ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক দূরত্বের নিয়মবাঁধা এই সময়ে এক ছাদের তলায় সপরিবার থাকা বা একা থাকা... দুইয়ের সমস্যাই বিস্তর।
এ কী হল... কেন হল...
• একা থাকাটা বাইরে থেকে দেখলে আশীর্বাদ মনে হতে পারে। একার ঘর, একাই একটু ফুটিয়ে খাওয়া, বাজারঘাট আর গা-ঘেঁষা আড্ডা সামলে চলা, ব্যস। কোভিড থেকে নিশ্চিন্তি! তলিয়ে দেখলে, ব্যাপার অত সোজাসরল নয়। সেই যে রবীন্দ্রনাথের গল্পে নিঃসঙ্গ প্রবাসে জ্বরে-পড়া পোস্টমাস্টার নিকটজনের সঙ্গ-স্পর্শের জন্য আকুল হয়েছিলেন, এই করোনাকালে একা-থাকা মানুষটির তেমন আকুলতা সঙ্গত বইকি। এমনি সময়ে কুটোটি নাড়তে স্বয়ং ভরসা, এই মহারোগের রাজত্বে নিজের শারীরিক ও মানসিক ভাল থাকা নিশ্চিত করতে তো কাজ আরও বেশি। এক ছাদের তলায় আরও মানুষ মানে আশ্বাসের হাত, ভরসার কাঁধটুকু আছে। করোনা-আবহে একাকীরা কিন্তু একটু বেশিই ‘ভালনারেব্ল’।
• কেউ কেউ একা নন, তবে প্রায়-একা। প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা দু’জন মাত্র বাসিন্দা, এমন বাড়ি বা ফ্ল্যাট প্রত্যেক পাড়ায় অগুনতি। ছেলেমেয়ে পড়াশোনা বা চাকরিসূত্রে আন-শহরে, ভিনদেশে। দূর-প্রবাসী সন্তানের বাবা-মায়েরা এমনিতেই ভিতরে ভিতরে ফাঁকা হয়ে থাকেন অনেকটা, সেই শূন্যতার বুকে করোনা যেন হাতুড়ি পিটছে এখন। ক্রমশ বেড়ে চলা শরীরের বয়স, মনের অবসাদে কিছুটা প্রলেপ পড়ে সামাজিকতায়, করোনা সেটুকুও কেড়েছে। উপরন্তু যোগ হয়েছে অজানা ভয়। তাঁদের কিছু হলে কে দেখবে, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কে... প্রশ্নগুলো আজ প্রকট।
• এক ছাদের নীচে সকলে থাকলেই কি শান্তি? দেখা যাচ্ছে, তিন প্রজন্মের তিন রকম চ্যালেঞ্জ। সবচেয়ে বেশি বয়সি আর সবচেয়ে কমবয়সি, দুই ধরনের সদস্যই খিটখিটে, বিরক্ত। দাদু ও নাতি বা নাতনি, দু’পক্ষেরই বদ্ধমূল ধারণা, ওদের স্রেফ আটকে রাখা হচ্ছে। এদের শরীর-স্বাস্থ্য, খাওয়াদাওয়া, ওষুধপত্তর সামলে যে ছেলেটি বা মেয়েটি নিয়মিত অফিসে যাচ্ছে, তাদেরও গুচ্ছের চিন্তা। বাবা বিকেলে বেরিয়ে চায়ের দোকানে চলে গেলেন না তো? একে একে সব ফুরোচ্ছে, শিশুটির মন ভোলাতে এর পর কোন জিনিসটা ভাবা যায়?
• বাড়ি বসে ওয়র্ক ফ্রম হোম মানেই কিন্তু মুশকিল আসান নয়। বাচ্চার অনলাইন বা অ্যাক্টিভিটি ক্লাস শেষ হতে না হতে মা বা বাবাকে বসতে হচ্ছে অফিসের কাজ নিয়ে। তারই মধ্যে বাজার হল কি না, সেগুলি স্যানিটাইজ় করা হল কি না, কী রান্না হবে তার খোঁজ। গৃহসহায়িকা এলেও ভাবনা, না এলে তো আরও। করোনা-পূর্ব পৃথিবীতে বাড়ির বয়স্ক মানুষটি হয়তো বাইরে বেরোতেন। রাস্তায়, পাড়ায়, চা-দোকানে, আবাসনের নীচে সমমনস্কতার দেখা মিলত রোজ। সেই মনের খোরাকও আজ নেই।
• করোনা-সতর্কতায় সামাজিক দূরত্ব বজায়ের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ‘সোশ্যাল স্টিগমা’ কাটানো প্রয়োজন আগে। নিজের বাড়ি, পাড়া, এলাকাতেই রোগাক্রান্ত মানুষটি বা তার পরিবারের সদস্যরা পাড়াপড়শির তোপের মুখে পড়েছেন, সে উদাহরণও কম নয়। কেউ কোভিড-পজ়িটিভ হলে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করা বা তাকে প্রায় মুলুকছাড়া করার প্রবণতা বুঝিয়ে দিচ্ছে ‘বন্ধু’ বা ‘প্রতিবেশী’ শব্দের অর্থ। এ সময়ে পরিবারই কিন্তু সবচেয়ে বড় শক্তি, যদি বেঁধে বেঁধে থাকে পরিজন। কী করে সমস্যা জয় করে এ সময়ে স্বস্তির পরিবেশ বজায় রাখবেন বাড়িতে, জেনে নিন—
ভাল আছি, ভাল থেকো
• একা থাকলে আপনার চিন্তাধারার গড়নের সঙ্গে মানানসই কাজ খুঁজে নিন— রোজকার দরকারি কাজের পাশাপাশি। চেনা শখগুলোরও ক্লান্তি আছে, একটু চেষ্টাতেই সেই ক্লান্তি মিটবে। সাহিত্য ভালবাসেন? নিজেকে ক্রিয়েটিভ চ্যালেঞ্জ দিন, শেক্সপিয়রের সনেট বা জীবনানন্দের কবিতা ধরে ধরে অনুবাদ করলে কেমন হয়? একা-থাকা এক বন্ধু জানালেন, লকডাউনে রোজ একটু-একটু করে পড়ে এখন গীতার প্রায় পুরোটাই ওঁর কণ্ঠস্থ! পরের প্রজেক্ট হিসেবে ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ ভাবছেন! ছবি আঁকা, গান, এমনকি ছেলেবেলার পুরনো অভ্যেসে ফিরে গিয়ে রোজ এক পাতা হাতের লেখা লিখলেও মন খুশিয়াল হতে পারে। পরখ করেই দেখুন!
• আট ও আশি, দু’জনকে সামলানো অসম্ভব নয়। বয়স্ক মানুষটির একমাত্র দাওয়াই টিভি, শিশুটির স্মার্টফোন— ভাবলে মুশকিল। দুই প্রজন্মকে মিলিয়ে দিতে পারেন। ওঁর কাগজ পড়া আর এর হোমওয়র্ক, এর অরিগ্যামির সঙ্গে ওঁর গল্প বলার আর্টের মিলমিশ। আসলে তো দু’জনেরই দরকার ‘ইনভল্ভমেন্ট’। নিজের রান্নাঘরের কাজে খুদেটিকেও হাত লাগাতে বলতে পারেন, মহানন্দে সিদ্ধ ডিমের খোসা ছাড়িয়ে দেবে, শেখালে সময়মতো দিদুনের ওষুধ খাইয়ে দেবে ঠিক! ছাদে বা উঠোনে টব মাটি চারা পেলে দু’জনেই হয়তো মেতে উঠবে সৃষ্টিতে। চায়ের টেবিল থেকে রাতের খাবার, বসুন এক সঙ্গে। ছাদে (একটা ঘরও বেছে নিতে পারেন) হয়ে যাক ঘরোয়া বাইশে শ্রাবণ বা স্বাধীনতা দিবসের উদ্যাপন। কে গান গাইবে, কে বক্তৃতা দেবে, কার কবিতাপাঠ, রবিঠাকুরের ছবি থেকে জাতীয় পতাকার বন্দোবস্ত— ভাবতে দিন জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠকে। ওঁরা তাতে ভাল থাকবেন, আপনিও।
• খেয়াল রাখতে হবে পড়শিরও। একদা কলকাতার নাগরিক অভিজ্ঞান ছিল তার ‘পাড়া-কালচার’, এ জানালা ও জানালা, দুই ছাদের অনর্গল গতায়াত। ফিরিয়ে আনুন সেই রান্নাঘরের কপাট খুলে উল্টো দিকের বাড়িকে শুধোনো: ‘‘বেড়ে গন্ধ তো, কী ফোড়ন দিয়েছ?’’ কারও দু’দিন ধরে জ্বর শুনেই দরজা আঁটবেন না। ওতে মনের দরজায় অদৃশ্য খিল পড়ে।
এ সময়টা বরং পাশে থাকার। সে পরিবারই হোক বা প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধব, সামাজিক দূরত্ব যেন মনের দূরত্ব না বাড়ায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy