছে। তবে লকডাউনে বিভিন্ন নাটকের দল থেকে আমাকে আর্থিক ভাবে, খাবার দিয়ে সাহায্য করেছে। বিপদের সময় নাট্যজগৎ আমার পাশে না থাকলে জানি না কী হত। এখন আবার নাটক শুরু হচ্ছে। আমি চাই আবার আগের মতো পুরোদমে শো হোক। রোজগার ছাড়াও নাটকের প্রতি একটা টান তৈরি হয়ে গিয়েছে। রোজ একবার করে মঞ্চে না এলে কেমন যেন লাগে।’’
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নাটকের পোশাক রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করে আসছেন থিয়েটার কর্মী মধুসূদন মাজি। তাঁর গলায় অবশ্য খানিক অভিমানের সুর শোনা গেল। তিনি জানালেন, ‘‘লকডাউনে আমি সে ভাবে কোনও সাহায্য পেয়েছি বলে আমার মনে পড়ে না। নাটক বন্ধ। কাজ বন্ধ। অথৈ জল পড়েছিলাম। বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে, বউমা রয়েছে। কী ভাবে সংসার চালাবো বুঝতে পারছিলাম না। অনেককেই ফোন করতাম। তাঁরা পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবে গোটা লকডাউনে আমি সর্বসাকুল্যে ৩৫০০ টাকার মতো অর্থ সাহায্য পেয়েছিলাম। তবে অন্য এক ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি সেই থেকে সরকারের তরফে মাসিক ১০০০ টাকা বার্ধক্য ভাতা পাই। নাটকের শো দীর্ঘ দিন বন্ধ ছিল। আমি চাই আবার যেন সব আগের মতো চালু হয়ে যায়। আবার যেন আমরা পুরনো জীবনে ফিরে যেতে পারি।’’
আজ ২৭ মার্চ, বিশ্ব থিয়েটার দিবস। থিয়েটারকে কেন্দ্র করেই যাঁদের জীবনের ওঠানামা তাঁদের কাছে প্রত্যেক দিনই থিয়েটার দিবস। একটি সম্পূর্ণ নাটক গড়ে ওঠার পিছনে এই নেপথ্য থাকা মানুষগুলির অবদান অপরিসীম। অন্তত তেমনটাই মনে করেন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির সদস্য অভিনেতা দেবশঙ্কর হালদার। তিনি বললেন, ‘‘অভিনেতা, ব্যাকস্টেজ কর্মী বলে আসলে কিছু হয় না। আমরা সবাই নাটকের কলাকুশলী। লকডাউনে সকলেরই সমস্যা হয়েছিল। থিয়েটারের অর্থনীতি তো সেই অর্থে পাকা পোক্ত নয় যে সেখান থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে। যাঁরা শুধুই থিয়েটার করেন, তাঁরা সকলেই দিন-আনি-দিন-খাওয়া মানুষ। ফলে খুবই সমস্যায় কেটেছে সেই সময়। তবে শুধু তো টাকাপয়সা নয়, মানুষ যখন তাঁর শিল্পকলা প্রদর্শন করার সুযোগ পায় তখন সে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। সেই প্রকাশের জায়গাটাও তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক দিকে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন, অন্যদিকে অস্তিত্বের টানাপোড়েন— এই দুটো নিয়েই দ্বন্দ্বে ছিলেন সকলে। তবু থিয়েটার তো লড়াই করতে শেখায়। তাই লড়াই করেই সমস্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন সেই মানুষগুলি। থিয়েটার দিবসে তাঁদের কুর্নিশ জানাই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy