জন্মের পর থেকে কিছুতেই মা বা পরিবারের কারও চোখে চোখ মেলাত না অহন। বাড়িতে কেউ এলে মিশতে পারত না। প্রথমে মা-বাবা ভেবেছিলেন, কথা জড়িয়ে যাওয়ার কারণে ঘরকুনো হয়ে পড়ছে ছেলে।
কোনও ভাবেই ঘরে আটকে রাখা যেত না সুবর্ণকে। সবাই ভেবেছিল, ছোটবেলায় ছেলেরা সাধারণত দামালই হয়। কিন্তু বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্যা বাড়তেই থাকল।
মোহনাকে বড় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন অভিভাবকেরা। একটা সময়ের পরে প্রত্যেক পরীক্ষায় কম নম্বর আসতে শুরু করল। বাড়ির লোকের মনে হল, মেয়ে বুঝি ইচ্ছে করেই অমনোযোগী হচ্ছে।
ঘটনা তিনটি আলাদা। অথচ অনেকেই সন্তানকে নিয়ে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। গোড়ার দিকে যদিও বা স্পষ্ট করে বোঝা সম্ভব হয় না, তা জোরালো হয় সন্তানের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে।
জন্মের পর থেকেই কিছু শিশুর প্রয়োজন হয় বিশেষ মেডিক্যাল, মানসিক ও শারীরিক যত্নের। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন থেকে একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে ২৭টি ডিজ়র্ডারের কথা। সেই ডিজ়র্ডারের লক্ষণ অনুযায়ী কোনও একটি দেখা দিলে তাকে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বলা হয়। এই তালিকা মান্যতা পেয়েছে সারা বিশ্বে। অটিজ়ম, অ্যাসপার্জার সিন্ড্রোম, সেরিব্রাল পলসি, ডাউন সিনড্রোম, ডিসলেক্সিয়া, ব্লাইন্ডনেস, ডেফনেস, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ক্লেফ্ট লিপ্স, মিসিং লিম্ব... রোগের নাম অনেক। সমস্যা এবং লক্ষণও ভিন্ন। শারীরিক বৃদ্ধি হলেও মানসিক ভাবে সে হয়তো আটকে যায় চার বছর বয়সেই। জন্মগত ভাবে প্রতিটি মানুষের আইকিউ (ইন্টেলিজেন্ট কোশেন্ট) থাকে। বিশেষ পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝা যায় সন্তানের আইকিউ কেমন। নিরীক্ষাগত ভাষায় আইকিউ যদি ২০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তা হলে শিশুটির অতিরিক্ত যত্নের প্রয়োজন পড়ে।
ধরা থাকুক হাত
‘তারে জ়মিন পর’ ছবিতে ঈশান ডিসলেক্সিয়ার শিকার। পড়তে বসলেই অক্ষর গুলিয়ে যেত, কখনও কল্পনায় ভর করে সে সব অক্ষর নাচানাচিও করত। অথচ তার কলম-তুলি থেকেই এমন সব আঁকা তৈরি হয়েছিল, যা অত ছোট শিশুর পক্ষে অভাবনীয়। মাইকেল ফ্যারাডে, স্টিভেন স্পিলবার্গ, সালমা হায়েক... নিজেদের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এমন অনেক মানুষই ডিসলেক্সিয়ার শিকার। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষরা করতে পারেন বিশ্বজয়। তার উজ্জ্বল উদাহরণ হেলেন কেলার। তাই সন্তানের বিশেষ আগ্রহ বা গুণ কী, সেটা খুঁজে বার করুন। সেটি বিকশিত করার হাত বাড়িয়ে দিন। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ ‘বিশেষ’ হয়ে উঠবে নিজের গুণেই।
সমস্যার গোড়ায়
জিনগত কারণে সন্তান বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হতেই পারে। আবার গর্ভাবস্থায় ভ্রুণের বা জন্মের পরে শিশুর মস্তিষ্কে আঘাত লাগলেও সমস্যা হতে পারে। অতিরিক্ত মদ্য ও ধূমপান, মাত্রাতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, প্রি-ম্যাচিয়োর ডেলিভারি, মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, ক্রোমোজ়োমের সমস্যা ইত্যাদিকেও বাদ দেওয়া যায় না। তবে ইদানীং স্ট্রেস বা মানসিক চাপও একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অলকেন্দু বোধ নিকেতন রেসিডেন্সিয়ালের প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটর কাবেরী শীল বললেন, ‘‘দেখা গিয়েছে, মা কনসিভ করার পরে বাবা হয়তো ক’মাসের জন্য বিদেশে গিয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে সমস্যা নেই, অথচ দূরে থাকার ফলে অতিরিক্ত চাপ নিয়েছেন মা। ফলে প্রভাব পড়েছে সন্তানের উপরে। এ-ও দেখা গিয়েছে যমজ বাচ্চার দু’জনেই স্পেশ্যাল হয়েছে।’’
কী ভাবে সামলাবেন?
সন্তান আর পাঁচটা শিশুর চাইতে আলাদা হলে পরিবারের তা মেনে নিতে অসুবিধে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দায় এসে পড়ে মায়ের উপরে। আবার অনেক সময়ে মা হয়তো ধৈর্য হারান সন্তানের উপরেই। অথচ সবচেয়ে বেশি ধৈর্য জরুরি পরিবারের তরফে। শিশু পরিচিত ক্ষেত্রের মধ্যেও অনেক সময়ে নিজের আলাদা পরিসর তৈরি করে নিতে চায়। অযথা সেই ব্যক্তিগত পরিসর ভাঙবেন না। তবে তার চারপাশে নিজের গড়ে তোলা দেওয়ালের মধ্যে আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা করুন। হতেই পারে, সন্তান অ-আ-ক-খ, এ-বি-সি-ডি শিখে উঠতে পারছে না। বারবার চেষ্টা করেও যদি সাধারণ বিষয়গুলি শিখতে না পারে, শিশুটির সঙ্গে জোর জবরদস্তি না করে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। আইকিউ পরীক্ষার মাধ্যমে বুঝতে সুবিধে হবে, সন্তান মাইল্ড, মডারেট, সিভিয়র না কি প্রোফাউন্ড... কোন পর্যায়ে রয়েছে। সেই অনুযায়ী শুরু হবে থেরাপি।
একটা কথা জেনে রাখা প্রয়োজন, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রত্যেকটি বাচ্চার মধ্যেই প্রকৃত অর্থে রয়েছে বিশেষ ক্ষমতা। যে ছেলেটি ঠিক মতো যোগ-বিয়োগ করতে পারে না, সে হয়তো অসম্ভব ভাল দাবা খেলে। কথা বলতে গেলে যে মেয়েটির শব্দ জড়িয়ে যায়, তার গান মুগ্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আপাত ভাবে যে বাচ্চার কোনও গুণই চোখে পড়ে না, তার মধ্যেও লুকিয়ে রয়েছে স্পেশ্যাল পাওয়ার। খেলা, আঁকা, নাচ, গান... এমনকি এ সবের কোনওটা না পারলেও শিশুটি হয়তো ভাবতে পারে। সেই চিন্তাশক্তির জোরে সে এমন জায়গায় পৌঁছে যায়, যেখানে পৌঁছতে পারে না অনেকেই। তাই শিশুর বিশেষ ক্ষমতাটি খোঁজা জরুরি। স্পেশ্যাল স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা সাহায্য তো করবেনই, আসল দায়িত্ব অভিভাবকদেরই নিতে হবে। সমস্ত কিছুর স্বাদ নিতে দিন তাকে। তা হলেই আপনি বুঝতে পারবেন, আসলে কোথায় লুকিেয় রয়েছে তার বিশেষ ক্ষমতা।
আবার বিশেষ কিছু বাচ্চার ক্ষেত্রে সাধারণ কাজই বড় ঝামেলার হয়ে পড়ে। যেমন দাঁত মাজা, হাত ধোয়া, খাবার মুখে তোলা, জামাকাপড় পরা ইত্যাদি। তখন তাদের সাহায্য করা মানে নিজেই কাজগুলি করে দেওয়া নয়। বরং হাতে ধরিয়ে প্রত্যেক দিন ওকেই দাঁত মাজতে, মুখ ধুতে দিন। খাবার খেতে গিয়ে যদি ছড়িয়ে একসা করে, তা হোক। নিয়মিত অভ্যেস করলে একদিন নিজেই সে পারবে।
এমনও বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ থাকে, যার শারীরিক বয়স হয়তো ১৮, কিন্তু মানসিক বয়স তিন কি চার। ফলে সে ব্যবহারও করে ওই বয়সি বাচ্চাদের মতো। তার শারীরিক বৃদ্ধি নয়, মানসিক বয়সের কথা ভেবেই তাকে ভালবাসুন, যত্ন নিন।
আবার হাইপার অ্যাক্টিভ বাচ্চাদের এক জায়গায় আটকে রাখাই দায়। রেসিডেন্সিয়াল ইনচার্জ শিবু দত্তের কথায়, ‘‘তেমন বাচ্চাকে গান শোনাই। সে শান্ত না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়ি না। এই হাল না ছাড়ার মানসিকতাও বাচ্চাটিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।’’
থেরাপিই আসল
অনেক সময়ে অটিস্টিক শিশু ‘এ ফর অ্যাপল’ জাতীয় বিষয় বুঝতে পারে না। কমিউনিকেশন গ্যাপের জন্য সমস্যা তৈরি হয়। সাইকোলজিস্ট আত্রেয়ী দত্ত বলছেন, ‘‘তখন একটি লাল আপেল এনে শিশুটিকে দেখিয়ে বোঝাতে হয় যে, এটিই আপেল বা লাল রং এটিই। শব্দ দিয়ে নয়, প্রত্যক্ষ ভাবে চোখের সামনে দেখলে তা মনে থাকে শিশুর।’’ আঁকার মাধ্যমে শিশুর মনের দ্বার উন্মুক্ত হয়।
আবার যাদের অঙ্গচালনায় সমস্যা হয়, তাদের জন্য হাইড্রোথেরাপি খুব কাজের। এ ক্ষেত্রে পাশাপাশি তিনটি পুল থাকে— সাধারণ উষ্ণতা, ঠান্ডা ও গরম জল। প্রত্যেক ধরনের জলে তাদের নামিয়ে অনুভূতি বাড়ানোর কাজ করানো হয়। এ ছাড়াও স্পিচ থেরাপি, স্পেশ্যাল এডুকেশন, মিউজ়িক, আর্ট অ্যান্ড ক্রাফ্ট, ক্লে মডেলিং, মাল্টি সেনসরি ট্রেনিং... থেরাপি হয় নানা ধরনের।
আবার অনেক সময়ে দেখা যায়, কোনও শিশুর বিশেষ নজর দরকার অল্প সময়ের জন্য। তাদের জন্য আছে অন্য ব্যবস্থা। সন্তানেরা উন্মুক্ত পৃথিবীতে বড় হোক, লক্ষ্য সেটাই। ফলে সামান্য অসঙ্গতি ধরা পড়লেই যে স্পেশ্যাল স্কুলে পড়তে হবে, তা কিন্তু নয়। তখন সপ্তাহের চার দিন বাচ্চাটি স্কুলে গেল। এক দিন স্পেশ্যাল স্কুলে বিশেষ যত্ন নেওয়া হল।
স্বনির্ভরতা
সমাজে ধীরে ধীরে বাড়ছে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন শিশুর সংখ্যা। অথচ তারাও চাইলে স্বনির্ভর হয়ে উঠতে পারে। এমন বেশ কিছু সংস্থা রয়েছে, যেখানে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের কার্পেন্ট্রি, উইভিং, ক্যান্ডল মেকিং, নিটিং, টেলারিং, ডল মেকিং শেখানো হয়। পরে কর্মশালায় তৈরি জিনিস নানা প্রদর্শনীতে বিক্রি করা হয়। রোজগারের পথ খুলছে তাদেরও।
সাহায্যের হাত
ধৈর্য বা সহযোগিতা শুধু নয়, চাইলে আরও বেশি কিছু করা যায়। যেমন রয়েছে দু’বছরের একটি কোর্স। সেই কোর্সের কো-অর্ডিনেটর শ্রেয়শ্রী কুণ্ডু বলছেন, ‘‘ডিপ্লোমা ইন স্পেশ্যাল এডুকেশন (মেন্টাল রিটার্ডেশন) পড়ার আগে মন তৈরি করা চাই। হতেই পারে যে, শিশুটিকে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত শেখানোর কথা। কিন্তু তাকে শেখানো গেল মাত্র ৩ পর্যন্ত। কিন্তু ওইটুকু শেখানোর সময়েও ধৈর্য হারালে চলবে না। ঠান্ডা মাথায়, তার মতো করেই তাকে শেখাতে হবে।’’
সচেতনতা
বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের দরকার তিনটি জিনিস— সহযোগিতা, ধৈর্য এবং সচেতনতা। বহু বছর ধরে তাঁদের নিয়ে কাজ করে চলা প্রদীপ রায় বলছেন, ‘‘সচেতনতা মানে কিন্তু বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন কাউকে দেখলে অহেতুক কৌতূহলী না হওয়া। এতে তারা আরও বেশি কুঁকড়ে যাবে। আবার একেবারে উদাসীন থাকলে উন্নতিই করতে পারবে না। তাই অবহেলা বা অতিরিক্ত আগ্রহ... কোনওটাই কাম্য নয়। সচেতন ভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ানো জরুরি।’’ আবার স্পেশ্যাল স্কুলে পড়ার পরে শিশুটি বাড়িতে গিয়ে ভুলে যেতে পারে। কারণ মা-বাবা হয়তো নিয়মিত অভ্যেস করাতে পারেন না। ফলে সেই সচেতনতাও জরুরি, যাতে সন্তানকে সব থেরাপি নিয়মিত অভ্যেস করে যেতেই হবে। কাবেরী শীল বলছেন, ‘‘স্পেশ্যাল চিলড্রেনের ক্ষেত্রে যে সমস্যা হয়, তা আদতে কোনও রোগ নয় যে, একদিন সেরে যাবেই। এগুলি আসলে শর্ত বা কন্ডিশন। নিয়মিত অভ্যেস ও ধৈর্যের মাধ্যমে সেই কন্ডিশন বা অবস্থার উন্নতি হয়।’’
সকলের সামান্য সহযোগিতার পরিবর্তে তারা যে শর্তহীন ভালবাসায় আঁকড়ে ধরে, তা তো অমূল্য রতন!
রূম্পা দাস
ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy