Advertisement
২৪ নভেম্বর ২০২৪
Letters

চিঠির আখরে মনের বিকাশ

সন্তানের কল্পনাশক্তি, মেধার গুণমান উন্নয়নে সহায় হবে কাগজে-কলমে চিঠি লেখার সুঅভ্যাস। তাই মাঝেমাঝে চিঠি লেখায় উৎসাহ দিন সন্তানকে।

— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

চিরশ্রী মজুমদার 
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৭:২৯
Share: Save:

প্রায় ১০০ বছর আগে উইলিয়াম সমারসেট মম ‘দ্য লেটার’ নাটকে বলেছিলেন, “লেটার রাইটিং ইজ় আ ডায়িং আর্ট।” বিখ্যাত সেই নাটকে চিঠির অসীম ক্ষমতার পরিচয় মিলেছিল। নিভৃতে রচিত চিঠির অক্ষরগুলিতে বসত করে মানুষের মনের গোপনতম রহস্য, লুকানো আবেগ, প্রতিভার স্ফূরণ, সময়ের ইতিহাস। এক সময়ে দূরদেশবাসী আপনজনের কাছে খবর পৌঁছনোর মাধ্যম ছিল চিঠি। তাই নিয়ে ছিল পত্রসাহিত্য, রানারের গান। যোগাযোগ-বিপ্লব চিঠির সেই গৌরবকে ক্ষুণ্ণ করলেও কাড়তে পারেনি তার সেই বৌদ্ধিক সিন্দুকটিকে। তাই, আজ যদি স্মার্টফোনকে সরিয়ে রেখে চিঠি লেখার অভ্যাসটিকে আবার ঝালিয়ে নেওয়া যায়, তবে আমাদের মেধাসম্পদের রত্নগুলি অযত্নের ধুলো সরিয়ে ঝিলমিলিয়ে উঠবে। এখন অভিভাবকেরা সন্তানের বুদ্ধির বিকাশের জন্য নানা পন্থা অবলম্বন করেন। সে রকম এক উপায় হতে পারে ছোটদের চিঠি লিখতে শেখানো। ওদের বুদ্ধির, কলাচেতনার বিকাশ হবে, ডিজিটাল যুগের কুপ্রভাবগুলি থাকবে দূরে।

—প্রতীকী চিত্র।

কেন এখনও প্রাসঙ্গিক

অ্যালফ্রেড জর্জ গার্ডিনার চিঠি লেখায় বিতৃষ্ণার অন্যতম কারণ বলেছিলেন সে যুগের নব্য ফ্যাশন পেনি পোস্ট আর মানুষের ব্যস্ততাকে। এই শতাব্দীর শুরুর দিক থেকে চিঠি লেখার বিলাসকে একেবারেই ভুলিয়ে রেখেছে ইমেল, হোয়াটসঅ্যাপ এবং সমাজমাধ্যমের তাৎক্ষণিক যোগাযোগের প্রযুক্তিগুলি। এই ডিজিটাল পৃথিবীতে উপকরণের এতই ছড়াছড়ি যে কোনও একটি বিষয়ে মনকে দু’দণ্ড স্থির বসিয়ে রাখাই মুশকিল। রিল-সর্বস্ব দুনিয়া মানুষের একাগ্রতা নষ্ট করছে, প্রযুক্তি জীবন সহজ করতে গিয়ে চুরি করছে শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রমের স্পৃহা। কোভিড-উত্তর যুগে সোশ্যাল মিডিয়া এবং স্মার্টফোন এখন পড়াশোনার অন্যতম মাধ্যম। ছোটরা অ্যাপে, টেকনোলজির ব্যবহারে বড়দের চেয়েও দড়, তাই মানুষকে যন্ত্রনির্ভর জড়ে পরিণত করার ফাঁদে ওদের আটকে যাওয়ার সম্ভাবনাও বাড়ছে। শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানাচ্ছেন, বহু শিশুই মনঃসংযোগের অভাবে ভুগছে। চিঠি লেখা ও চিঠি পাওয়ার মজাটা এক বার এদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে ওরা একমনে লিখতে বসে যাবে। ফোকাস করতে শিখবে, ফলে সিলেবাস আয়ত্ত হবে সহজে, চিত্তবিক্ষেপের প্রলোভনগুলিকে উপেক্ষা করে টানা মনঃসংযোগ করতে শিখে ফেললে যে কোনও সৃষ্টিশীল কাজে নিজের সেরাটা বার করে আনতে পারবে।কম্পিউটার বা ল্যাপটপের পর্দায় নয়, কাগজে-কলমে চিঠি লেখার অভ্যাস করান। একটি গবেষণা জানিয়েছে, কিবোর্ডে লেখার চেয়ে পেনে বা পেনসিলে লিখলে তা মনে দাগ কেটে গেঁথে বসে বেশি। কম্পিউটারে লেখার সময়ে ভুল সংশোধন, তা মুছে পরিষ্কার ভাবে লেখার সুবিধা থাকে। কিন্তু কাগজে কলমে লেখার সময়ে সংশোধনের সুযোগ কম এবং পরিশ্রমসাধ্য। শিশু গভীর ভাবে ভেবে নিয়ে তবে লিখবে। এতেও ‘তলিয়ে ভাবা প্র্যাকটিস’ হবে, বিবরণ দিতে শিখবে। নিজেকে ভাল ভাবে প্রকাশ করতে পারবে। হাতের লেখা সুন্দর, পরিচ্ছন্ন হবে।শিল্পীসত্তা লালনের জন্য চিঠি লেখার অভ্যাস খুবই কার্যকর। সমুদ্রসৈকতে এক দিন কেমন ঘুরে এলে তা নিয়ে বন্ধুকে চিঠি, স্কুলের স্পোর্টস ডে নিয়ে দাদু-দিদাকে চিঠি, বা আর একটু ছক ভেঙে প্রিয় সুপারহিরোকে চিঠি লেখার কাজ দিলে ওরা আনন্দের সঙ্গে লিখতে বসবে। পছন্দের বিষয়ে লিখতে দিলে শব্দভাণ্ডার, ভাষার দখল, যে কোনও বিষয় নিয়ে লেখার আত্মবিশ্বাস ও স্বতঃস্ফূর্ততা বাড়বে।

—প্রতীকী চিত্র।

হাসিখুশির ডাকঘর

কেজো চিঠি, সৃষ্টিশীল চিঠি লেখার ক্লাসওয়ার্কের পাশাপাশি বাস্তব দুনিয়ায় চিঠি লিখে পোস্ট করার মজাটার স্বাদ দিন ওদের। উৎসাহ দ্বিগুণ হবে। সাউথ পয়েন্ট হাইস্কুলের ৭০ বছরের উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে সম্প্রতি এমনই আয়োজন হয়েছিল। অধ্যক্ষা রূপা সান্যাল ভট্টাচার্য জানালেন, স্কুলের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তীর বিশেষ ডাকটিকিট খামে সেঁটে, বিশেষ কাগজে চিঠি লিখেছে পড়ুয়ারা। স্কুলে নির্মিত অস্থায়ী ডাকঘরে তা জমা করেছে। স্কুল নিয়ে লিখেছে মা-বাবাকে, একটু বড় বাচ্চারা আবার লিখেছে নিজের ভবিষ্যৎ সত্তাকে। প্রশ্ন রেখেছে, তুমি কি এই গ্রহের যত্ন করেছ? নার্সারির খুদেরা ছবি এঁকে খামে ভরে পোস্ট করেছে। অধ্যক্ষার মতে, সৃষ্টিশীলতা, কল্পনাশক্তির অনুশীলনের পাশাপাশি এতে তাদের নৈতিক চরিত্রের গঠন হয়েছে। চিঠির জন্য প্রতীক্ষা করার, ধৈর্য ধরার শিক্ষা মিলেছে। প্রযুক্তির সহায়তায় কোনও কিছু তৎক্ষণাৎ হয়ে যাওয়া ও বহু পরিশ্রমে কিছু গড়ে তোলা এবং তা প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার মধ্যে তফাতকে চিনেছে। তার মূল্য বুঝেছে। এ ছাড়া, এতে স্কুলের ঐতিহ্য এবং শিশুর এই পর্যায়ের জীবনযাত্রার একটি দলিল তো থাকলই।

হারানো প্রাপ্তি

পত্রমিতালি, ডাকটিকিট জমানোর মতো হারানো দিনের সুখস্বপ্নগুলো হয়তো ফিরবে না। কিন্তু, এই অভ্যাসে প্রাপ্তির দিকটা নেহাত অল্প নয়। অধ্যক্ষা বললেন, ওদের প্রশ্ন ছিল, আমার এই চিঠি অন্য কেউ পড়বে না তো? সমাজমাধ্যমের ‘ফরওয়ার্ড’-এর ধুমে ‘ব্যক্তিগত বার্তা আদানপ্রদান’-এর জায়গাটা ক্ষতিগ্রস্ত। চিঠিতে সেই বিপদ নেই। পড়ুয়ারা এ বিষয়ে আশ্বস্ত হলে মনের কথা লিখতে পারছে। সরাসরি বড়দের যা বলতে পারছে না, তা লিখে জানাচ্ছে। কী ভাবছে, কী হতে চায়, মনের অবস্থা এই মুহূর্তে কেমন— খবর পাচ্ছেন অভিভাবক। একেলে জটিল পৃথিবীতে শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টা তার সঙ্গে চিঠি বিনিময় করেও জেনে নেওয়া যায়।

—প্রতীকী চিত্র।

শিশুকে চিঠি লিখুন, তাকেও আপনাদের চিঠি লিখতে উৎসাহ দিন। বন্ধু, দাদু-দিদা, ঠাকুরদা-ঠাকুমা ও অন্য প্রিয়জনদেরও লিখুক চিঠি। অক্ষর কিংবা ছবির আঁকিবুকিতে, পদ্যে অথবা ইমোজির নয়া-ভাষায়। তাতেই বেঁচে উঠুক ডাকঘর। আর, একাত্ম হয়ে লিখতে লিখতে, আপনার শিশুর কালি কলম মনের মধ্য দিয়েই নবঅবয়বে আবার ফিরে আসুন তাঁরা। এক জন টমাস কার্লাইল, জন কিটস, ডব্লিউ বি ইয়েটস, আর পুপেদিদি কিংবা রবীন্দ্রনাথ। সেই তাতাবাবু আর বিদেশপাড়ি দেওয়া তার পিতা উপেন্দ্রকিশোর।সরস্বতী ঠাকুরের পুষ্পাঞ্জলির সুঘ্রাণে এখনও ভরে আছে চরাচর। মনের দরজায় সেই সংবাদ এনেছে দখিনা বাতাস। বসন্তের এই ডাকহরকরাটিকে দিয়েই এতটুকু আশীর্বাদ তো নিশ্চয়ই পাঠাতে পারেন আপনার আদরপুত্তলিটির তরে।

মডেল: রাইমা গুপ্ত; মেকআপ: প্রিয়া গুপ্ত; ছবি: অমিত দাস,লোকেশন: ইকো হাব, ইকো স্পেস।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy