—প্রতীকী চিত্র।
আমাদের সমাজে একটা ধারণা আছে, সন্তান হল বন্ধনের মতো। বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী’র জীবনে সন্তানের আগমন সংসারে পূর্ণতা আনে। কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। সত্যিই ফুটফুটে একটা খুদের আবির্ভাব অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে। সংসারিক জীবনের যে ফাটলগুলো হয়তো সকলের আড়ালে বেড়েই চলছিল, সেগুলোতে কিছু দিনের জন্য হলেও একটা প্রলেপ পড়ে। সেই জন্যই একটা সন্তান পাওয়ার জন্য কত কিছুই না করে থাকেন সন্তানহীন দম্পতি।
এটা যেমন একটা দিক, ঠিক এর অন্য আর একটা দিকও আছে। সন্তানের জন্ম না দেওয়ার ইচ্ছে। কোনও শারীরিক-আর্থিক প্রতিবন্ধকতা থেকে নয়, দম্পতি এখানে স্বেচ্ছায় সন্তানহীন থাকতে চান। গবেষণা দেখিয়েছে, বিভিন্ন দেশে স্বেচ্ছায় সন্তানহীন থাকার প্রবণতা বাড়ছে। ২০০৮ সালে আমেরিকার এক সমীক্ষা দেখিয়েছিল, সে দেশে ৪৪ বছরের নীচে থাকা মহিলাদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশ বেশি। ভারতীয় সমাজে এখনও হয়তো এঁদের সংখ্যা খুব চোখের পড়ার মতো নয়। কিন্তু এটাও ঠিক, শহুরে, মূলত শিক্ষিত, কেরিয়ার-মনস্কদের মধ্যে অনেকেই সন্তানহীন থাকতে চাইছেন। তাঁরা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছে বিয়ে, তার পর একটি বা দু’টি সন্তান— এই প্রচলিত ধ্যানধারণা থেকে নিজেদের মুক্ত করেছেন। এঁদের বলা হচ্ছে ‘ডিঙ্ক’, অর্থাৎ ‘ডুয়াল ইনকাম নো কিড’।
কেন এই মানসিকতা, সমাজের উপর এই মানসিকতার প্রভাব আগামী দিনে কী হতে চলেছে, এ সব নিয়েই কথা বললেন বিশেষজ্ঞরা।
না-চাওয়া কেন
স্বাধীন ভাবে কোনও পিছুটান ছাড়াই বাঁচতে চাওয়া, মাতৃত্বের তীব্র আকাঙ্ক্ষার অনুপস্থিতি, আর্থিক অনিশ্চয়তার ভয়, ‘এই বিশ্বে ক্রমশ বাড়তে থাকা জনসংখ্যাকে আর না-বাড়ানো’-র মতো তত্ত্বে বিশ্বাস প্রভৃতি হরেক কারণ লুকিয়ে থাকে এই সিদ্ধান্তের পিছনে। ব্যক্তিবিশেষে কারণগুলিও বদলে যায়। পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ যেমন বলছেন, এই প্রবণতার পিছনে লুকিয়ে থাকা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তিন মানসিকতার কথা। “যেমন, অনেকেই আছেন যাঁদের শৈশবে অনেক না পাওয়ার দুঃখ আছে। হয়তো কারও মা-বাবা দু’জনেই চাকরি করতেন বলে তাঁরা সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারেননি। ফলে, শিশুকাল জুড়ে তাঁদের একাকিত্ব কুরে কুরে খেয়েছে, রাগ-অভিমান জানানোর মতো কাউকে পাশে পাননি। আবার অনেকে হয়তো গার্হস্থ্য অশান্তি, হিংসা দেখে বড় হয়েছেন। ফলে, পরবর্তী জীবনেও এই ট্রমাগুলো থেকে তাঁরা বেরোতে পারেনি। তাই তাঁরা চান না তাঁদের সেই একা থাকার যন্ত্রণা অথবা গার্হস্থ্য হিংসার ছবি প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা তাঁদের সন্তানকেও ভোগ করতে হোক। তাঁদের শৈশবকাল মসৃণ, আনন্দদায়ক হয়ে ওঠেনি বলে পরিণত বয়সে পৌঁছে শিশু-অভিভাবক সম্পর্কটির মধ্যে তাঁরা এক ধরনের অবিশ্বাস বা অনাস্থা খুঁজে পান। ফলে, এই ক্ষেত্রে তাঁরা আর এগোতে চান না।”
আর এক শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা ভীষণ কেরিয়ার-সচেতন। হয়তো তাঁরা জীবনে অনেক উঁচুতে উঠতে পেরেছেন, আরও ওঠার সম্ভাবনা আছে। এমতাবস্থায় এক শিশুর সম্পূর্ণ দায়িত্বগ্রহণে তাঁরা রাজি হন না। তাঁরা হয়তো তাঁদের সহকর্মীদের দেখেছেন, কী ভাবে সন্তান-অফিস দু’দিক সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হতে হয়, ভাল ক্রেশ, গৃহসহায়িকার সন্ধান, সন্তানের স্কুলের চাপ— এই আবর্তে আটকে অফিসের কাজে মন দিতে পারেন না। ফলে, এই দম্পতিদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়। সন্তান পৃথিবীতে এলে তাঁদের কেরিয়ারে তার প্রভাব পড়বে। যা তাঁদের লক্ষ্য, তা অর্জন করা সম্ভব হবে না। বরং, সন্তানের দায়িত্ব না থাকলে পছন্দমতো চাকরি বেছে নেওয়া, সহজেই কাজের সূত্রে অন্যত্র যাওয়ার সুযোগ থাকবে।
অন্য এক শ্রেণির দম্পতি আছেন, যাঁরা সংখ্যায় কম, কিন্তু নিজেরা নিজেদের মধ্যে মগ্ন। আমি-তুমি’তেই তাঁদের জীবন পূর্ণতা পেয়েছে। নিজেরা রোজগার করবেন, ঘুরবেন, জীবনটাকে উপভোগ করবেন সম্পূর্ণ ভাবে। এর মধ্যে তৃতীয় কেউ এলে পাছে নিজেদের এই বোঝাপড়াটি নষ্ট হয়ে যায়, তাই তাঁরা সেই দিকে আগ্রহী হন না।
সমাজে প্রভাব?
যদিও সন্তান না চাওয়ার মানসিকতা সমাজের একটা নির্দিষ্ট অংশের মধ্যেই মূলত এখনও সীমাবদ্ধ, তবে ভবিষ্যতে তা বৃদ্ধি পেলে সমাজে কি তার কোনও প্রভাব পড়তে পারে? মনোবিদ এবং শিশু-অধিকার সুরক্ষা আয়োগের সদস্য যশোবন্তী শ্রীমানী বললেন, “আমাদের পারিবারিক বৃত্তটি এমন ভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে সন্তানধারণে অনাগ্রহ খুব বেশি বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব সমাজে পড়ার আশঙ্কা আছে। হয়তো সমাজ আগের চেয়ে আরও বেশি আত্মমগ্ন, আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সমস্যা আসবে, দ্বন্দ্ব আসবে, সেগুলির মধ্য দিয়েই এগোতে হয় আমাদের। সমস্য়া সমাধানের মধ্য দিয়েই আমরা নিজেদের উন্নতির পথটি খুঁজে নিই। এমন অনেক দম্পতি আছেন, যাঁরা বিবিধ সমস্যার কারণে প্রথম দিকে সন্তানধারণে অনাগ্রহী ছিলেন। একটা সময়ের পর আবার নিজেরাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে ভেবে তা পুরোপুরি এড়ানোর জন্য যদি অনেক মা-বাবা সন্তানের জন্মই না চান, তবে জনসংখ্যার উপর একটা প্রভাব পড়বে তো বটেই, এর সঙ্গে সমাজের স্বাভাবিক ছন্দটিও এক সময়ে হারিয়ে যাবে।”
ব্যক্তিগত পছন্দ
তবে এখানে একটা কথা স্পষ্ট করে দেওয়া ভাল। কারণ যা-ই থাকুক না কেন, সন্তান না-চাওয়ার মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। এটি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দের বিষয়। আমাদের সমাজে সমাজ-নির্ধারিত নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে গিয়ে যাঁরা স্বাধীন মতপ্রকাশ করেন, তাঁদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করা, কোণঠাসা করে দেওয়ার এক প্রবণতা বর্তমান। যেমন, বিয়ের বেশ কিছু বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যাঁরা সন্তানের জন্ম দেননি, তাঁদের ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অনেকেই উদ্গ্রীব হয়ে পড়েন এর পিছনে শারীরিক সমস্যা খুঁজতে। এ ক্ষেত্রে মেয়েটিই আক্রমণের লক্ষ্য হয় সবচেয়ে বেশি। শুধুমাত্র তিনি মা হননি বলে সামাজিক অনুষ্ঠানে তাঁর প্রবেশ নিষেধ হয়েছে— এমনও দেখা গিয়েছে। আসলে, এ দেশে সর্ব ক্ষেত্রে মাতৃত্বকে উদ্যাপন করা হয়। ফলে তার বিপরীত পথটি কেউ বেছে নেওয়া মানেই তিনি সমালোচনার যোগ্য— এমনটাই ভাবা হয়ে থাকে। এই ভাবনা কিন্তু কারও ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপ। আধুনিকমনস্ক সমাজে এমনটা কোনও ভাবেই কাম্য নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy