Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪

বডি শেমিংয়ের প্রতিরোধ হোক হাসিমুখে

আমার এই মাথাব্যথায় অন্য মানুষটি কতটা অস্বস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন, তা নিয়ে দু’বার ভাবি না। এখনও বৌ কালো বলে তাঁকে বাড়িছাড়া করতে পারে স্বামী।

‘দম লাগা কে হাইসা’ ছবির পোস্টার। এই সিনেমায় বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছিলেন নায়িকাও।

‘দম লাগা কে হাইসা’ ছবির পোস্টার। এই সিনেমায় বডি শেমিংয়ের শিকার হয়েছিলেন নায়িকাও।

অন্বেষা দত্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০২০ ০২:৪২
Share: Save:

‘আমাকে রোগা বোলো না’... সেই কবেই তো বলে দিয়েছিল চন্দ্রবিন্দু। তার পরে অন্তত বছর কুড়ি পেরিয়ে গিয়েছে। তাতে কিছু বদলেছে নাকি? কে মোটা, কে বেঁটে, কে কালো, কার নাক খাঁদা, কার মাথায় টাক— এই নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা তো এখনও যেমন কে তেমন।

আমার এই মাথাব্যথায় অন্য মানুষটি কতটা অস্বস্তির মুখোমুখি হচ্ছেন, তা নিয়ে দু’বার ভাবি না। এখনও বৌ কালো বলে তাঁকে বাড়িছাড়া করতে পারে স্বামী। এখনও দেখতে-শুনতে তেমন নয় বলে মেয়েদের বিয়ে ‘হয়’ না। আর এই ‘হেনস্থার’ ক্ষেত্রে কোনও লিঙ্গ বৈষম্যও নেই। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে রোগা চেহারার পুরুষ ততটা পুরুষালি নন। মাথায় চুল না থাকলে তাঁর দর কমে যাবে হুড়হুড়িয়ে।

এই রকম ‘বডি শেমিং’-এর জেরে কত মানুষ গভীর অবসাদের শিকার হন, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু আমাদের আলাপচারিতায় এই ধরনের মন্তব্য জলভাত। এমন কথা বলার সময়ে আমরা ভেবে দেখি না যে, শারীরিক ভাবে ‘নিখুঁত’ হওয়ার দায় নিয়ে কেউ জন্মায়নি।

অথচ আমাদের কুশল-বিনিময়ের প্রথম বাক্যগুলোই ঘিরে থাকে ‘এ মা, কী রোগা হয়ে গিয়েছিস’ অথবা ‘ইস, এত মোটা হচ্ছিস কেন’ জাতীয় কিছু মন্তব্যে। সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ধরনের অবসাদের শিকার, অল্পবয়সি অনেকেই আসেন তাঁর কাছে। অনুত্তমা বললেন, ‘‘ওঁদের একটা জিনিস বোঝাতে হয়। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কেমন লাগে, সেটা নিজের চোখ দিয়ে দেখুন। সমাজের চোখ দিয়ে নয়। সমাজ যতই চেষ্টা করুক কোনও এক ফ্রেমে বেঁধে ফেলার, তাতে নিজেকে আটকে ফেলার কোনও অর্থ নেই।’’

এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজস্বীর হাতছানি একটা বড় সমস্যা। সকালে কী খেলাম আর কী খেয়ে শুতে গেলাম, সব তথ্য পৌঁছতেই হবে। বাজারসর্বস্ব দুনিয়ারও তাতে সুবিধা। মোবাইল ক্যামেরার খুঁটিনাটি পাল্টে গেল শুধু নিখুঁত নিজস্বীর তাগিদে। মনের রোগটাও যে সঙ্গে সঙ্গে জাঁকিয়ে বসল, বুঝলাম না আমরা।

‘সমাজের চোখে’ না দেখে কেউ যখন নিজেকে ভালবাসার চেষ্টা করে? নিস্তার নেই। সেলিব্রিটি হলে আপনি ট্রোলড হবেন আর না-হলে পাড়াপড়শি জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে! সেলিব্রিটি হিসেবে এমন ট্রোলিংয়ের যথাযথ জবাব দিয়েছিলেন বলিউড অভিনেত্রী সমীরা রেড্ডি এবং টলিউডের স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। তাঁদের দু’জনকেই মা হওয়ার পরে সৌন্দর্যে খামতি নিয়ে আক্রমণ করেছিল নেটিজ়েনরা। সমীরা বলেছিলেন, ‘‘যখন তোমার জন্ম হয়েছিল, তোমার মা কি হট ছিলেন?’’ স্বস্তিকা বলেছিলেন, ‘‘আমি বাচ্চাকে স্তন্যপান করিয়েছি। তার জন্য আমি গর্বিত।’’ কেন সৌন্দর্যের মাপকাঠি ও ভাবেই ঠিক করতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি।

চরিত্রের প্রয়োজনে ‘স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য’ বজায় রাখতে হয় জানিয়ে অভিনেতা আবীর চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘স্কুল-কলেজে আমরাও বন্ধুবান্ধবদের মোটা বলে খেপিয়েছি। কিন্তু সেটা কী ভাবে বলা হচ্ছে এবং মাত্রাছাড়া হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখা উচিত।’’ তাঁর কথাতেও, ‘‘নিজেকে ভালবাসতে হবে। আত্মবিশ্বাসী হলে যে যা-ই বলুক, কিছু আসে যায় না।’’

‘রোগা বোলো না’— কুড়ি বছর আগে গানটা বেঁধেছিলেন যাঁরা সেই ‘চন্দ্রবিন্দুর’ সদস্য উপল সেনগুপ্ত বললেন, ‘‘কিছু জিনিস মজা থাকলেই ভাল। সব সময়ে পলিটিক্যালি কারেক্ট থাকা মুশকিল।’’ উপল আশাবাদী, এখন দেখার চোখ অনেকটাই বদলেছে। তাঁর কথায়, ‘‘মোটা হলেও সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন কত জন। কালো হয়েও মডেল হচ্ছেন অনেকে। সব কিছুর মধ্যে সৌন্দর্য আছে। সেই অনুভূতিটা থাকলেই হল।’’

সেটা মনে করাচ্ছেন অনুত্তমাও। তাঁর মতে, ‘‘বডি-শেমিংয়ের প্রতিরোধটা যদি হাসিমুখে করা যায়, কাজ দেবে। অর্থাৎ কেউ যদি বলেন, ‘ইস আগে কী সুন্দর ছিলি, এখন এমন কালো হয়ে গেলি!’ তাঁকে হেসে বলা যায়, ‘তাই নাকি, কই তখন তো বলোনি!’ অথবা শুধু বুঝিয়ে দেওয়া, ওই মন্তব্যে আমি স্বচ্ছন্দ নই।’’

নতুন বছর থেকে কুশল বিনিময়টা যাতে শারীরিক-সৌন্দর্য নির্ভর না হয়, দেখতে পারি আমরা?

অন্য বিষয়গুলি:

Society Body Shaming
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy