সরস্বতী পুজোর কথা মনে পড়লেই আমার ফেলে আসা মফস্সল শহরের কথাই মনে আসে আগে। মনে পড়ে অন্যান্য পুজোর বাইরে এই পুজোটাই ছিল একমাত্র অল্পবয়সিদের রাজত্ব! আমাদের মফস্সলে জানুয়ারির প্রথম থেকেই সরস্বতী পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত। নানা রকম থিমের প্যান্ডেল হত। সেই নিয়ে চাপা রেষারেষিও চলত ক্লাবগুলোর। স্কুলের পুজো ছিল পাড়ার পুজোর চেয়ে আলাদা। পুজোর আগে আশপাশের স্কুলে গিয়ে কার্ড দিয়ে নেমন্তন্ন করার রীতি ছিল। এই কাজটা করত উঁচু ক্লাসের ছেলেরা। আর সেটা নিয়েই লাগত ঝামেলা। কাছের দুটো-তিনটে গার্লস স্কুলে কে যাবে নেমন্তন্ন করতে?
আমাদের ছিল বয়েজ় স্কুল লাঞ্ছিত জীবন। ওই উঠতি বয়সে মেয়েদের মনোযোগ পাওয়ার একটা আগ্রহ থাকতই। তাই গার্লস স্কুলে নেমন্তন্ন করতে যাওয়া নিয়ে একটা প্রতিযোগিতা চলত। আমাদের সায়েন্সের ছেলেরা বিশেষ সুবিধে করতে পারত না সেখানে। কমার্সের অপূর্বকান্তি বা অপু এই কাজে সকলকে টেক্কা দিত প্রতিবার। তো সেই চুরানব্বইয়ের পুজোয় কার্ড নিয়ে অপু গেল কাছের এক গার্লস স্কুলে নেমন্তন্ন করতে। পরের দিন স্কুলে গিয়ে দেখি অপুর মুখে সে কী হাসি! কী কেস? না, একজনকে অপুর খুব ভাল লেগেছে! রোগা, ফর্সা, হাই পাওয়ারের চশমা পরা একটি মেয়ে। মেয়েটি নাকি হেসে একবার অপুর দিকে তাকিয়েওছে! ব্যস, অপু আউট।
অনেক প্ল্যান করে পুজোর আগের দিন অপু ঠিক করেছিল একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কারণ চতুর্দিকে এমন অনেক অপু ঘুরে বেড়াচ্ছে! বলা তো যায় না কে আগে উদ্যোগ নিয়ে ফেলে! অপু একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল গার্লস স্কুলের থেকে একটু দূরে। তার পর সেই রোগা ফর্সা মেয়েটিকে দিয়েছিল চিঠিটা।
পরের দিন সরস্বতী পুজো। সেই গার্লস স্কুলের হেড দিদিমণি হাজির। সঙ্গে সেই ফর্সা, হাই পাওয়ারের চশমাও। অপুর তো হাসি আর ধরে না! কিন্তু তার পরের দৃশ্যে আমরা দেখলাম এক দিকে পুজোর মন্ত্রপাঠ হচ্ছে আর অন্য দিকে হেড স্যর বেত হাতে অপুর পিছনে ছুটছেন! আসল ব্যাপার হল, অপু যাকে লাভ লেটার দিয়ে এসেছে সে ওই স্কুলে নতুন জয়েন করা বায়োলজির ম্যাডাম! স্কুলের মেয়েদের নীল শাড়ির সঙ্গে ম্যাডামের নীল শাড়ি গুলিয়ে ফেলেছিল অপু!
পুজোর আগের রাতটাও ছিল মজার। ঠাকুর আসত সন্ধে করে। পাড়ার মেয়েরা আলপনা দিত প্যান্ডেলের সামনে। ছেলেরা প্যান্ডেল সাজাতে ব্যস্ত থাকত। তার মধ্যেই একে অপরকে দেখা, টুকটাক কথাবার্তা চলত। আমরা বলতাম, “ওই দ্যাখ ঝাড়ি মারছে!”
মনে আছে, আমাদের বন্ধু দীপঙ্করের ভাল লাগত ইংলিশ ব্যাচের তনুশ্রীকে। স্যর বা গুরুজনদের সামনে দীপু সরাসরি কিছু বলতে পারত না। কিন্তু ও দিকে প্যান্ডেলের সামনে তনুশ্রী হয়তো আলপনা দিচ্ছে আর দীপু তাকিয়ে দেখছে।
আমার বন্ধু শোভন হয়তো বলল, “ঠাকুরটা দেখেছিস? কী সুন্দর, না?”
দীপু দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তনুশ্রীর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিত, “সে আর বলতে!”
আরও রাতের দিকে চলত ফল আর ফুল চুরির অভিযান। কাদের বাড়িতে ফলগাছ, ফুলগাছ আছে সে সব নখদর্পণে থাকত দামালদের! আর ছিল কুল খাওয়া নিয়ে বাধানিষেধ। সরস্বতী পুজোর আগে কুল খেতে নেই। খেলে ঠাকুর পাপ দেবেন! বড় হওয়ার পরে ধীরে ধীরে অনেক কিছুর মতো এটাও কেটে গিয়েছিল।
পুজোর দিনটা ছিল আলোয় ভরা। সকালে উঠে কাঁচা হলুদ দাঁতে কেটে স্নান করতে হত। তার পর অধিকাংশ মেয়েরা শাড়ি আর ছেলেরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেরোত! অঞ্জলি দেওয়া, প্যান্ডেল ঘুরে ঠাকুর দেখা, স্কুলে বা বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে খিচুড়ি খাওয়ার সে ছিল এক স্বর্গীয় দিন! আর ছিল ভীরু পায়ে পছন্দের মেয়েটির পাশাপাশি বা সামান্য দূরত্বে হেঁটে যাওয়ার আনন্দ! তবে কেউ কেউ ছিল সাহসী।
দীপেনদার সঙ্গে প্রেম ছিল পুতুলদির। কিন্তু দুই বাড়িতে বিরাট ঝামেলা। কারণ দীপেনদার বাবা নামকরা মাতাল। তাই পুতুলদির বাড়িতে এই সম্পর্ক মেনে নেয়নি। দীপেনদা কাজ করত ধানবাদের কোনও এক কোলিয়ারিতে। সামনের ফাল্গুনে পুতুলদির বাবা, আমাদের নিখিল জেঠু, পুতুলদির বিয়ে ঠিক করেছিল। ফলে পুতুলদির বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ! আমরা আঁকা শিখতে যেতাম পুতুলদির কাছে, সেটাও বন্ধ। মানে বাইরের জগতের থেকে পুতুলদি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন! এমন অবস্থায় পুজোর সপ্তাহখানেক আগে দীপেনদা এসে হাজির!
তার পর পুজোর দিন এল। পুতুলদির বাড়িতে পুজো করতে গেল পাড়ার বাবুদা। স্কুলের পিওন বাবুদা পুরোহিত হিসেবেও কাজ করত। পুজো শেষ করে বাবুদা চলে গেল। আমরা দোতলায় প্রসাদ খেতে বসেছি। নিখিল জেঠু তদারক করছেন। ঠিক অমন সময় বাবুদা নীচের রাস্তা থেকে পুতুলদিকে ডাকল, “এই পুতুল ওই ভুজ্জির ব্যাগটা রেখে গিয়েছি। একটু দিয়ে যা তো!” জেঠু বলল, “দিয়ে আয়। বাবুটা বড্ড কেয়ারলেস!” পুতুলদি ব্যাগ নিয়ে নীচে গেল। কিন্তু আর উঠল না! মিনিট দশেক পরে জেঠুর খেয়াল হল, মেয়ে কই! মেয়ে যে নেই! কারণ ততক্ষণে সর্দার সিংহের হলুদ-কালো ট্যাক্সি করে দীপেনদা আর পুতুলদি হাওয়া! বছর চারেক পুতুলদিদের দেখা নেই। তার পর এমনই এক সরস্বতী পুজোর দিনে দেখলাম দীপেনদা আর পুতুলদি ফিরে এসেছে পাড়ায়। আর ওদের ছোট্ট ছেলেকে ঠাকুরের সামনে হাতেখড়ি দেওয়াচ্ছে নিখিল জেঠু। সে দিন কী সুন্দর রোদ উঠেছিল আমাদের মফস্সল জুড়ে!
এখন আমাদের শহরে, পাড়ায় পাড়ায় পুজো হয়। স্কুলে, গান বা নাচের স্কুলেও পুজো হয়। কিন্তু এখানে কি রাত জেগে সে ভাবে আলপনা দেওয়া হয়? প্যান্ডেল সাজানো হয়? আর ফুলচুরি?
এখন পুজোর দিনে আমার কন্যা শাড়ি পরে স্কুলে যায়! তার পর সেখান থেকে ফিরে নাচ-গানের স্কুলেও যায়। সবার সঙ্গে গল্প করে, গান গায়। একসঙ্গে বসে প্রসাদ খায়। ছবি তোলে। আমি ওদের দূর থেকে দেখি। ছেলেমেয়েরা কী সুন্দর নিঃসংকোচে মিশছে! আমার মনে পড়ে আমাদের সেই ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সময়ের কথা। ওদের দেখে মনে হয় সময় বড় দয়ালু! আবার নিজেকে দেখে মনে হয় সময় বড় নিষ্ঠুরও!
আমি দূর থেকে ওই ভিড়ের মধ্যে দীপুকে খুঁজি! খুঁজি তনুশ্রীকে। আর ভাবি এখনও দীপু-তনুশ্রীরা কি ওই ভাবে বেঁচে আছে! অপুরাও কি আছে? কিংবা কোনও দীপেনদা কি এখনও পুতুলদির মতো কারও জন্য পুজোর দিনে দুঃসাহসী পৃথ্বীরাজ হয়ে ওঠে? ওয়টস্যাপের পৃথিবীর বাইরে এখনও কি কেউ কারও জন্য বসন্ত পঞ্চমীর সোনা-ঝরা আলোয় অপেক্ষা করে? শুধু একবার দেখবে বলে সারাটা বছর একাগ্র হয়ে থাকে? আশা রাখি এ সব এখনও হয়।
আর দেখুন, আবারও শীত শেষ হয়ে আসছে। আবারও চাঁদের আলোয় জেগে উঠছে নতুন বসন্তের কুঁড়ি। আবার প্যান্ডেল হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। অল্পবয়সি মেয়েটি উত্তেজনায় গোলাপি হয়ে উঠছে নিজে-নিজে প্রথম বার শাড়ি পরতে পারবে বলে! ভাবছে সেই ছেলেটি, জিনস কুর্তির বাইরে এমন শাড়িতে দেখে কী ভাববে ওকে! ছেলেটিও হয়তো প্রথম বার দাড়ি কামাবে। হয়তো প্রথম বার আফটারশেভের ঘেরাটোপে সুগন্ধের ছোট ছোট প্রজাপতি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়াবে কোনও প্যান্ডেলে! ভিড়ের মধ্যে মিশে অস্থির ও ভিতু চোখে খুঁজবে প্রথম বার শাড়ি পরা সেই মেয়েটিকে! এক মুহূর্তের জন্য সেলফি আর স্টেটাস আপলোড করা ভুলে গিয়ে হয়তো কোনও বকুল গাছের নীচে দু’জনে একটু সময়ের জন্য হলেও ফিরে যেতে চাইবে কোনও অ্যানালগ পৃথিবীতে। সেই পৃথিবী, যেখানে লেবুরঙা জ্যোৎস্নায় ডুবে থাকে চরাচর, যেখানে সামান্য হাতের স্পর্শই হাজার হাজার কথা বলে দেয় এক নিমেষে!
ছবি: দেবর্ষি সরকার; মডেল:রিয়াংশি সামুই; মেকআপ:প্রিয়া গুপ্ত; লোকেশন: কুমোরটুলি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)