প্রশ্ন: শিশুদের মধ্যে উদ্বিগ্নতার লক্ষণ কি স্বাভাবিক?
উত্তর: বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মা বাচ্চার কথা শুনতে চান না। এই ধরনের আচরণকে বদমায়েসি বলে থাকেন। সেটা ঠিক নয়। এটা এক ধরনের অসুখ। ভবিষ্যতে তা বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
প্রশ্ন: এখানে বদমায়েশি বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
উত্তর: যেমন, বাচ্চা স্কুলে যেতে চায় না। এটা অনেকে বদমায়েসি বলে ভাবেন। কিন্তু সে যে স্কুলে যেতে ভয় পাচ্ছে, সেটা বদমায়েশি নাও হতে পারে। এক জায়গায় বসে থাকতে পারছে না, ছটফট করছে। হয়তো কারও গায়ে থুতু দিচ্ছে। এগুলি কিন্তু বদমায়েশি নয়। প্রাথমিক ভাবে এগুলি বদমায়েশি মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলি উপেক্ষা করা উচিত নয়। পরে এগুলিই কিন্তু বড় সমস্যা ডেকে আনতে পারে।
প্রশ্ন: পরিবারের লোকজনের কোনও প্রভাব?
উত্তর: অনেক সময় দেখা যায়, ঘুমের মাঝে বাচ্চা আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করেছে। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-কাকার ভয়ে তারা এমন করে থাকে। অনেকের ঘুম ঠিক হয় না। ভোর চারটেয় উঠে হয়তো হাঁটতে শুরু করে দেয়। অতীত ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, বাবা-মা তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে মানুষ হয়েছে দাদু-দিদার কাছে। প্রথমে দাদু-দিদার কাছে আসতে চায়নি। পরে বাবা-মায়ের থেকে দূরত্ব তৈরি হয়। মানতে শুরু করে। ভুলে যায়। কিন্তু বাবা-মায়ের উপরে যে রাগটা চাপা থাকে তা পরে বড় আকার নেয়। সেই মুহূর্তে সে বাবা-মাকে কিছু করতে পারে না। বয়স বাড়লে রাগ প্রকাশ করে থাকে।
প্রশ্ন: অনেক বাচ্চা বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব করে থাকে। এটা কি স্বাভাবিক?
উত্তর: বিছানায় প্রস্রাব করা ৩-৪ বছরের বাচ্চাদের জন্য অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অনেক সময় তার পরেও হয়ে যায়। এমনকী বড় হলেও। সে জন্য বিছানায় ব্যবস্থা রাখতে হয়। এটা সামাজিক ভাবে লজ্জ্বার। কোনও একটা আতঙ্ক থেকে এটা হয়ে থাকতে পারে।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের বকাবকি করলে কোনও প্রভাব পড়ে?
উত্তর: বাবা-মা বাচ্চাদের নানা ভাবে ‘অপমান’ করে থাকেন। বাবা-মা হয়তো অন্যদের সঙ্গে গল্প করছেন। তখন বাচ্চা এলে কঠিন ভাবে তাকে বলা হল, ‘তুমি এখানে আসবে না। চলে যাও।’ এতে সে অপমানিত বোধ করতে পারে। অন্য ভাবে, বুঝিয়ে বললে সে ‘অপমানিত’ বোধ করে না। কিন্তু আমরা তা করি না। ভাবি, সে বাচ্চা। কিছু বোঝে না। বুদ্ধির বিকাশ হয়নি। কিন্তু তা নয়। বড়দের মতোই তার মনে প্রভাব পড়ে। তফাৎ হল, বড়রা ‘রিঅ্যাক্ট’ করে, ছোটরা সেটা মনের ভিতর রেখে দেয়। পরে তার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়।
প্রশ্ন: এর থেকে ভবিষ্যতে কী হতে পারে?
উত্তর: এর ফলে, ভবিষ্যতে তার মধ্যে ‘অপোজ’ করার প্রবণতা তৈরি হবে। তাকে যা বলা হবে তা সে ‘অপোজ’, বিরোধিতা করার চেষ্টা করবে। এই সমস্যা দিন দিন বাড়বে।
প্রশ্ন: বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক কতটা প্রভাব ফেলে?
উত্তর: বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক শিশুর বেড়ে ওঠার উপরে প্রভাব বিস্তার করে। বাবা-মায়ের মধ্যে সম্পর্ক ভালো নয়। মা হয়তো বাবাকে হয়তো দমিয়ে রাখেন। সন্তান মেয়ে হলে সেও ভবিষ্যতে তার নিজের স্বামীর উপরে এমন ব্যবহার করতে চাইবে। বা হয়তো, বাবা মদ খেয়ে মাকে মারধোর করেন। সন্তান ছেলে হলে সে এটা দেখতে দেখতে পরে নিজের স্ত্রী বা বাচ্চার উপরে এমনটা করে থাকতে পারে।
প্রশ্ন: অনেক সময় দেখা যায়, বাচ্চারা বড়দের মতো কথাবার্তা বলছে। এটা কেন হয়?
উত্তর: অনেক সময়ে বাবা-মা এটা থেকে আনন্দ পান, গুরুত্ব দেন না। ভাবেন, বাচ্চা তো বেশ ম্যাচিওর হয়ে গিয়েছে! মোটেও তা নয়। আসলে তার মধ্যে লোকজনের সঙ্গে মেলামেশার অনিচ্ছা তৈরি হয়েছে। যেটা আজকের দিনে অনেক বাচ্চার মধ্যে দেখা যায়। বাচ্চাদের একটা বড় অংশ স্মার্টফোন, কম্পিউটার, সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে মেতে থাকে। বাহ্যিক জগতের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ থাকে না। নিজের জগতে থাকে। বাবা-মা হয়তো ভাবছেন, ভালো তো। কাউকে বিরক্ত করছে না। এতে কিন্তু একসময় সেই বাচ্চারা যন্ত্রের মতো হয়ে ওঠে। রোবটও বলা যেতে পারে! দেখা যাবে, কোনও কিছুতে ‘রিঅ্যাকশন’, প্রতিক্রিয়া নেই। ভালো, খারাপ— কিছু নিয়েই যেন হেলদোল নেই।
প্রশ্ন: অনেক সময়ে বাচ্চারা স্কুলে বুলি, র্যাগিংয়ের শিকার হয়। এ ক্ষেত্রে কী করতে হবে?
উত্তর: এ ধরনের ঘটনা ঘটলে বাচ্চাদের আচরণে পরিবর্তন আসবে। অভিভাবকদের এটা লক্ষ রাখতে হবে। বিশেষ করে মায়েদের এই পরিবর্তন বুঝতে হবে। প্রথম পর্যায়ের কাজ হল বাচ্চার সঙ্গে কথা বলে, গল্পের ছলে সমস্যাটা জানা। সমস্যাটি যদি গুরুতর কিছু না হয় তবে বাচ্চাকে বুঝিয়ে সমস্যার সমাধান করতে হবে। আর বিষয়টি গুরুতর হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
প্রশ্ন: মুক্তির উপায় কী?
উত্তর: বাচ্চাদের উপরে অনেক সময়ে অযথা চাপ দেওয়া হয়। সকাল ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত শুধু পড়াশোনা করতে বাধ্য করা হয়। সেটা মোটেও ঠিক নয়। বাচ্চা কতটা পারবে তা বাবা-মায়ের ভেবে দেখা উচিত। মনে রাখতে হবে, সব শিশু একরকম নয়। তাই প্রতিবেশীর বাচ্চা যা করছে সেটার সঙ্গে তুলনায় যাওয়া উচিত নয়। এর ফলে হীনমন্যতা গড়ে উঠতে পারে। তাই তুলনা করা ঠিক নয়। বড় হলে তার মধ্যে এই হীনমন্যতার বোধটি সংক্রামিত হয়। ‘ও পারল, আমি পারলাম না!’— অনেক সময় এমন প্রবণতা থেকে আত্মঘাতী হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
প্রশ্ন: এ ক্ষেত্রে কী করতে হবে?
উত্তর: বাচ্চারা অনেক কিছু চেয়ে থাকে। অনেকেই সঙ্গে সঙ্গে তা দিয়ে দেন। বাবা-মা হয়তো কর্মক্ষেত্রে ব্যস্ত থাকেন। সন্তানকে সময় দিতে পারেন না। সেটা পুষিয়ে দিতে সন্তান যা চায় সেটা দিয়ে দেন। কিন্তু এর ফলে একটা জিনিস পেতে গেলে কী করতে হবে, সেটা পাওয়া কত কঠিন তা সেই শিশু জানলই না। সে বুঝল চাইলেই পাওয়া যায়। তার মনে সেই ধারণা তৈরি হয়ে যায়। বড় হয়েও এই মানসিকতা বদলায় না। তখন না পাওয়ার জন্য হিংস্র প্রবণতা আসতে পারে। আবার না পাওয়ার জন্য ডিপ্রেসন হতে পারে। এর শুরু কিন্তু শিশু বয়সেই। বাবা-মায়ের উচিত, বাচ্চাকে ঠিকমতো সময় দেওয়া। ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে যাওয়া। বড় হতে হতে সে বুঝবে যে আমাকেও এমন ব্যবহার করতে হবে। ভবিষ্যতে সে এমন আচরণ থেকে বিরত হবে।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের কী ভাবে এ সব বোঝানো যাবে?
উত্তর: মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের ‘মাইন্ডসেট’ বড়দের থেকে একেবারে আলাদা। বড়দের মতো বিচারবুদ্ধি থাকে না তাদের। বড়রা অনেক বেশি বেশি করে বাচ্চাদের বোঝানোর পথ নেন। সেটা করবেন না। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা বেশি বেশি করে বোঝাবেন না। অল্প কথায় বোঝাবেন। কোনও কিছু এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। যেমন, ‘সেক্স’ নিয়ে আলোচনা এড়িয়ে চলতে চান অনেকে। এর ফলে ঠিক জ্ঞান তৈরি হয় না। এ দিকে আগ্রহ বাড়ে। একটু বড় বয়সের বাচ্চা নিষিদ্ধ ছবি দেখছে, বন্ধুদের সঙ্গে নানা কার্যকলাপে জড়িয়ে যাচ্ছে। বাবা-মায়েরা যদি মনে করেন, এটা সাধারণ ব্যাপার। পরে মিটে যাবে। বরং আলোচনা করলে বিগড়ে যাবে। তা হলে ভুল করছেন। ভবিষ্যতে বেশি ক্ষতি হতে পারে।
প্রশ্ন: বাচ্চাদের ‘গুড টাচ’, ‘ব্যাড টাচ’ সম্পর্কে কি সচেতন করা জরুরি?
উত্তর: বাচ্চাদের কথা মন দিয়ে শুনতে হবে। তারা কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ তা বুঝতে পারে না। তাই যাই ঘটুক বাড়িতে যেন বলে। গল্পের মাধ্যমে জেনে নিতে হবে। সাধারণত, মা বাচ্চার বেশি কাছের। তাই মা এর দায়িত্ব এক্ষেত্রে বেশি। অনেক সময় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা এমন কোনও মন্তব্য করেন যা হয়তো ঠিক নয়। বাবা-মা তাঁদের সঙ্গে অশান্তি এড়াতে চান। তাই স্কুলে গিয়ে তা বলতে চান না। আবার বার বার সেটা করাও সম্ভব নয়। তাই বাচ্চাদের মনে কতটা গ্রহণ করবে, কতটা বর্জন করবে সেই ধারণা তৈরি করে দেওয়া জরুরি। কম বয়েস যদি এমন করা যায় তা হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে না। অনেক সময়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা মানসিক ভাবে সুস্থ থাকেন না। বাচ্চার উপরে তাঁরা অকারণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
প্রশ্ন: আর কোনও পরামর্শ?
উত্তর: ‘ওভারপারফেকসনিস্ট’ বানাতে গেলে চলবে না। নিখুঁত ভাবে হয়তো একটি বাচ্চা সব কাজ করছে। আমরা ভাবছি, বেশ ভাল। তা নয়। কম বয়সে একটা বাচ্চা ১০-১২ ঘণ্টা পড়ছে। তার ভবিষ্যৎ কিন্তু উজ্জ্বল নয়। কারণ, দিনের ঘণ্টা সংখ্যা তো আর বাড়ে না। কিন্তু সিলেবাস বাড়ে। ফলে একসময় পর্যাপ্ত সময় মিলবে না। ছোট থেকে হয়তো ভালো ফল করছে কেউ। একাদশে-দ্বাদশে গিয়ে দেখা গেল ভাল হল না। সবাই যদি ভাবেন, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিন বানাবেন, সেটা হয় না। অবাস্তব চাহিদা বর্জন করতে হবে।
প্রশ্ন: বাবা-মা নিজেদের কী ভাবে নিয়ন্ত্রণ করবেন?
উত্তর: বাস্তবকে মানতে হবে। ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যত বাবা-মায়ের মতো হবে না। বাবা-মার ছোটবেলা কেমন কেটেছিল তা মনে রাখা জরুরি। ছোটবেলায় বাবা-মাকেও অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বাচ্চাকে সহজ করে তা বোঝাতে হবে। যাতে তেমন পরিস্থিতিতে এলে বাচ্চারা মোকাবিলা করতে পারে।
প্রশ্ন: ছেলে-মেয়ের পরীক্ষা। দেখা যায় অনেক সময়ে চিন্তায় বাবা-মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এটা কী ভাবে কাটিয়ে উঠবেন?
উত্তর: এখন অধিকাংশ পরিবারে একমাত্র সন্তান। এটা বাজে প্রবণতা। এতে ‘শেয়ার’ করার মানসিকতা গড়ে ওঠে না। আগে পরিবারে ভাগ করে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল। তা আমরা হারিয়ে ফেলছি। আমি একা, পুরোটা চাই। এই ধারণা ভবিষ্যতে বিপদ ডেকে আনে। যেমন, সম্পত্তি। তা তো অগাধ হয় না। সে ক্ষেত্রে ভাগ করে নিতেই হয়। এটা ছোটবেলা থেকে না শিখলে বড় হয়ে মানতে কষ্ট হয়।
প্রশ্ন: সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব কী ভাবে পড়ছে?
উত্তর: এখন ঘরের পাশের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে হাজার মাইল দূরের সঙ্গে যোগাযোগ। কোনও বাস্তবতা নেই। এর ফলে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন কেউ কেউ। ছোট থেকেই এটা বুঝতে হবে। তা না হলে বড় হয়ে সমস্যা বাড়বে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy