সিমোনে বাইলস ছবি: সংগৃহীত
বোঝা আগেই উচিত ছিল। কিন্তু বোঝা গেল যখন নেয়োমি ওসাকা হঠাৎ ফরাসি ওপেন থেকে নাম সরিয়ে নিলেন। নামেননি উইম্বলডনেও। আর এ বার সিমোনে বাইলস। অলিম্পিক্সে চারটি সোনা-সহ ছ’টি পদক, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১৯টি সোনা-সহ ২৫টি পদকের অধিকারিনীকে এবার সে ভাবে দেখতেই পেল না ক্রীড়াবিশ্ব! কারণ একই— মন ভালই নেই।
খেলোয়াড়দের চাপ সব সময়েই থাকে। মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলার সময়ে অনেক ভাল খেলোয়াড়ই খ্যাতি অনুযায়ী খেলতে পারতেন না। আবার অনেক চাপ জাতিগতও। ইংল্যান্ডের টেনিস তারকা টিম হেনম্যান। গোটা দেশের প্রত্যাশা ছিল তিনি উইম্বলডন জিতবেন। অথচ ফেডেরার-আগাসিদের সঙ্গে তিনি কোনও দিনই পেরে উঠতেন না। গোটা জাতির তাও আশা ছিল যদি কোনও অঘটন ঘটে! তেমনটা অবশ্য কোনও দিন হয়নি। এই ধরনের চাপ বোঝা যায়। কিন্তু সিমোনে বা ওসাকা, যাঁরা এই মুহূর্তে সব প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঊর্ধ্বে, তাঁদের এই চাপ কেন?
পারফরম্যান্সের চাপ? ভঙ্গুর মনন? হার সামলাতে না-পারার ব্যর্থতা? কী কারণে চ্যাম্পিয়ন অ্যাথলিটরা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ছেন?
আসলে খেলাধুলোর চরিত্রটাই পাল্টে গিয়েছে। আগে খেলা ছিল নেশা। লোকে শখের জন্য খেলতেন, ভালবেসে খেলতেন। এখন সেটা হয়ে গিয়েছে পেশা। আর যে কোনও পেশার মতোই খেলোয়াড়দের উপর বাড়তি আর্থিক চাপ চলে এসেছে। সঙ্গে থাকে অন্য আর এক ধরনের চাপও। ডাক্তার বা উকিল আজীবন আয় করে যেতে পারেন। বয়স বাড়ার সঙ্গে বাড়ে অভিজ্ঞতা। এবং সেই সঙ্গে বাড়ে আয়ও। সেই তুলনায় খেলোয়াড়দের আয় করার অবকাশ কম। খুব কম সময়ের মধ্যে অনেকটা আয় করে ফেলতে হয়। কারণ অন্য বেতনধারীদের মতো তাঁদেরও ইএমআই দিতে হয়। তাঁদের আয় যেমন বেশি, ব্যয়ও তেমন। তাঁদের ঘিরে রয়েছে একটি বিশাল দুনিয়া— ম্যানেজার, কোচ, চিকিৎসক ও আরও অনেকে। বছর বছর তাঁদের ‘নেট ওয়ার্থ’-এর মূল্যায়ন হয়। এগুলির পাশাপাশি আবার তাঁদের বাড়তি একটি চাপও রয়েছে।
একজন খেলোয়াড় যখন মাঠে নামেন, তিনি শুধু একজন খেলোয়াড় থাকেন না। গোটা দেশের প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন। শুধু নিজের নয়, লক্ষ লক্ষ অনুগামীর প্রত্যাশা পূরণ করতে হয়। খুব কম পেশায় এই বাড়তি চাপটা থাকে। তাই এই পাহাড়-প্রমাণ চাপের ভার অনেক সময়েই আর বইতে পারেন না শীর্ষে থাকা খেলোয়াড়রা। সোনাজয়ী নীরজ চোপড়াও যখন পরের বার মাঠে নামবেন, তখন গগনচুম্বী প্রত্যাশার ভারও যোগ হবে জ্যাভলিনের সঙ্গে। প্রথম বারের মতো বিষয়টা সহজ হবে না।
বাইলস টোকিয়ো অলিম্পিক্সে ‘আমানার’ ভল্ট দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পর একে একে সমস্ত ইভেন্ট থেকে নাম তুলে নিয়েছেন (যদিও পরে আবার একটি ইভেন্টে ফিরে এসে ব্রোঞ্জ জিতেছেন)। নেয়োমি ওসাকাও নিজের দেশ জাপানের সেরা বাজি কোর্টে নেমেছিলেন বটে। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে ছিটকে গিয়েছেন মাঝপথে। তার কয়েক দিনের মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে টেস্ট সিরিজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন ইংরেজ ক্রিকেটার বেন স্টোকস। তারও আগে ২০১৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল খেলা থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। নিজের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য। তারকা সাঁতারু মাইকেল ফেলপ্স ২০০৮ সালের বেজিং অলিম্পিক্সে হারের পর তাঁর অবসাদের কথা খোলাখুলি আলোচনা করেছেন বহু বার।
অনেকে বলেন, অ্যাথলিটদের তো শরীরটাই আসল। কঠোর পরিশ্রমে তৈরি করা শরীর। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম। তার পর স্বপ্ন-সফর। সেখানে মনের ভূমিকা কোথায়? বাইলসের ঘটনা অভূতপূর্ব নয়। কিন্তু বাইলস-হীন অলিম্পিক্স এবার এতটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে যে, এই আলোচনা নতুন করে উস্কে দিতে পেরেছেন ২৪ বছরের জিমন্যাস্ট। তিনি কি সেই পরিস্থিতির শিকার, যাকে মনোরোগ জগতে বলে ‘পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটি’?
মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রামের বক্তব্য, ‘‘খুব কম বয়স থেকে ট্রেনিং শুরু করেন জিমন্যাস্টরা। অত ছোট থেকে যে ভাবে তাদের শারীরিক গঠন, ভুলভ্রান্তি খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়, তা অত্যন্ত প্যাথোলজিক্যাল। সারাক্ষণ যদি কাউকে বিএম়ডব্লিউ-র মতো পারফর্ম করতে বলা হয়, তা হলে সেই প্রত্যাশার চাপ মনের উপর গুরুতর প্রভাব ফেলতেই পারে।’’ যদিও তাঁর দেশ আমেরিকার অনেক সহ-নাগরিকের কটাক্ষের শিকার হয়েছেন বাইলস। আমেরিকার অবামপন্থীরা বলেছেন, ‘‘আমরা এক অত্যন্ত দুর্বল প্রজন্ম তৈরি করছি।’’
অ্যাথলিটদের মানসিক উদ্বেগ কি শুধু মানসিক দৌর্বল্য? এই ধরনের উদ্বেগে হৃদ্স্পন্দন বেড়ে যায়, গলা শুকিয়ে যায়, ঢোক গিলতে অসুবিধা হয়, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে শক্ত হয়ে যায়। এই সবই ‘পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটি’র উপসর্গ। সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জিমন্যাস্ট বাইলস কি সেই অসুখেই অসুখী?
জিমন্যাস্টিক্সের পরিভাষায় ‘টুইস্টিস’ এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। ভল্ট দেওয়ার সময়ে শূন্যে উঠে হঠাৎ কোনও জিমন্যাস্টের তাঁর শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার, বাড়তি ঝাঁপ দিয়ে ফেলার বা নিরাপদ ভাবে অবতরণ করতে না পারারই পোশাকি নাম ‘টুইস্টিস’। বাইলস টুইট করে জানিয়েছিলেন, তিনি এই সমস্যাতেই ভুগছেন। কোন দিকে মাথা আর কোন দিকে পা, তা পারফরম্যান্সের মাঝে গুলিয়ে যাচ্ছে। কেন এমন হয়? ক্রীড়া মনোবিদ অনুশীলা ব্রহ্মচারীর বক্তব্য, ‘‘কোনও অ্যাথলিটের ব্যক্তিগত জীবনে আগে থেকে কোনও মানসিক চাপ থাকলে বা তাঁর মধ্যে কোনও ব্যক্তিত্বনির্ভর দুর্বলতা থাকলে এই ধরনের সমস্যার আশঙ্কা বেড়ে যায়।’’
এক সময়ে ব্যক্তিগত জীবনের বিতর্ক নিয়ে জেরবার ছিলেন জাতীয় অ্যাথলিট পিঙ্কি প্রামাণিক। তাঁকে খেলা ছেড়ে দিতে হয়েছিল। পিঙ্কির কী মনে হয়েছিল? জবাব এল, ‘‘ব্যক্তিগত জীবনের টানাপড়েন যে কোনও মানুষের জীবনেই মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। একটা সময়ে আমারও সেটা হয়েছিল। কিন্তু ময়দান থেকে সরে যাওয়ার কষ্ট আমার কাছে অনেক বেশি ছিল।’’ তবে পিঙ্কি কোনও মনোবিদের পরামর্শ নেননি। বন্ধুবান্ধবদের ভরসাতেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন।
পাঁচ বছর আগে রিয়ো অলিম্পিক্সে জিমন্যাস্টিক্স ফাইনালে বাইলসের সঙ্গেই লড়ে চতুর্থ হয়েছিলেন ভারতের দীপা কর্মকার। তাঁর কথায়, ‘‘মানসিক চাপ একটা বড় কারণ। গত সাত-আট বছর ধরে বাইলস ভল্ট, আনইভেন বার, ফ্লোর এক্সারসাইজে অপ্রতিরোধ্য। ওকে ঘিরে রয়েছে গোটা বিশ্বের প্রত্যাশার চাপ।’’ পাশাপাশিই দীপার বক্তব্য, ‘‘জিমন্যাস্টদের মনের মধ্যে সব সময়েই চিন্তা থাকে যে, পিছনের লোকটা আমাকে কোনও ভাবে ছাপিয়ে যাচ্ছে না তো! সেই উদ্বেগের সঙ্গেই কঠিন সব ভল্টও নিখুঁত করতে হয়! আশঙ্কা এবং মানসিক চাপেই হয়তো এই পরিস্থিতি।’’ তাঁর নিজের ‘প্রোদুনোভা’-র মতো বিপজ্জনক ভল্ট দেওয়ার সময়ে উদ্বেগ বা আশঙ্কা হয়নি? দীপার জবাব, ‘‘প্রথমে ভয় লাগলেও তা অতিক্রম করেই প্রোদুনোভা দিয়েছি। কিন্তু আমার চেয়ে অনেক বেশি চাপ বাইলসের।’’
কী ভাবে সামলানো যায় এই উদ্বেগ? অনুশীলার বক্তব্য, ‘‘মানসিক চাপ সামলে কত দূর যাবেন এবং কোন সময়ে পিছিয়ে আসবেন, সেটা একজন অ্যাথলিটকেই বুঝতে হবে। মানসিক চাপ এতটাই এড়িয়ে গেলাম যে, কেরিয়ারের ক্ষতি হয়ে গেল, সেটা যেমন কাম্য নয়, তেমনই একটুতেই পিছিয়ে আসাও কেরিয়ারের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই শুরু থেকে ক্রীড়া মনোবিদে সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ভাল। যিনি অ্যাথলিটকে পথ দেখাতে পারবেন। বলতে পারবেন, কী ভাবে এগোলে মানসিক লড়াইগুলি পেরিয়ে সে আরও ভাল পারফর্ম করতে পারবে।’’
২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময়ে ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সদস্য ছিলেন ‘মেন্টাল হেল্থ কোচ’ প্যাডি আপটন। তাঁর লেখা বই ‘দ্য বেয়ারফুট কোচ’ বলে, ক্রিকেটাররা কতটা মানসিক চাপে থাকেন। কতটা চাপে থাকেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচের আগে। কিন্তু সেই মানসিক অবস্থা নিয়ে কথা বলতেও সাহস পেতেন না। চেতেশ্বর পুজারা ক্রিকেট দুনিয়ায় তাঁর মানসিক কাঠিন্য এবং ধৈর্যের জন্য খ্যাত। তিনি একবার বলেছিলেন, যাবতীয় নেতিবাচক চিন্তা দূরে রাখতে তিনি যোগ এবং ধ্যানের সাহায্য নেন। পুজারাই বলেছিলেন, ‘‘যে কোনও মানসিক সমস্যার চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। কিন্তু ভারতীয় ক্রিকেটারদের আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার সময়ে প্রত্যাশার চাপ এতটাই থাকে যে, তারা খোলামনে এগুলো আলোচনাও করতে পারে না!’’
এখন অবশ্য সময় বদলেছে। বিরাট কোহলী এখন খোলাখুলি বলতে পারেন, ২০১৪ সালে ইংল্যান্ডে সিরিজ হারের পর তিনি অবসাদের অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন। অলিম্পিক্সে সোনাজয়ী শ্যুটার অভিনব বিন্দ্রা এখন স্বীকার করতে পারেন, প্রতিযোগিতায় তিনি এতটাই মানসিক উদ্বেগে ভুগতেন, যে নিজের সেরাটা তুলে ধরতে পারতেন না। তারকা ক্রিকেটার হরমনপ্রীত কউর জোরগলায় বিসিসিআই-এর কাছে দাবি করতে পারেন মেয়েদের ক্রিকেট দলের সঙ্গে মনোবিদের রাখার।
ফুটবলার শিলটন পাল নিয়মিত মনোবিদের পরামর্শ নেন। সেটা খেলার ক্ষেত্রেই হোক বা ব্যক্তিগত জীবনে। ‘‘একজন খেলোয়াড়ের জন্য সব দিন সমান হয় না। যখন ডার্বি খেলতাম, আমার মনে হত আমি ১০০ শতাংশ তৈরি। কিন্তু তা-ও খেলার দিন কোনও অঘটন ঘটে যেতে পারে। নিজের খারাপগুলো ভুলে গিয়ে আবার চেষ্টা কর, এই কথাটা বলে দেওয়া যত সোজা, আদপে ততটা নয়। প্রশিক্ষণ তো অবশ্যই দরকার। কিন্তু পাশাপাশি খুব প্রয়োজন মনোবিদের। আমি শুধু খারাপ সময়েই মনোবিদের কাছে যেতাম না, ভাল সময়ও যেতাম। নিয়মিত যোগাযোগ না থাকলে কোনও সুফল পাওয়া যায় না,’’ বললেন শিল্টন।
ক্রীড়া মনোবিদ অনুশীলা অবশ্য মনে করছেন, ছোট থেকেই অ্যাথলিটদের খেলার বিভিন্ন স্কিলের পাশাপাশি মানসিক চাপ সামলানোর প্রশিক্ষণও দেওয়া উচিত। তা হলে সমস্যা গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা কমবে।’’
আমেরিকার মতো উন্নত দেশে কি সেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না? বিশ্বসেরা জিমন্যাস্ট সিমোনে বাইলস কি মনকে বশে রাখার শিক্ষা পাননি? তবুও তো তাঁর মন বশে থাকে না। তাঁকেও অলিম্পিক্সের মতো ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ থেকে নাম তুলে নিতে হয়। দেশবাসীর কটাক্ষের শিকার হতে হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy