সচেতনতার মাধ্যমেই রুখতে হবে স্তন ক্যানসার। ছবি: আইস্টক।
গোলাপি ফিতে, স্তন ক্যানসার বোঝাতে এই প্রতীক প্রথম ব্যবহার করেছিলেন অস্ট্রিয়ান আমেরিকান ইভলিন ল্যান্ডার। আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে। এই ফিতের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ব্রেস্ট ক্যানসারের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। নিজেও ছিলেন ক্যানসার সারভাইভার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-ও স্তন ক্যানসার নিয়ে যথেষ্ট ওকাকিবহাল। সারা বিশ্বের নানা ছোট-বড় শহরে স্তন ক্যানসার নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি জুড়ে নানা প্রচারসভার আয়োজন করছে তারা।
তেমনই এক প্রচারে সদর্থক ভূমিকা পালন করছেন কলকাতার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও ক্যানসার বিশেষজ্ঞরাও। তাঁদের মতে, ব্রেস্ট ক্যানসারের ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় ও সচেতনতার মূল চাবিটি থাকে আক্রান্তের কাছেই। ‘সেলফ ডিটেকশন’-ই সেরা অস্ত্র। হু-এর দাবি, ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ক্রমশই এই রোগ থাবা বসাচ্ছে।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুকুমার সরকারের মতে, ‘‘আজকাল এই রোগে আক্রান্তের বয়সসীমা বলে কিছু হয় না। আকছার ২০-৩০-এর ঘরের যুবতীরাও এই অসুখের শিকার হন। তবে ৩০-৫০ বছর বয়সিরা এই অসুখের শিকার হন সবচেয়ে বেশি। প্রথম থেকেই এই অসুখ নিয়ে সচেতন থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ব্রেস্টের সব লাম্প বা টিউমারে কিন্তু ক্যানসারের প্রবণতা থাকে না। বরং ১০-১৫ শতাংশ টিউমারেই এই ভয় থাকে, কিন্তু শরীরে তেমন কোনও লাম্প বাসা বেঁধেছে কি না তা জানতে বছরে এক বার অন্তত চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চেক আপ করানো উচিত।’’
আরও পড়ুন: বিকেলের ফাস্ট ফুড নষ্ট করছে ডায়েটের সব হিসেব? মেদ ঝরাতে সন্ধেয় খান এ সব
ভারতে এই ক্যানসার এত ছড়াচ্ছে কেন?
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ মার্থা হাজরার মতে, হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাসের হানার অন্যতম কারণ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। ভারতে প্রান্তিক অঞ্চল তো বটেই, এমনকি শহুরে এলাকাতেও অনেক সময় মেয়েদের নানা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকতে হয়। যৌনাঙ্গের পরিচর্যা করার উপায় বা সুযোগও খুব কম থাকে। এ ছাড়াও ভারতীয় মেয়েদের মধ্যে আজকাল ধূমপান ও মদ্যপানের প্রবণতা বেড়েছে। এতেও এই ধরনের মেয়েলি অসুখগুলো বেশি করে চেপে ধরছে। পিরিয়ডের সময় অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকা, দীর্ঘ ক্ষণ অন্তর্বাস বদলানোর উপায় না পাওয়া— এগুলোও রোগ বওয়ার ছোট-বড় নানা অনুষঙ্গ হিসেবে উঠে আসছে।
এ ছাড়া সচেতনতার অভাবও এর জন্য দায়ী। তাই বছর বছর নানা প্রচার অভিযান সত্ত্বেও এই রোগ কমছে না। তবে শুধু রোগীকে দায়ী করেও লাভ নেই। ভারতীয় গ্রামগুলোয় বা ছোটখাটো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এই অসুখ পরীক্ষা করার মতো পরিকাঠামো ও চিকিৎসকও থাকেন না।
ক্যানসার মানেই প্রচুর খরচ, অনেক হয়রানি— এই ধারণা গেঁথে রয়েছে মনে। তাই অনেক পরিবারই এই অসুখ ধরা পড়লে বিকল্প চিকিৎসা বা অল্টারনেটিভ মেডিসিনে ভরসা করতে শুরু করেন। অনেক সময় এটি থেকেও রোগ বড় আকার ধারণ করে।
ভারতীয় মহিলারা অফিস সামলে, ঘরের কাজ করে নিজের দিকে তাকান না খুব একটা। যেটুকু যত্ন তাঁদের দরকার, সেটুকুতেও থেকে যায় খামতি। ব্যায়াম, ডায়েট, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ, ধূমপান-মদ্যপান এগুলোও ফ্যাক্টর।
বয়স একটা বড় রিস্ক ফ্যাক্টর। ইদানীং মানুষের গড় আয়ু অনেক বেড়েছে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তন ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়ে। আর এই কারণেই ইদানীং স্তন ক্যানসারও বাড়ছে।
দেরিতে বিয়ে বা বিয়ে না করা কিংবা সন্তান না হওয়া স্তন ক্যানসার ডেকে আনতে পারে। অল্প বয়সে মেনার্কি অর্থাৎ পিরিয়ড শুরু হওয়া এবং বেশি বয়সে মেনোপজ হলে দীর্ঘ দিন ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে সহবাস করতে হয়। ইস্ট্রোজেন ক্যানসারের রিস্ক বাড়ায়। সন্তানকে ব্রেস্ট ফিডিং না করালেও ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে।
বংশে এর আগে কোনও মহিলার ব্রেস্ট বা ওভারি ক্যানসার থাকলে ঝুঁকি বেশি। বিএআরসিএ ১, ও বিএআরসি ২, জিন থাকলে ব্রেস্ট ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি।
আরও পড়ুন: স্ট্রোক মানেই মৃত্যু নয়, কী করলে বাঁচবে রোগী?
কী দেখে বুঝব?
প্রতি দিন স্নানের সময় স্তন ধরে যাচাই করতে হবে কোথাও কোনও লাম্প তৈরি হচ্ছে কি না। ব্যথাহীন লাম্পই বেশি মারাত্মক। ব্রেস্ট লাম্পগুলি অনেক সময় আন্ডার আর্ম বা কলার বোনের তলায় দেখা যায়। স্তনবৃন্তের আশপাশেও এই ধরনের লাম্প থাকে, যেগুলি টিপলে শক্ত লাগে এবং অবস্থান পরিবর্তন করে না। ব্রেস্ট ফিডিং করাচ্ছেন না, অথচ স্তনবৃন্ত থেকে অল্প অল্প দুধের মতো জলীয় পদার্থ ক্ষরিত হচ্ছে দেখলে সচেতন হোন। অন্য কোনও অসুখ ছাড়াই কাঁধ এবং ঘাড়ে ব্যথা হলেও সাবধান। এগুলি ব্রেস্ট ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে, কারণ এই ক্যানসার স্তন থেকে খুব সহজেই ছড়িয়ে পড়ে শরীরের এই অংশগুলিতে। স্তনে কোনও রকম র্যাশ ছাড়াই চুলকানির অনুভূতি এলে চিকিৎসককে জানান। স্তনে বিকৃতি বা ফোলা ভাব, স্তন লালচে হয়ে যাওয়া, স্তনে হাত দিলে ব্যথা লাগা এই রোগের লক্ষণ। তবে পিরিয়ডের আগে অনেকের স্তন ভারী হয় ও ব্যথা হয়। এতে ভয়ের কিছু নেই। স্তনবৃন্ত হল স্তনের সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ। স্তনবৃন্ত স্পর্শ করলেও যদি তেমন কোনও অনুভূতি না হয় বা অনুভূতিহীন হয়ে যায় তবে তা ব্রেস্ট ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা খুবই বেশি। স্তনের উপরের ত্বক খসখসে হয়ে যাওয়াও ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ। রাতে শোওয়ার সময় স্তনে ব্যথা বা অন্তর্বাস পরে থাকার সময় ঘর্ষণ বা ছড়ে যাওয়ার মতো অনুভূতি হলে চিকিৎসকের শরণ নিন।
আরও পড়ুন: অনিয়মে শরীরে ঢোকা ক্যালোরি আটকে মেদ রুখতে ভরসা রাখুন এ সবে
স্তন ক্যানসার নিয়ে মিথ
অনেকেই মনে করেন, স্তনবৃন্ত থেকে হলদেটে তরল নিঃসৃত হলে তবেই তা ক্যানসারের লক্ষণ। এ ধারণা ঠিক নয়। ব্রেস্ট ফি়ডিং করান না, এমন কারও স্তন থেকে দুধের মতো সাদা তরল নির্গত হলেও তা অসুখের বার্তাবাহক হতে পারে। ব্যথাহীন লাম্পকে পাত্তা দেন না অনেকেই। অথচ, চিকিৎসকদের দাবি, ব্যথাহীন লাম্পই বেশি ভয়ের। বরং ব্যথাযুক্ত লাম্পে ম্যালিগন্যান্সি থাকে না। আবার এও ঠিক, লাম্প মানেই কিন্তু ক্যানসার নয়। স্তনে উপস্থিত লাম্পের মাত্র ১০-১৫ শতাংশ লাম্প ম্যালিগন্যান্ট। স্তন বাদ যাবে, এই ভয়ে অনেকেই চিকিৎসা করান না, অল্টারনেটিভ মেডিসিনে আস্থা রাখেন। খুব দরকার না পড়লে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয় না।
(গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy