Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
international women's day

আন্তর্জাতিক নারী দিবস: বাবা-মা ভাগ্যবান হলে কন্যাসন্তান হয়, প্রকৃতিগত কারণেই  মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে যত্নশীল

কোভিডের মতো সময়ে মহিলারা কি নেতৃত্বে এগিয়ে রইলেন? নারী দিবসে খোলাখুলি মহিলা কমিশনের অধ্যক্ষ লীনা গঙ্গোপাধ্যায়।

লীনা গঙ্গোপাধ্যায়

লীনা গঙ্গোপাধ্যায়

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২১ ১১:৩১
Share: Save:

বর্তমান সময়ে নারী দিবস পালন করার কতটা যৌক্তিকতা আছে? কোভিডের মতো সময়ে মহিলারা কি নেতৃত্বে এগিয়ে রইলেন? নারী দিবসে খোলাখুলি মহিলা কমিশনের অধ্যক্ষ লীনা গঙ্গোপাধ্যায়।

প্রশ্ন: নারী দিবস পালন করার আদৌ কোনও দরকার আছে কি?

উত্তর: অনেক নারীর মধ্যে এখনও সেই সচেতনতা নেই, তাঁদের একটা আলাদা জীবন আছে, পরিচয় আছে। নারী দিবস একটা ধাক্কা দেয় তাঁদের। যে সব নারীর মধ্যে এখনও নিজের অধিকারের বোধটা নেই, তাঁদের জন্য এই দিনটা খুব প্রয়োজনীয়। তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া যায়, তাঁদেরও কিছু পাওয়ার আছে। জন্মদিন পালন করার যেমন গুরুত্ব আছে, তেমনই নারী দিবস উদ্‌যাপন করারও তেমনই।

প্রশ্ন: কিন্তু গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কাছে কি পৌঁছতে পারে নারী দিবসের বার্তা?

উত্তর: সব সময় পৌঁছয় না। এটা সত্যি, বার্তাবাহী যাঁরা, তাঁদের দায়িত্ব থাকে বার্তাটা পৌঁছে দেওয়ার। পাশাপাশি এটাও সত্যি, গ্রামের সেই প্রান্তিক মেয়েটির নারী দিবস নিয়ে আলাদা করে কিছু আসে যায় না। সে নিজেই লড়াই করে বাঁচতে পারে। কোনও দিবসের ধার ধারে না সে। নিজের নিয়মেই লড়াই করে। কিন্তু কোনও দিন যদি নারী দিবসটা তার কাছে এসে পড়ে, তা হলে হয়তো সে নিজের লড়াইটাকে সম্মান করতে শিখবে। লড়াইটা স্বীকৃতি পাবে। এই কারণেই দরকার।

প্রশ্ন: দুটো আলাদা জগতের মধ্যে থেকে আপনি মেয়েদের দেখেছেন। একটা লেখালিখি, শিল্পকলার জগত। অন্যটা মহিলা কমিশনের সঙ্গে যুক্ত জগত। এ প্রসঙ্গে বলার, নারী আর পুরুষের সমতার লড়াইয়ে কোন জগতে কেমন?

উত্তর: সারা পৃথিবী জুড়েই নারী দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবে চিহ্নিত। যত দিন না এই ছবিতে বদল আসবে, তত দিন সমতা একটা কল্পনা মাত্র। যত দিন সমাজের এই কাঠামো থাকবে, নারীকে অন্যের পরিচয়ে পরিচিত হতে হবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর সংরক্ষণ থাকবে, তত দিন পর্যন্ত সমতা আসতে পারে কি? শরীরগত পার্থক্যটুকু বাদ দিয়ে নারী আর পুরুষের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। কিন্তু তবু সাম্য আসছে কি? আসছে না। সেই কারণেই তো এই লড়াই। পুরুষ কমিশন বলে তো কিছু হয় না। কারণ দরকারও হয় না। মানবাধিকার কমিশন আছে। কিন্তু মহিলা কমিশন তৈরি করতে হয়েছে। কারণ মহিলারা এখনও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তাঁরা এখনও অত্যাচারিত, নির্যাতিত হন।

প্রকৃতি মেয়েদের বানিয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো করেই।

প্রকৃতি মেয়েদের বানিয়েছে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো করেই। প্রতীকী ছবি

প্রশ্ন: সাহিত্য বা শিল্পকলার জগতে পরিস্থিতিটা কেমন?

উত্তর: ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, এই বিষয়ে আমি খুবই সুবিধাভোগীদের দলে। আমি নাগরিক জীবনে বড় হয়েছি। সেখানে কিছু সুবিধা তো থাকে। পারিবারিক সুবিধাও পেয়েছি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা নিয়ে পরিবারে কোনও প্রভেদ ছিল না। দাদুর একটা কথা এখনও মনে আছে আমার। আমার এক বান্ধবী ওঁকে বলেছিলেন, তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। উনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘তোমাদের বিয়ে হয় কেন? তোমরা বিয়ে করো না কেন?’’ সে কথাটা এখনও কানে বাজে। তবে লড়াই কি একেবারে নেই? নিশ্চয়ই আছে। পুরুষদের এই বিরাট পরিসরে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই তো একটা লড়াই। তবে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কেউ যদি নিজের জায়গাটা আদায় করতে পারেন, তা হলে অন্যরা তাঁকে সম্মান দিতে বাধ্য হন।

প্রশ্ন: সহকর্মী পুরুষদের নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা কেমন?

উত্তর: কর্মস্থলই হোক বা পরিবার, একটি কথা বলতেই পারি, আমায় কেউ কখনও পিছনে টেনে ধরেনি। সেই অর্থেও আমি সুবিধাভোগী।

প্রশ্ন: কিন্তু কমিশনের কাজ করতে গিয়ে তো বারবার অন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়?

উত্তর: অবশ্যই। নিজের ব্যক্তিগত জায়গাটা এক, কমিশনের হয়ে কাজ করে গিয়ে যাঁদের সঙ্গে দেখা হয়, সেই সব মহিলাদের জায়গাটা আর এক। এমন বধূ নির্যাতনের ঘটনা শুনেছি, যা শুনে শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অন্য সব পরিচয় ছাপিয়ে সেই সব গল্পে বড় হয়ে যায় দুটো পরিচয়— এ পুরুষ আর ও নারী। যে পুরুষ, তার যেন অধিকারই আছে অত্যাচার করার। এটা যদি একটা দিক হয়, তা হলে অন্য একটা দিকও আছে। কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, এমন অনেক নারীও রয়েছেন, যাঁদের প্রতিবাদ করার অনেক মাধ্যম এবং কারণ থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পিছিয়ে আসেন। নিরাপত্তার জায়গা থেকে হোক বা সামাজিক কারণেই হোক, তাঁরা লড়াই করতে ভয় পান। দীর্ঘ দিন নির্ভরশীল থাকতে থাকতে লড়াই করার ক্ষমতাটা চলে যায় হয়তো। আবার এটাও দেখেছি, চাকুরিজীবী মহিলা, তাঁর বর তাঁকে মারধর করেন। অনেক দিন কেটে যাওয়ার পর তিনি কমিশনের দ্বারস্থ হয়েছেন। এটা তো তাঁর হওয়ার কথা ছিল না। ওঁর যুক্তি, বিয়ে ভেঙে দিয়ে আবার বিয়ে করলে যদি আরও গোলমাল হয়! কেন যে বিয়ে করতেই হবে, সেটা ওঁকে বোঝানোই যায় না। আমি বিবাহের বিরোধী নই। কিন্তু আমার কথা, বিবাহ তিক্ত হলে, তাকে টিকিয়ে রাখার দায় থাকবে কেন! এমন তিক্ত বিয়ে থেকে আত্মহত্যার ঘটনা বা হত্যার ঘটনা তো কম নয়। এবং এর বেশি ভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিকতাটা দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাণের চেয়েও তা দামি হয়ে গিয়েছে। তাই অত্যাচারিত মেয়েটি বাপের বাড়ি ফিরে আসতে পারেনি।

নরী দিবস মেয়েদের মনে করায়, নিজেদের লড়াইকে সম্মান করতে।

নরী দিবস মেয়েদের মনে করায়, নিজেদের লড়াইকে সম্মান করতে। প্রতীকী ছবি

প্রশ্ন: কী ভাবে পরিস্থিতিতে বদল আনা যাবে বলে ভাবেন আপনি?

উত্তর: এই মেয়েদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। আমার লড়াই আমাকেই লড়তেই হবে। মানসিকতায় বদল আনতে হবে। শুধু বরকে দোষ দিলাম, আমায় নির্যাতন করে বলে। কিন্তু তুমি নির্যাতিত হও কেন? সেই প্রশ্নটার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। তুমি যদি আজ বিদ্রোহ ঘোষণা করো, এ ভাবে আর থাকব না— তা হলে তোমার কোন ক্ষতিটা হবে! নির্যাতনের থেকে যদি নির্ভরতার দাম বেশি হয়, তা হলেই একমাত্র অত্যাচার সহ্য করে কেউ থাকতে পারে।

প্রশ্ন: কোভিডের মতো একটা ঘটনা ঘটল। এমন ঘটনা আগে পৃথিবী দেখেনি। উঠে এসেছে নারীর নেতৃত্বের বিষয়টিও। আজকের নারী দিবসে এসে কী মনে হয়, পৃথিবীতে মহিলাদের অবস্থানটা ঠিক কোথায়?

উত্তর: আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, যাঁরা কাজ করতে চান, তাঁরা পারেন। কাজের কোনও ছেলে-মেয়ে হয় না। সারা পৃথিবী জুড়েই কোভিডের সঙ্গে লড়াই করছেন মহিলা নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসকরা। তাঁরা তো পুরুষের থেকে কম কিছু করেননি। লকডাউনে বাড়ির কাজ করেছেন, বাড়ি থেকে অফিসের কাজ করেছেন, নারীর তো কাজ থেমে থাকেনি। মেয়েরা অনেক বেশি একনিষ্ঠ হয়। মেয়েদের এটা প্রকৃতিগত গুণ। পুরুষরা নন, তা নয়। কিন্তু মহিলাদের মধ্যে বিষয়টা বেশি। সন্তানকে ধারণ করা, শুধু ধারণ নয়। তাকে বড় করার দায়িত্ব মেয়েরা যে কারণে খুব সুন্দর করে সামলাতে পারে। সেটাই বর্তমান সময়ে মেয়েদের নেতৃত্বে এগিয়ে আসতে সাহায্য করেছে। ছোট থেকেই দেখেছি, বাড়িতে কিছু নেই। হঠাৎ অতিথি এসে হাজির। মায়েরা কিছু একটা বানিয়ে দিতেন। বর্তমান অসময়ে মেয়েদের এই গুণটাই কাজে লেগেছে। এটাই তাদের মুন্সীয়ানা। মেয়েদের প্রকৃতিগত গুণগুলিই তাদের বড় করে তোলে।

প্রশ্ন: বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হয়, কোনও সন্তান ছেলে না হয়ে মেয়ে হলে ভাল হত?

উত্তর: আমার সব সময়ই মনে হয়, কোনও বাবা-মায়ের যদি মেয়ে হয়, তারা ভাগ্যবান। এত কিছুর পরেও এটাই মনে হয়। ছেলে আর মেয়ে সমান, যতই বলি আমরা— তবু আমার মনে হয়, যাঁদের কন্যাসন্তান আছে, তাঁরা অনেক বেশি যত্ন পান সন্তানের থেকে। সেটা প্রকৃতিগত কারণেই। ছেলেরা বাবা-মা’কে সেই জায়গাটা দিতে পারে না।

বাড়ি সামলেও বাইরে সামলাতে পারে মেয়েরা।

বাড়ি সামলেও বাইরে সামলাতে পারে মেয়েরা। প্রতীকী ছবি

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy