সম্প্রতি লন্ডন সফরে গিয়ে উল্টো হেঁটে ভাইরাল হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। খেলার ছলে ছোটবেলায় অনেকেই উল্টো হাঁটেন। তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিনে কিছুটা সময়ে উল্টো হাঁটা বা ব্যাকওয়ার্ড ওয়াকিংয়ের অভ্যেস উপকারী। এ ধরনের হাঁটাকে রেট্রো-ওয়াকিং বা রেট্রো-অ্যাম্বুলেশনও বলে। ফিটনেস প্রশিক্ষক অরিজিৎ ঘোষাল বলছেন, “অস্থিসন্ধির বদলে পেশি যাতে শরীরের চাপ নিতে পারে, তার জন্যই এই ব্যায়াম। এতে শরীরের বিভিন্ন ব্যথা কমে, মনোযোগ বাড়ে।”
গোড়ার কথা...
ব্যাকওয়ার্ড ওয়াকিং কিন্তু নতুন ট্রেন্ড নয়। এক সময়ে গ্রিক, রোমানরা মনে করতেন উল্টো হাঁটলে দুর্ভাগ্য এড়ানো যায়। সংস্কারের মোড়ক থাকলেও তার পিছনে আদতে ছিল সুস্বাস্থ্যের ভাবনাই। পরে রোমান, গ্রিক সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত অবস্থান বদলের জন্য পিছনে হাঁটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। প্রাচীন ভারতীয় যোগশাস্ত্রে, চিনে তাওইজ়ম দর্শনে এ ধরনের স্বাস্থ্যচর্চার উল্লেখ রয়েছে। জাপানে সামুরাইদেরও একই অভ্যেস করতে হত।
স্বাস্থ্যের খোঁজে
ব্যথা-যন্ত্রণা কমাতে পিছনে হাঁটানোর ‘ওষুধ’ প্রয়োগ বহু বছর আগে প্রথম শুরু হয়েছিল চিন দেশে। বিংশ শতকের শুরুর দিকে উল্টো হেঁটে আলোচনায় উঠে এসেছিলেন আমেরিকার এক সিগার দোকানের মালিক প্যাট্রিক হ্যামন। সান ফ্রান্সিসকো থেকে নিউ ইয়র্ক অবধি প্রায় ৬৩০০ কিলোমিটার পথ উল্টো হেঁটেছিলেন প্যাট্রিক। বিংশ শতকের শেষের দিক থেকেই ফিটনেস ট্রেনিং প্রোগ্রামে পিছনে হাঁটা জুড়ে যায়। পিঠ, হাঁটু, কোমরের ব্যথা, মেরুদণ্ডের সমস্যা, আর্থ্রাইটিসের চিকিৎসায় পশ্চিমি বিশ্বের ফিজ়িয়োথেরাপিস্টরা ব্যাকওয়ার্ড ওয়াকিং করাতে শুরু করেন। টেনিস, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবলে তো বটেই এমনকি ক্রিকেট, ফুটবলেও এখন খেলোয়াড়দের নিয়মিত উল্টো হাঁটা বা দৌড়ের অভ্যেস করানো হয়। পশ্চিমি দেশে ব্যাকওয়ার্ড রানিং চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজন করা হয়।
পিছনে হাঁটার উপকারিতা
ফিটনেস প্রশিক্ষক গুরুপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “আমরা বরাবর সামনে হাঁটি। এতে পায়ের পেশিগুলি একটি নির্দিষ্ট দিকের চলনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। পিছনে হাঁটার ফলে পেশিগুলির বিপরীত চলন হয়। সঙ্গে মস্তিষ্ক ও শরীর দুইয়েরই ব্যায়াম হয়।”
- বাড়ে পেশির জোর: নিয়মিত এ অভ্যেসে হ্যামস্ট্রিং, কোয়াড্রিসেপস, গ্লুটস, কাফ মাসলের জোর, ফ্লেক্সিবিলিটি, মবিলিটি বাড়ে। গোড়ালি শক্ত হয়। পেশির টান, মাসল ক্র্যাম্পের সমস্যা এড়ানো যায়।
- ওজন কমে সহজে: সামনের তুলনায় পিছনে হাঁটতে পরিশ্রম বেশি, ক্যালরিও বেশি বার্ন হয়। মেটাবলিজ়ম ক্ষমতাও বাড়ে। ফলে ওজন তুলনামূলক ভাবে দ্রুত কমে।
- মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ে: সামনে তাকিয়ে পিছনে হাঁটতে মনোযোগ দরকার বেশি। ফলে এতে ব্রেনের এক্সারসাইজ় হয়ে যায়। নিয়মিত এই অভ্যেসে মনোযোগ, মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা, স্মৃতিশক্তি, বুদ্ধিমত্তা বাড়ে। অ্যালঝাইমার্স ও পারকিনসনসের মতো স্নায়বিক রোগীদের জন্যও এই এক্সারসাইজ় উপকারী।
- জয়েন্টের উপরে চাপ কমে: উল্টো দিকে হাঁটলে হাঁটু বা জয়েন্টে কম চাপ পড়ে। এ অভ্যেসে পিঠ, হাঁটু-সহ বিভিন্ন অস্থিসন্ধির ব্যথা কমায়। মেরুদণ্ড ও কোমরের সমস্যায় উপকার মেলে।
- শারীরিক ভারসাম্য বাড়ে: বয়স বাড়লে বিভিন্ন হাড়, জয়েন্ট ও পেশি দুর্বল হতে থাকায় শরীরের ব্যালান্স কমতে থাকে। টাল সামলাতে না পেরে অনেকেই যখন তখন পড়ে যান। গুরুপ্রসাদ বলছেন, “রেট্রো-ওয়াকিং শরীর ও মনের সমন্বয় বাড়ায়। ফলে ব্যালান্স বাড়ে।”
আরও...
রেট্রো-ওয়াকিং মূলত কার্ডিয়ো এক্সারসাইজ়। এতে হার্ট, ফুসফুস ভাল থাকে। ব্যাকওয়ার্ড সাইক্লিংও করেন অনেকে। এতে পায়ের ও শরীরের দু’পাশে থাকা অতিরিক্ত মেদ ঝরে যায়। গুরুপ্রসাদ বলছেন, “সামনের দিকে ঝুঁকে হাঁটার অভ্যেস থাকলে বা ভারী ব্যাগ বইতে গিয়ে অল্প বয়সে কুঁজো হয়ে এলেও ব্যাকওয়ার্ড ওয়াকিংয়ে শরীর সোজা হয়। দীর্ঘ সময় বসে কাজ করতে হলেও এই শারীরচর্চা ভাল।” এই অভ্যেস খেলোয়াড়দের শারীরিক ব্যালান্স ও রিফ্লেক্স বাড়ায়।
হাঁটার নিয়মকানুন
পিছনে হাঁটার সময়ে কিন্তু শরীরের ভঙ্গির দিকে নজর দিতে হবে। অরিজিৎ বলছেন, “সামনে হাঁটার সময়ে আগে গোড়ালি পড়ে, তার পরে পায়ের পাতা। পিছনে হাঁটার সময়ে ঠিক উল্টো হবে। পায়ের পাতার উপরে ভর দিয়ে গোড়ালিতে পৌঁছতে হবে। অ্যাডভান্স স্তরে ওজন-সহও রেট্রোওয়াকিং করানো হয়।” দিনে ৫-৬ মিনিট ব্যাকওয়ার্ড ওয়াকিংই যথেষ্ট। ট্রেডমিলেও উল্টো হাঁটতে পারেন। তবে শুরুতেই ট্রেডমিলে হাঁটা বিপজ্জনক। ট্রেডমিলে হাঁটার সময়ে সঙ্গে প্রশিক্ষক থাকা জরুরি। খোলা জায়গায় হাঁটলেও বয়স্ক ব্যক্তিদের সঙ্গে একজন থাকা ভাল।
সতর্ক থাকুন
পিছনে হাঁটা ব্যাপারটা শুনতে যতটা সোজা, বাস্তবে কঠিন। উল্টো দিকে হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাওয়া বা ধাক্কা খাওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই ফাঁকা ও নিরাপদ জায়গায় ধীরে ধীরে অভ্যেস শুরু করুন।
ব্যাকওয়ার্ড ওয়াকিং যে কোনও বয়সেই শুরু করা যায়। বিশেষত মাঝবয়সি মহিলাদের জন্য রেট্রো-ওয়াকিং উপকারী। মেরুদণ্ডে সমস্যা থাকলে রেট্রো-ওয়াক শুরু করার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
ছবি: সায়ন্তন দত্ত; মডেল: রূপা নন্দী; মেকআপ: নব মাইতি; হেয়ার: সুজয় বণিক; ফুড পার্টনার: চাওম্যান
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)