মহাজনী গান ও আঞ্চলিক গীতের আসর বসেছে কলকাতায়। —নিজস্ব চিত্র।
সোজা পেট থেকে যে দিন স্বর বেরোবে, সে দিন বুঝবে প্রকৃতির কাছ থেকে এসেছে সুর। দেবদাস বাউল এক বার মহাজনী গানের তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন এমন কথা। শহুরে মন, তা উপলব্ধি করতে মাঝেমধ্যে প্রায় আধ দশক সময় নেয়। তবে প্রকৃতির এমন সব সুর ও স্বর ধরা আছে বঙ্গের নানা অঞ্চলের সংস্কৃতিতে। শহরে বসে সাধারণত তা সব সময়ে শোনা যায় না। কংক্রিটে ঢাকা নগর-ঐতিহ্য থেকে প্রাকৃতিক স্বর বেশ খানিকটা দূরেই থাকে। সে সবই এ বার নতুন করে কাছে টানার পালা। শীত শুরুর কলকাতা সে কথা মনে করাল।
কেউ গাইলেন দেহতত্ত্বের গান, কেউ তুলে আনলেন বাংলার গ্রামের বিয়ের গান। নানা বয়সের শিল্পী একে-অপরের সঙ্গে সুর সাধলেন। কারও বুলি জানা, কেউ বা অন্যের গান শিখে নিয়ে গলা মেলালেন। সবে মিলে নগর-মনকে গাঁয়ের দিকে আবার টেনে নিয়ে গেলেন। এ দেশের লোকসংস্কৃতি বহুমাত্রিক। প্রায় প্রতি অঞ্চলে নিজস্ব গান-নাচ-নাটকের ধারা আছে। শুধু বাংলার অন্দরেই যে সংস্কৃতির কত রূপ, সে কথা তুললে তখন ঠিকই মনে পড়ে নাগরিক জীবনধারায় অভ্যস্তদের। কীর্তন থেকে বাউল, ফকিরি থেকে ঝুমুর— কত ধারার গানই তো আছে এ বঙ্গে। নগরকেন্দ্রিক সংস্কৃতির বহুল প্রচারে মাঝেমধ্যে চাপা পড়ে যায় সে সব। কিন্তু শহর যদি গ্রামের দিকে তাকায়, সামগ্রিক সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়। সে ভাবনা থেকেই গাঁয়ের গান এসেছিল শহরে। উদ্যোগের নাম ‘বয়ান’। উদ্যোগী ‘আরশিনগর, গৌরবাজার’।
শুধু তো সুর নয়। এক এক প্রান্তের গান তুলে আনে নানা জনের বয়ান। বক্তব্য, কথা। কেউ জেলের জীবনের কথা বলেন, কেউ ধর্মতত্ত্ব নতুন করে ভাবান। বহুমুখী দর্শন ধরা থাকে সুরে সুরে। শনি ও রবিবার বিড়লা অ্যাকাডেমির মাঠে বয়ানের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে গায়ক উত্তম দাস যেমন বলছিলেন, ‘‘আমাদের উদ্দেশ্য কিন্তু শহরে এসে এক দিন গান গাওয়া নয়। গ্রাম আর শহরের যোগাযোগ বজায় রাখা। শহরের মুখ গ্রামের দিকেও ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া। এক কথায়, শহরকে গ্রামে টেনে নিয়ে যাওয়া।’’ দ্রুত বদলাতে থাকা সময়ে শহরে গান তো কম হয় না। কিন্তু লোকজীবনের সঙ্গে খানিকটা দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছে নগর-সংস্কৃতির। ফলে প্রাকৃতিক নানা নিয়ম, আঞ্চলিক জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে যাচ্ছে শহুরে মনের বোধের বাইরে।
শহরে যা কিছু হয়, তা অনেক সহজে প্রচারে আসে। তবে পল্লিসংস্কৃতি বিলীন হয়ে যায়নি। তা বেঁচে আছে শুধু নয়, নব প্রজন্ম নতুন করে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছে। ‘বয়ান’-এ এসে সে কথা আবার করে মনে করালেন মুর্শিদাবাদের রাফিয়া বেওয়া। তিন প্রজন্ম গানেই বাঁচেন তাঁরা। কলকাতায় এসেছেন ছেলে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি সকলকে নিয়ে। পরিবারের সকলে মিলে গান করেন ওঁরা। রাফিয়া বলেন, ‘‘আমার বাড়ির সকলেই প্রায় গানের সঙ্গে যুক্ত। বাবারা বাউল গান করেন। আমরা মহাজনী গানের পাশাপাশি আঞ্চলিক গানও করি।’’ এ বারের অনুষ্ঠানে নিজেদের এলাকার বিয়ের গান শোনান রাফিয়ারা। গানের মধ্যে যে নিজেদের এলাকার রীতি-রেওয়াজও ধরা থাকে, তা ভুলে গেলে তো চলবে না। তবে রাফিয়ার পরিবার শুধু এলাকার আচার-বিশ্বাসই দেখালেন না, সঙ্গে দেখালেন অভ্যাস। তুলে ধরলেন জীবনধারা, জীবনবোধ। এখনও তাঁদের বা়ড়িতে প্রায় সন্ধ্যায় গানে বসেন সকলে মিলে। পরিবারের নানা জনে একসঙ্গে গান তৈরি করেন। সঙ্গীতে বাঁচেন, গীত বাঁচিয়ে রাখেন রোজের কাজের মাঝে, সে সব কথাও জানালেন একরৈখিক ভাবনায় অভ্যস্ত অনেককে। আর নগর ও পল্লির মধ্যে বোধের এই আদানপ্রদানের উদ্দেশ্যেই যে এত আয়োজন, তা আর আলাদা করে বুঝিয়ে দিতে হল না আয়োজকদেরও।
শনিবার লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া শিল্পী সুনীল বর্মণ এবং তাঁর সতীর্থদের গান দিয়ে। তার পর রাফিয়া বেওয়ার দল। কলকাতার লোকসঙ্গীতের দল ‘লোকসরস্বতী’ সঙ্গীত পরিবেশন করে। পরিচালনায় ছিলেন জলি বাগচী এবং পূরবী ভট্টাচার্য। এর পর একক ভাবে দুই বাংলার লোকগান শোনান সঞ্চিতা রায়চৌধুরী এবং উত্তম দাস।
রবিবার ছিল অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় দিন। মহাজনী সঙ্গীতের আসরে গান শোনান মুর্শিদাবাদের শ্যামসুন্দর গোঁসাই এবং নিমাই খ্যাপা, জয়দেব কেঁদুলির অনাথবন্ধু ঘোষ, লক্ষ্মণ দাস বাউল এবং সাধু দাস, পশ্চিম বর্ধমানের গৌরবাজারের রাজু দাস, সিউড়ির নিতাই দাস। পুণে থেকে এসেছিলেন শ্রুতি বীণা বিশ্বানাথ। এঁরা ছাড়াও যন্ত্রানুষঙ্গে ছিলেন মলয় কিন্নর, অর্পণ, অঘোরী, সায়ন, বুধনরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy