নিজের পার্লারে নবনীতা সাহা। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
মৃত্যু কোনও খাদ হলে, সেই খাদের কিনারা থেকে ফিরে এসেছেন তিনি। তিনি, নবনীতা সাহা। কলকাতা পুরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বাপি ঘোষের মেয়ে।
নবনীতা বলছেন, ‘‘যা ঘটে গিয়েছে, ঘটে গিয়েছে। তাকে তো পাল্টাতে পারব না। সেই ক্ষতও সারা জীবন ভিতরে থাকবে জানি। কিন্তু তা-ও জীবনে ফেরার চেষ্টা করছি।’’
২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল। চার বছর চার মাসে আগে ওই দিনে নবনীতার জীবনটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল। উদ্যাপন নিমেষে শোকে পরিণত হয়েছিল পথ-দুর্ঘটনায়। হারিয়েছিলেন স্বামী প্রীতম, একমাত্র সন্তান ছ’বছরের শিবম ও পরে মা মধুমিতা ঘোষকে। সকলে মধুমিতাদেবীর জন্মদিন পালন করতে গিয়েছিলেন কোলাঘাটের এক ধাবায়। ফেরার পথে উলুবেড়িয়ায় ঘটে দুর্ঘটনা।
একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছিল নবনীতার। সারা শরীরে ২৬৪টি সেলাই পড়েছিল। হাতে, পায়ে প্লেট বসাতে হয়েছিল। তবে শারীরিক সমস্ত যন্ত্রণা ছাপিয়ে যা পড়ে ছিল, যা পড়ে রয়েছে, তা হল মানসিক ক্ষত। নিজের অস্তিত্বকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়া সেই ক্ষতের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে গিয়েছিলেন নবনীতা। ফিরতে চেয়েছেন স্বাভাবিক জীবনে।
ধীরে হলেও সেই চেষ্টার ফল মিলেছে। পারিবারিক ব্যবসা বিউটি পার্লারের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন নবনীতা। তবে এর পাশাপাশি তাঁর ইচ্ছে নিজের কিছু করার। ‘‘নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করতে চাই। কী করব, এখনও ঠিক করতে পারিনি। তবে এমন কিছু করতে চাই, যেখানে গোটা দিন ব্যস্ত থাকা যায়। নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারলে পুরনো স্মৃতির যন্ত্রণা অনেকটা কমে। স্বাভাবিক জীবনে ফেরাটা তুলনামূলক ভাবে সহজ হয়।’’— বলছেন নবনীতা।
তবে ফেরার রাস্তা কখনওই মসৃণ হয় না। এ ক্ষেত্রেও হয়নি। হোঁচট খেয়েছেন, পড়ে গিয়েছেন। মনের পুরনো ক্ষতে ফের আঘাত লেগেছে। সেই সময়গুলোয় তিনি মনোবিদের সাহায্য নিয়েছেন। নবনীতার কথায়, ‘‘আসলে অনেক মুহূর্ত কেমন যেন মনের মধ্যে চেপে বসে। দম নেওয়া যায় না। মনে হয়, এখনও সেই সমস্ত মুহূর্ত ভীষণ ভাবে বেঁচে রয়েছে।’’
আর তাই হয়তো প্রতি বছরই শিবমের জন্মদিন পালন করেছেন নবনীতা। আর পাঁচ দিন পরে, আগামী ২৫ অগস্ট শিবমের জন্মদিন। এই দিনগুলোয় নবনীতা গরিব, দুঃস্থ বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটান। শিবমের পছন্দের জিনিস তাদের হাতে তুলে দেন। জন্মদিনের কেক-ও কাটে তারাই। আর নবনীতা শুধু দু’চোখ ভরে তাদের মধ্যে শিবমকে খুঁজে চলেন।
তাঁর মতোই কোনও না কোনও দুঃসহ স্মৃতির শিকার যাঁরা, তাঁরা কী ভাবে জীবনে ফিরতে পারবেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে নবনীতা বলছেন, ‘‘নিজের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা— এগুলো সহ্যের অভ্যাস তৈরি করতে হবে। কান্না পেলেই অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে হবে, তা নয়। তা হলে সব সময়েই অন্যের সাহায্য লাগবে। নিজে শক্ত মাটিতে দাঁড়ানো যাবে না।’’
আসলে শোক মানুষকে মূহ্যমান করে, নিঃস্ব করে। শোক মানুষকে পরিণতও করে। চার বছর চার মাস আগের দুর্ঘটনায় শোকের প্রাথমিক অভিঘাত নবনীতাকে নিঃস্ব করেছিল। তবে সেই অভিঘাত সামলে উঠে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
তাঁর বিশ্বাস, মৃত্যু যা কিছু কেড়েছে তাঁর কাছ থেকে, পুরোটা না হলেও জীবন তার অনেকটাই পুষিয়ে দেবে। ‘‘জীবনের উপরে ভরসা আছে আমার। কারণ, জানি এই ভরসাটুকুই সব।’’
সে কারণেই হয়তো ‘ভরসা’টুকু সম্বল করেই ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়েও মাথা তুলে উঠে দাঁড়ায়, সর্বস্বান্ত হয়েও একটা-একটা করে জীবনের পাথর গাঁথে, ঝড়ে ভেঙে পড়া, বন্যায় ভেসে যাওয়া ঘরবাড়ির স্মৃতি ভুলে নতুন করে বসত গড়ে মানুষ। নবনীতাও জানেন, ওই ‘ভরসা’টুকুই সব। আসলে ওই ‘ভরসা’টুকুই জীবন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy