শ্বেতীতে আতঙ্ক নয়। ছবি শাটারস্টক থেকে নেওয়া।
শরীরের 'ইমিউন সিস্টেম' বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনও এক অজ্ঞাত কারণে নিজের শরীরের বিভিন্ন কোষ ও কলাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে। এই জাতীয় রোগকে বলা হয় 'অটো ইমিউন ডিজিজ।'
শ্বেতী বা ত্বকের দুধ-সাদা দাগও এই ধরনের 'অটো ইমিউন ডিজিজ'। ভিটিলিগো বা শ্বেতী নিয়ে সমাজে এখনও নানা কুসংস্কার আছে। ত্বকের এই সাদা দাগের সঙ্গে কুষ্ঠর কোনও সম্পর্ক না থাকলেও সেই আতঙ্কে আক্রান্ত মানুষটি ও তাঁর পরিবার ভয়ানক ভেঙে পড়েন। 'ওয়ার্ল্ড একজিমা কাউন্সিল'-এর এ দেশের প্রতিনিধি ত্বক বিশেষজ্ঞ সন্দীপন ধর জানালেন, দেখতে অন্য রকম লাগা ছাড়া সেই অর্থে শ্বেতীর অন্য কোনও বিপজ্জনক দিক নেই।
ইউরোপ-আমেরিকার বাসিন্দারা শ্বেতীকে অসুখের পর্যায়েই ফেলেন না। শ্বেতীর দাগ মেলাতে 'ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট কভার' ব্যবহার করেন। আমাদের দেশের মানুষ অসুখ নিয়ে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন, অবসাদে ভোগেন। তাই রোগের শুরুতে চিকিৎসা করলে শ্বেতীর সাদা দাগ মুছে ফেলা কঠিন কাজ নয়।
আরও পড়ুন: রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়বে শরীরচর্চায়, এই ব্যায়ামগুলি রোজ করতেই হবে
সন্দীপন বাবু জানান, ত্বকের ভিতের থাকা মেলানোসাইট কোষ মেলানোজেনেসিস (অর্থাৎ ত্বকের রঞ্জক মেলানিন তৈরির প্রক্রিয়া) পদ্ধতিতে মেলানিন তৈরি করে। এই মেলানিনই ফর্সা বা কালো রঙের কারণ। বেশি মেলানিন হলে গায়ের রং কালো, মাঝামাঝি হলে বাদামি ঘেঁষা আর কম হলে ফর্সা। মেলানোজেনেসিস প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হলে ত্বক হয়ে ওঠে দুধ সাদা।
কেন ধ্বংস হয় মেলানোসাইট কোষ?
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিজেরাই মেলানোসাইট কোষকে ধ্বংস করে দেয় এই রোগে, বলেন কনসালট্যান্ট ত্বক বিশেষজ্ঞ পিয়ালি চট্টোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন: একাধিক রোগ থাকবে দূরে, কোন মাছ সপ্তাহে ক’দিন খাবেন, কতটা?
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার গোলযোগের জন্য রক্তে এক ধরনের শ্বেত কণিকা টি-লিম্ফোসাইট বেড়ে যায়। এরাই মেলানোসাইট কোষ ধ্বংস করে। ভিটিলিগো, শ্বেতী বা লিউকোডার্মা যে নামেই ডাকুন না কেন এই সমস্যার একটাই উপসর্গ ধবধবে সাদা দাগ। কোনও জ্বালা, ব্যথা বা চুলকানি কিছুই থাকে না, বললেন পিয়ালি চট্টোপাধ্যায়।
শ্বেতীর চিকিৎসায় অতি বেগুনি রশ্মি দিয়ে ফোটো থেরাপি ব্যবহার করা হয় অনেক সময়। ফাইল ছবি।
অটোইমিউন ডিজিজ ছাড়াও নানা কারণে ত্বকে সাদা দাগ হতে পারে। আলতা, সিঁদুর বা প্রসাধনে ব্যবহৃত রাসায়নিকের প্রভাবে অথবা প্লাস্টিকের চটি দীর্ঘ দিন পরলে অনেকের ত্বকে সাদা দাগ হতে দেখা যায়। চিকিৎসার পরিভাষায় এর নাম কেমিক্যাল লিউকোডার্মা। আবার অনেক দিন ধরে জোরে বেল্ট বেঁধে পোশাক পরলেও কোমরে এক ধরনের সাদা দাগ হয়। যথাযথ চিকিৎসায় এ সবই সেরে যায়। পিয়ালি জানালেন যে অনেকেই নানা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে শ্বেতীর চিকিৎসা করাতে ভয় পান। এই ধরনের ভাবনার কোনও ভিত্তি নেই। ত্বকের বর্ণের অস্বাভাবিকতা ছাড়া এই অসুখের অন্য কোন উপসর্গ নেই। এই কারণে বিদেশে শ্বেতীকে রোগ বলেই মনে করা হয় না।
শ্বেতীর থেকে মুক্তি চাইলে দেরি না করে ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় ওষুধের সাহায্যে বা ন্যারো ব্যান্ড আল্ট্রাভায়োলেট (এনবি-ইউভি) ফোটোথেরাপিতে অনেক সময়েই শ্বেতী সেরে যায়। তবে, সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকা অনেকদিনের শ্বেতীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা করে খুব ভাল ফল পাওয়া যায় না। শ্বেতী প্রাথমিক পর্যায়ে আগ্রাসী ভাবে দেহে ছড়াতে থাকলেও খুব বেশি কিছু করা যায় না।
পিয়ালি জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে শ্বেতীর চিকিৎসা করতে হয়। অল্প সমস্যা হলে ওষুধের সাহায্যে এই রোগের বিস্তার কমিয়ে ত্বকের স্বাভাবিক রং ফিরিয়ে আনা যায়। ন্যারো ব্যান্ড অতি বেগুনি ফোটো থেরাপি (এনবি-ইউভি ফোটোথেরাপি) প্রথমেই চিকিৎসা আরম্ভ করলে অনেক সময়েই ভাল ফল পাওয়া যায় বলে ভরসা দিলেন সন্দীপন ধর।
আরও পড়ুন: একাধিক সমস্যার অব্যর্থ দাওয়াই, বাজিমাত এই ‘অমৃত’ ফলে
২৮০-৩২০ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘের সাধারণ অতি বেগুনি রশ্মিগুচ্ছ নয়, এই ফোটোথেরাপিতে ব্যবহার করা হয় ৩১১-৩১২ ন্যানোমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘের বিশেষ অতি বেগুনি রশ্মি। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই রশ্মিগুচ্ছের নামে হল ন্যারো-ব্যান্ড অতিবেগুনি রশ্মি। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এক মাত্র এই আলোরই আছে ঔষধি গুণ। তাছাড়া সাধারণ অতি বেগুনি রশ্মির মতো এর কোনও ক্ষতিকর দিকও নেই। এনবি-ইউভি ফোটোথেরাপিতে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক বা চিকিৎসা কর্মীরা কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড এনবি-ইউভি ল্যাম্প থেকে খুব সাবধানে নির্দিষ্ট নিয়মে সামান্য সময়ের জন্য শ্বেতীর সাদা দাগের উপরে এনবি-ইউভি রশ্মি ফেলেন। অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে অতি জটিল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অতি ধীরে ধীরে আবার মেলানিন তৈরী হয়, ত্বকে স্বাভাবিক বর্ণ ফিরে আসে। শ্বেতীর যে কোনও চিকিৎসার মতোই এই ফোটো থেরাপিতেও ধৈর্য ধরতে হয়।
আরও পড়ুন: কোভিডের উপসর্গে জ্বরের দোসর হাত-পা ব্যথা? কী খেয়াল রাখতেই হবে?
সন্দীপন বাবু বলেন, ‘‘চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা শ্বেতীকে প্রধানত দুটি ভাগে ভাগ করেন-সেগমেন্টাল ও নন সেগমেন্টাল। নন সেগমেন্টাল শ্বেতী কখনও দ্রুত আবার কখনও ধীরে ধীরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ত্বকের একাধিক স্থানে আবদ্ধ সেগমেন্টাল শ্বেতীর বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেলে ও প্রায় এক বছর আর না বাড়লে পুরনো শ্বেতীর জন্য চিকিৎসা শুরু হয়।’’
আরও পড়ুন: নাক ডাকার সমস্যায় নাজেহাল? রেহাই পেতে এই বিষয়গুলি জেনে রাখুন
আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘মাইক্রো পিগমেন্টেশন’, ‘স্কিন গ্রাফটিং’ (চাম়ড়া কেটে বসানো) বা ‘ব্লিস্টার গ্রাফটিং-এর মতো পদ্ধতির সাহায্যে সাদা ত্বককে আবার স্বাভাবিক করে তোলা যায়। এ দিকে অত্যাধুনিক ‘মেলানোসাইট ট্রান্সফার’ পদ্ধতিতে ত্বকের স্বাভাবিক অংশ থেকে মেলানোসাইট নিয়ে সাদা অংশে ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়, ক্রমশ ত্বক পুরনো রূপ ফিরে পায়। করোনার অতিমারির সময়ে শ্বেতীর চিকিৎসায় কোনও বাধা নেই। শ্বেতীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত অতি বেগুনি রশ্মি কোভিড-১৯ ভাইরাসকে ধ্বংস করে ফেলে। তাই শ্বেতী ধরা পড়লেই দ্রুত চিকিৎসা করাতে হবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy