Advertisement
১৮ ডিসেম্বর ২০২৪
Classical Language

ধ্রুপদী ভাষার তকমা পেয়েও বাঙালির কাছে বাংলার সম্মান ফিরবে কি? প্রশ্ন সহজ, উত্তর কি জানা?

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। ধ্রুপদী ভাষার তকমা পেয়েছে বাংলা। এই গৌরবের পরেও বিশেষ কোনও বদল আসবে কি? মাতৃভাষার চর্চা কি বাড়বে?

ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৫২
Share: Save:

বাণিজ্যে যদি লক্ষ্মী বাস করেন, তা হলে ভাষায় নিশ্চয় সরস্বতীর বাস? অন্তত অঙ্ক তো তাই বলছে। আশ্বিনের শারদপ্রাতে বাংলা ‘ধ্রুপদী ভাষা’র মর্যাদা পাওয়ায় এমনই নানা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে অনেকের মনে। সবচেয়ে বেশি যে ভাষায় কথা হয় গোটা পৃথিবীতে, সে তালিকায় বাংলার স্থান হল পঞ্চমে। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলা বলতে পারে পঁচিশ কোটি মানুষ। সেই পঁচিশ কোটি মানুষই কি বাংলায় বলে এবং লেখে? যদি তা-ই হত, তা হলে কি আর বাংলা ভাষার পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যেত? ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য দিনরাত এক করে পরিশ্রম করতেন অভিভাবকেরা? কিংবা সরকারি স্কুলের বেঞ্চগুলি কি এত ফাঁকা ফাঁকা থাকত? বাংলা ভাষা জাতীয় স্তরের স্বীকৃতি পাওয়ার পরেও নানা প্রশ্ন উঠছে বাংলা ভাষাপ্রেমীদের মনে। বাংলা ভাষাকে ধ্রুপদী তকমা পাওয়ার জন্য বহু লড়াই করতে হয়েছে। পেরোতে হয়েছে কিছু মানদণ্ড। অবশেষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলার মর্যাদার বৃদ্ধি পেয়েছে। এই গৌরবের পরেও বিশেষ কোনও বদল আসবে কি? মাতৃভাষার চর্চা কি বাড়বে? অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী অবশ্য মনে করেন না এই স্বীকৃতি কোনও বড়সড় বদল আনবে। কারণ তিনি মনে করেন, ভাষার সঙ্গে আত্মীয়তা থাকা জরুরি। ঋত্বিক বলেন, ‘‘খুব সাংঘাতিক কোনও পরিবর্তন আসবে বলে আমার মনে হয় না। ভাষার এই স্বীকৃতি যদি সব বদলে দিত, তা হলে বাঙালির প্রাথমিক যে ভাষা চর্চা সেটা এতটা অস্তিত্বহীন হয়ে যেত না। বহু মানুষ জানেনই না যে আমাদের রাষ্ট্রভাষা শুধু হিন্দি নয়। নিজের সংস্কৃতির প্রতি ভালবাসাটা ভিতর থেকে আসতে হয়। স্বীকৃতি দিয়ে ভাষার প্রতি আবেগ বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’’

বহুজাতিক সংস্থা হোক কিংবা কর্পোরেট জগৎ— ইংরেজি ভাষা ছাড়া অচল এই স্তরগুলি। কাগজেকলমে হোক কিংবা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগে— ইংরেজি ভাষা অন্যতম মাধ্যম। এমনকি পেশাগত প্রয়োজনে সারা বছরই ইংরেজিতেই প্রেসক্রিপশন লিখতে হয় চিকিৎসকদের। এই স্বীকৃতির পর বাংলা প্রেসক্রিপশন লেখা কি শুরু করবেন তাঁরা? চিকিৎসক সুর্বণ গোস্বামী বলেন, ‘‘কিছু ক্ষেত্রে আছে যেখানে ইংরেজি ভাষার উপর ভরসা করতে হয়। তা না হলে কাজ এগোনো যায় না। ওষুধের নাম বাংলায় লিখতে পারব না। তার মানেই বাংলা ভাষার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে নেব, সেটাও নয়। মাতৃভাষা আমাদের মননে রয়েছে, জীবনে রয়েছে। এই স্বীকৃতি তখনই কার্যকর হবে, যখন দেখব বাংলা ভাষা সর্বত্র গুরুত্ব পেয়েছে। পেশার তাগিদে যদি ইংরেজি কিংবা হিন্দির কাছে আশ্রয় নিতেও হয়, বাংলা ভাষা যেন জীবন থেকে হারিয়ে না যায়। ইংরেজিতে লেখা বলে আইনের অর্থ অনেকেই বুঝতে পারেন না। ইংরেজির পাশাপাশি সব কিছু বাংলাতেও যেন তর্জমা হয়ে থাকে। এটুকু চাই।’’

বাংলা নিয়ে উচ্চশিক্ষার কথা ভাবা যে একটা বড় ঝুঁকির বিষয়, বাংলা সাহিত্যের অনেক ছাত্রছাত্রী এ ব্যাপারে সহমত হবেন। অন্য কোনও বিষয় নিয়ে পড়ার সুযোগ হয়নি তাই বাংলা নিয়ে পড়ছেন, বাংলা সাহিত্যের পড়ুয়াদের জীবনে এক বার হলেও এটা শুনতে হয়। সেটাই বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তনী রাজর্ষি ধাড়া। তিনি বলেন, ‘‘আর কোথাও ঠাঁই না পেয়ে বাংলা পড়তে এসেছি, এটা তো শুনতে হয়েছে। তেমনই এই আকালে কেন বাংলা নিয়ে পড়তে এলাম, তেমন কথাও আমাদের শিক্ষকদের থেকে শুনেছি। আমার মনে হয় বাংলার চর্চা যদি থেমে যায়, তা হলে কোনও স্বীকৃতি কিচ্ছু পরিবর্তন আনতে পারবে না। বাংলার সঙ্গে পালি, প্রাকৃতও ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। এই ভাষাগুলির তো বিশেষ কোনও চর্চা নেই। স্বীকৃতি পাওয়ার পর কি হঠাৎ সকলে পালি ভাষায় কথা বলতে শুরু করবে? তা তো নয়। বাংলার ক্ষেত্রেও একই বিষয় প্রযোজ্য।’’

গত দু’দশকে বাংলা ভাষা যে ভাবে গত দু’দশকে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখান থেকে ভাষাটিকে তুলে আনতে হলে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে এর চর্চা শুরু করতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্কুলগুলিতেও বাংলা ভাষার চর্চা আরও বেশি করে জরুরি। বহু দিন ধরে এই বিষয়টি নিয়ে নানা আলাপ-আলোচনা চলছে। জাতীয় স্তরে বাংলা ভাষার এই স্বীকৃতিতে খানিকটা হলেও পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটবে? অভিনেত্রী ইশা সাহা বলেন, ‘‘সন্তান বাংলা লিখতে পারে না। ইংরেজিতে গড়গড়িয়ে কথা বললেও বাংলা বলতে হোঁচট খায়, আর সেটা নিয়ে বাবা-মায়েরা গর্ব করেন। এই স্বীকৃতিতে সত্যিই সেই গর্ব খর্ব হবে কি না, আমার সংশয় আছে। গাড়ি করে যাওয়ার সময় কোনও রেডিয়ো চ্যানেলে আমি বাংলা গান শুনতে পাই না। আমরা নিজেরাই যদি নিজেদের ভাষাকে এত অবহেলা করি, তা হলে কোনও কিছুতেই কোনও সমাধান হবে না। এই স্বীকৃতি শোপিস করে তুলে রাখা ছাড়া গতি নেই।’’

বাংলা ভাষার এই ‘প্রাপ্তি’তে যারপরনাই খুশি বরাহনগর মোহন গার্লস হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা গোধূলি মুখোপাধ্যায়। মেয়েকে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়িয়েছেন। সেই মেয়ে এখন এক বহুজাতিক সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন। ইংরেজিতেই সব কাজকর্ম সারতে হয়। বাংলায় পড়াশোনায় করেও বড় চাকরি পেতে অসুবিধা হয়নি। তা হলে এখনকার অভিভাবকদের বাংলা মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে পড়াতে এত ভীতি কেন? তিনি বলেন, ‘‘আমি সত্যিই জানি না অভিভাবকেরা কী ভাবেন। বাংলা পড়ে যে কিছু হবে না, এই ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। তবে বাংলা ধ্রুপদী ভাষা হওয়ার পর সেই ভাবনা সরে যাবে কি না, আমি জানি না। কিন্তু বাংলা যে পেশাগত ক্ষেত্রে কোনও বাধা হতে পারে না, এটুকু আমি নিশ্চিত।’’

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পরেও বাঙালির কাছে বাংলা ভাষার গুরুত্ব বাড়বে কি না, তা নিয়ে সংশয় খেলা করছে নানা জনের মনে। পাশাপাশি, এটাও ভাবনা যে বাংলা ভাষার সঙ্গে একটা প্রজন্মের যে প্রেমহীন সম্পর্ক, এই তকমা কি সত্যিই পারবে সেই দূরত্ব মুছে দিতে? আসলে বাংলা ভাষার সঙ্গে বাঙালির যে নাড়ির টান, তা বিস্মৃত হলে সংস্কৃতিও ধীরে ধীরে মুছে যাবে। বাঙালির ভাষা-মানচিত্রে যেন বাংলার স্থান সবচেয়ে উপরে থাকে, এটাই চাওয়া সকলের।

অন্য বিষয়গুলি:

Bengali Culture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy