একা মেয়েদের গল্প। —নিজস্ব চিত্র।
বিয়ে, পরিবার, একা থাকা, সুখে থাকা নিয়ে নানা ধারণা আছে সমাজে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরে নেওয়া হয়, কেউ একা থাকলে তিনি সুখে নেই। সুখের ছবি কখনও একা হয় না। অনেকেই বলেন, একা থাকলে উৎসব আনন্দের হয় না। ঘরে আলো থাকে না। কিন্তু সত্যি কি তা-ই? পয়লা বৈশাখের আড্ডায় আনন্দবাজার অনলাইনের সঙ্গে মনের কথা বলতে বসেছিলেন এ শহরেরই পাঁচ নারী। তাঁরা সকলে একা থাকেন। কেউ কখনও বিয়ে করেননি। কেউ বা বিবাহবিচ্ছেদের পরে নিজের মতো করে সংসার করছেন। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। কাজ করেন। সাজগোজ করেন। পছন্দের খাবার খান। মনের আনন্দে থাকেন। উৎসবের দিনে বাকি সকলের মতোই তাতে মাততে ভালবাসেন।
গ্রীষ্মের দুপুরে নরম পানীয় হাতে আড্ডায় বসেছিলেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ মুক্তা নয়েন, লেখিকা শ্রীময়ী কুন্ডু, অ্যাপ-ক্যাব চালক দীপ্তা ঘোষ, কর্পোরেট কর্ত্রী সোমা চক্রবর্তী এবং প্লাস সাইজ় মডেল অনিন্দিতা রায়। বৈশাখী উদ্যাপন থেকে শুরু হয়ে কথা পৌঁছল দুর্গাপুজো, প্রেম দিবস পালনে। তাঁরা কি একাই থাকেন এ সব দিনে? মনখারাপ হয় কি কখনও? সকলের মধ্যে বয়সে বড় মুক্তা। অভিজ্ঞতাও অনেক দিনের। মুখ খুললেন তিনিই। জানালেন, বিয়ে না করা মানেই একা থাকা নয়। তিনি বাঙালি নন, তবে কলকাতা শহরেই কেটেছে এতগুলি বছর। পয়লা বৈশাখ তাঁর কাছেও একটি বিশেষ দিন। কিন্তু স্বামী-সন্তান নেই মানেই যে পরবের দিনে একা থাকতে হবে, সে কথা কে বলেছে! বলেন, ‘‘পরিবারের ধারণা সমাজে যতটা একরৈখিক, আসলে তো তা তেমন নয়। স্বামী-সন্তান নেই আমার, কিন্তু পরিবারে অনেকে আছেন। ভাই-বোন-ভাইপো-ভাইঝি। সকলে আমরা আনন্দে থাকি।’’
শ্রীময়ী বেশ কিছু বছর ধরে একা থাকা নারীদের একজোট করছেন। নাম দিয়েছেন ‘স্টেটাস সিঙ্গল’। তাঁদের একে-অপরকে নিয়ে একত্রে আনন্দ করার উৎসাহ জোগাচ্ছেন। তিনি শুধু নিজের কথা নয়, অন্য অনেকের কথাও জানেন। বিশেষ দিনে যে একা থাকা নারীদের নিয়ে নানা কথা হয়, তাঁদের আরও একা করে দেওয়া হয় সে সব কথায়, তা তিনি জানেন। শ্রীময়ী বলেন, ‘‘প্রথম যখন আমাদের ‘স্টেটাস সিঙ্গল’ তৈরি হল, একজোট হয়েছিলাম সকলে একটা দুর্গাপুজোর বিজয়া দশমীর দিনে। একা মেয়েরা কেউ কেউ বিয়ে করেননি, কেউ বিবাহবিচ্ছিন্ন, কেউ বা স্বামীকে হারিয়েছেন। দশমীর দিন তাঁদের কাউকেই সিঁদুর খেলার অধিকার দেওয়া হয় না সামাজিক ভাবে। উৎসবের কী সম্পর্ক বিয়ের সঙ্গে? কিন্তু তেমনটাই তো ধরে নেওয়া হয়। তাই আমরা নিজেরা সিঁদুর খেলেছিলাম।’’ বিয়ে না করে একা থাকা আসলে ততটাও দুঃখের নয়। নিজের মতো করে সকলে থেকেই যায়। কিন্তু সামাজিক ভাবে অনেকটা বেশি ভার চাপিয়ে দেওয়া হয়। নতুন বছর শুরুর উৎসবের মুখে সে কথাই মনে হচ্ছে এই নারীদের।
দীপ্তা বিয়ে করেননি। থাকেন মায়ের সঙ্গে। তাঁরও অভিজ্ঞতা অবাক করা। বলেন, ‘‘পাড়ার অনেকে আমাকে এসে বলেন, এই বয়সটা বাড়ি বসে মায়ের জন্মদিন পালন করার নয়। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে শাশুড়ির জন্মদিন পালন করার।’’ সমাজ এ ভাবেই আনন্দের ধারণাও ঠিক করে দেয় বলেই উপলব্ধি করেছেন দীপ্তা।
তবে আনন্দের সঙ্গে সমাজের বাঁধাধরা ধারণার কোনও মিল নেই। নিজের মতো করে থাকতে শিখে নিতে হয়।
নিজেকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার কথা কর্পোরেট কর্ত্রী সোমা থেকে মডেল অনিন্দিতা— সকলের মুখেই ঘোরে। অনিন্দিতা যেমন অতিষ্ঠ ‘সেটেল করবি কবে’ শুনতে শুনতে। বলেন, ‘‘একা থাকলে কি কেউ নিজের মতো গুছিয়ে থাকতে পারে না? ‘সেটেল’ করা মানে কী? আমি তো একা বেশ ভাল সময় কাটাই।’’ সোমার প্রশ্নও তেমনই। এখনও তিনি বুঝে উঠতে পারেন না, সকলে পরিবার বলতে শুধু স্বামী-সন্তান বোঝেন কেন? সোমা এক সময়ে বিয়ে করেছিলেন। কয়েক বছর হল বিচ্ছেদ ঘটেছে। তার পর থেকে একটি বাড়িতে একাই থাকেন। তার মানে এমন নয় যে, তাঁর পরিবার নেই। বাবা-মা তো পরিবার বটেই, তা ছাড়াও সোমার ভাই-ভ্রাতৃবধূ আছেন, আছে তাঁদের সন্তানও। সোমা বলেন, ‘‘ওরা কি আমার পরিবার নয়? কোনও বিশেষ দিনে আমিও আমার পরিবারের সঙ্গেই থাকি। আনন্দ করি।’’ সোমা যেমন ছুটির দিনে মাঝেমাঝে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যান, আবার কখনও কখনও একাই পপকর্ন হাতে সিনেমা দেখতে ঢুকে পড়েন। তাঁর একা থাকা নিয়ে কোনও দুঃখ নেই।
পয়লা বৈশাখে সাধারণত পরিবারের সঙ্গেই ছুটি কাটান সকলে। তবে কি এই নারীদের জীবন সেই ‘সকলের’ থেকে আলাদা? আসলে কিন্তু খুব আলাদা নয়। ঠিক যেমন সকলে আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে বেঁধে বেঁধে থাকেন বিশেষ এই দিনটিতে, একা ঘর করা এই নারীরাও তেমন। কেউ বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান, কারও বা আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া থাকে। এ শহরে তাঁদের মতো অনেকেই আছেন। আনন্দেই থাকেন তাঁরা। শুধু সমাজের ধারণা যদি তাঁদের নিয়ে কিছুটা বদলায় নতুন বছরে, তবে নব আনন্দে জাগবে চারপাশটাও। এমনই মত নতুন যুগের, নয়া চিন্তাধারা নিয়ে বেঁচে থাকা এই নারীদের।
(ছবিগুলি তোলা হয়েছে পার্ক হোটেলে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy