ঋতুস্রাবের আগে হরমোনের প্রভাবে অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিসুগুলি ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে। ছবি: শাটারস্টক
করোনা মহামারির ভয়ে বিশ্বের মানুষ তটস্থ, আক্রান্তের সংখ্যা দেড় কোটি ছাড়িয়েছে। অন্যদিকে পৃথিবীর ১৭ কোটি ৬০ লক্ষ মহিলা এন্ডোমেট্রিওসিসের ভয়ানক ব্যথায় কাবু। তাহলে এন্ডোমেট্রিওসিসকেও কি মহামারির পর্যায়ে ফেলব ? ছোঁয়াচে নয় এমন কোনও রোগ মহামারি নয়। তবে একথাও ঠিক কষ্টকর এই রোগে বিশ্বের অসংখ্য মহিলা ভুগছেন। সম্প্রতি এক নতুন ওষুধের সাহায্যে এন্ডোমেট্রিওসিসের মারাত্মক ব্যথার হাত থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যাচ্ছে, এ কথা জানালেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায়।
গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন বা (জিএনআরএইচ) দিয়ে চিকিৎসা করে ব্যথার কষ্ট কমানো যায়। সম্প্রতি এফডিএ এই মুখে খাওয়ার ওষুধটিকে অনুমোদন দিয়েছে। অভিনিবেশবাবু জানালেন যে গোনাডোট্রপিন রিলিজিং হরমোন এর সাহায্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাড়ের ঘনত্ব (বোন ডেনসিটি) কমে যাওয়ার মত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় বলে দীর্ঘমেয়াদী ভাবে এই চিকিৎসা করতে গেলে রোগীর শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তবেই চিকিৎসা করতে হবে।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের শুরু থেকেই ঋতুমতী মেয়েরা এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যায় কষ্ট পেতেন। সেকালে হিপোক্রিটিস ব্যথার উৎস অনুসন্ধান করে এন্ডোমেট্রিওসিস সম্পর্কে একটা অস্পষ্ট ধারণার আভাস দেন। হিপোক্রিটিসের দেখানো পথে কার্ল ভন রকিট্যান্সকি ১৮৬০ সালে জরায়ুর অংশ মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখে এই অসুখটির বিজ্ঞানসম্মত ব্যখ্যা করেন। তবে যন্ত্রণাদায়ক রোগটির সুনির্দিষ্ট কারণ সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এখনও বিশ বাঁও জলে। তাই সঠিক ওষুধের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন: সুস্বাস্থ্য
অভিনিবেশবাবু জানালেন এই মুহুর্তে এন্ডোমেট্রিওসিসের দুটি টিকা নিয়ে ট্রায়াল চলছে । আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে টিকার সাহায্যে কষ্টকর যন্ত্রণাদায়ক পিরিয়ড ও তলপেটের যন্ত্রণার সমস্যা থেকে রোগীদের সারিয়ে তোলা যাবে।
কেন হয় এন্ডোমেট্রিওসিস
এর উত্তর এখনও খুঁজে চলেছেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। অবশ্য কয়েকটা ব্যাপার জানতে পেরেছেন। যাঁদের বংশে এই অসুখের ইতিহাস আছে তাঁদের এই রোগের ঝুঁকি ছয় গুণ বেশি। এছাড়া ১১ বছরের কম বয়সে মেনার্কি হলে তাঁদের এন্ডোমেট্রিওসিসের সম্ভাবনা বেশি, জানালেন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ পলি চট্টোপাধ্যায়। আবার যাঁদের ঋতুচক্র ২৭ দিনের কম, তাদেরও সম্ভাবনা থাকে। সন্তান না হলেও এই অসুখের ঝুঁকি থাকে।
এন্ডোমেট্রিওসিস ঠিক কী
ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন এই অসুখের অন্য নাম ব্যথা। মেনার্কি থেকে শুরু হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে চলতে পারে মেনোপজ পর্যন্ত। ইউটেরাসের ভেতরে এন্ডোমেট্রিয়াম নামে এক স্তর বা লাইনিং থাকে। বয়ঃসন্ধির একটি মেয়ে যখন ঋতুমতী হয়, নানা হরমোনের প্রভাবে জরায়ু বা ইউটেরাসের মধ্যে নানা ওলটপালট হয়, বললেন পলি চট্টোপাধ্যায়। গর্ভে সন্তান এলে বা ঋতুনিবৃত্তি পর্যন্ত হরমোনের ওঠাপড়ায় জরায়ুর নানা পরিবর্তন হয়। প্রত্যেক মাসে ঋতুস্রাবের পর জরায়ুর মধ্যে থাকা এন্ডোমেট্রিয়াম লাইনিংটি সন্তান ধারণের জন্যে তৈরি হয়। সেই সময়কালে অন্তঃসত্ত্বা না হলে এন্ডোমেট্রিয়াম লাইনিং ধীরে ধীরে খসে যায়। ২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এন্ডোমেট্রিয়াম জরায়ু থেকে খসে গেলেই শুরু হয় ঋতুস্রাব। এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক। জরায়ু থেকে ছিঁড়ে আসে বলে ঋতুস্রাবের দু-তিনদিন আগে থেকে তলপেটে অল্পস্বল্প ব্যাথা হয়। এন্ডোমেট্রিওসিস অসুখে ব্যাপারটা বদলে যায়।
আরও পড়ুন: ফ্রিজ থেকে কি করোনা ছড়ায়? কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা, জেনে নিন
জরায়ুর ভিতরে ছাড়াও এর বাইরের দিকে, ওভারিতে, ফ্যালোপিয়ান টিউবে এমনকি, কখনও কখনও রেক্টাম বা মলাশয়েও এন্ডোমেট্রিয়াম লাইনিং তৈরি হয়। ঋতুস্রাবের আগে হরমোনের প্রভাবে এই সব অস্বাভাবিক এন্ডোমেট্রিয়াম টিসুগুলিও ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে ও প্রচুর রক্তপাত হয়, বললেন পলি দেবী। আর এই কারণেই পেটে ভয়ানক ব্যথা ও অস্বাভাবিক ঋতুস্রাব হয়।
২৮ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে এন্ডোমেট্রিয়াম জরায়ু থেকে খসে গেলেই শুরু হয় ঋতুস্রাব। ফাইল ছবি।
কী উপসর্গে সতর্ক হতে হবে
অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় জানালেন অনেক সময় এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলেও সেরকম কোনও উপসর্গই থাকে না। বন্ধ্যাত্ব বা অন্য কারণে পরীক্ষা করতে গিয়ে ধরা পড়ে। স্টেজ -১ বা স্টেজ -২ অসুখে বেশিরভাগ সময়ে খুব সমস্যা হয় না। কিন্তু স্টেজ তিন বা স্টেজ চারে পৌঁছলে স্বাভাবিকের তুলনায় অতিরিক্ত বেশি রক্তপাত হয়। কিছুটা রক্ত পেটের মধ্যে থেকে যায়। আর সমস্যা হয় এর থেকেই। জমা রক্ত চকোলেট সিস্ট হয়ে পিরিয়ডের সময় তো বটেই বলতে গেলে সারাক্ষণই পেটে ব্যথা করে।
আরও পড়ুন: করোনা আবহে মন ভাল রাখতে মানতেই হবে চিকিৎসকদের এই সব পরামর্শ
• ঋতুস্রাবের কিছুদিন আগে থেকে তল পেটে খুব ব্যথা করে। ঋতু চলাকালীনও ব্যথার হাত থেকে রেহাই মেলে না।
• এই রোগের আর এক উপসর্গ হেভি মেন্সট্রুয়াল ব্লিডিং বা প্রচুর রক্তক্ষরণ।
• প্রস্রাব বা মলত্যাগের সময়ও ব্যথায় কাতর হতে হয়।
• যৌন সম্পর্কের সময় মারাত্মক ব্যথা ও যন্ত্রণা হয়।
• তলপেট ছাড়াও কোমরে ব্যথা করে।
• ঋতু চলাকালীন স্বাভাবিক জীবন যাপন করা অসহ্য হয়ে ওঠে। স্কুল কলেজ বা অফিস যাওয়া বন্ধ করে বাড়িতে শুয়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না।
• এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে বন্ধ্যাত্বর ঝুঁকি রয়েছে।
প্রতি মাসে যদি একই সমস্যা চলতেই থাকে, তাহলে আল্ট্রাসোনোগ্রাফির সাহায্যে ডিম্বাশয় ও জরায়ু খুঁটিয়ে দেখা হয়, বললেন পলি দেবী। যদি ডিম্বাশয়ে সিস্ট দেখতে পাওয়া যায়, সন্দেহ হলে ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে খুঁটিয়ে দেখা দরকার। কারণ পলিসিস্টিক ওভারি হলে সিস্টগুলি খুব একটা সমস্যা সৃষ্টি করে না। কিন্তু যদি দেখা যায় যে সেগুলি রক্তে পরিপূর্ণ তাহলে বুঝতে হবে অসুখটা এন্ডোমেট্রিওসিস। রোগীর সঙ্গে কথা বলে সম্ভব হলে একই সিটিং-এ ল্যাপারোস্কোপির সাহায্যে এগুলি নির্মূল করে ফেলতে হবে। নইলে একদিকে কষ্ট বাড়বে, অন্যদিকে অ্যাডহেশন হবার সম্ভাবনা বাড়বে। অর্থাৎ ওভারি, ইউটেরাস, ফ্যালোপিয়ান টিউব ইত্যাদি জড়িয়ে গিয়ে জটিলতা বেড়ে যেতে পারে।
ওষুধে কাজ না হলে সার্জারি
এন্ডোমেট্রিওসিস ধরা পড়লে ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করলে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। নতুন কিছু ওষুধের সাহায্য নিয়ে রোগের কষ্ট কমানো যায়। অনেক সময় পিলের সাহায্যে অসুখ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অবিবাহিত মেয়েদের কন্ট্রাসেপটিভ পিল নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকে ভয় পান। মনে রাখতে হবে, এটা নেহাতই একটি ওষুধ। বাড়াবাড়ি হলে অস্ত্রোপচার করানো দরকার। অস্ত্রোপচারের ব্যাপারে ভয় পেলে চলবে না। আবার অনেক সময় এন্ডোমেট্রিওসিসের কষ্ট সহ্য করতে করতে ডিপ্রেশন হতে পারে। বাড়ির লোকজনের সহমর্মিতা ও দরকার হলে কাউন্সেলিং করাতে হতে পারে। করোনার ভয়ে অসুখ চেপে না রেখে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন, ভাল থাকুন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy