Advertisement
১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
tourism

এক ছুটে দাওয়াইপানি

ভোর ভোর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখব বলে শুয়ে পড়ব ভেবেছিলাম, কিন্তু না, চোখ আটকে রইল পাহাড়ের গায়ে সেই জোনাক জ্বলা আলোয়।

রূপসী: দাওয়াইপানি থেকে সকালের কাঞ্চনজঙ্ঘা ও রাতের দার্জিলিং। ছবি: লেখক

রূপসী: দাওয়াইপানি থেকে সকালের কাঞ্চনজঙ্ঘা ও রাতের দার্জিলিং। ছবি: লেখক

বিতান ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:২৭
Share: Save:

মাঝ রাতে অন্ধকার পথ চিরে মার্স রেড স্পোর্টস কারের পিছু নিয়েছে দুধ সাদা একটি এসইউভি। সকালের আলো ফোটার মধ্যে নির্দিষ্ট গন্তব্য শিলিগুড়ির উপকন্ঠে শালুগাড়া বন বাংলো। সেখান থেকে বেলা গড়ানোর আগে পৌঁছতে হবে দার্জিলিং-এর ঠিক উল্টোদিকের পাহাড়ে। যে পাহাড় থেকে সন্ধ্যা পেরোলেই গোটা দার্জিলিংকে নাকি দেখা যায় জোনাক জ্বলা আলোয়। আর বিহানবেলা তারও পিছনে জেগে ওঠে রূপসী কাঞ্চনজঙ্ঘা।

পরিকল্পনা করে ছুটি পাওয়া আমার পেশায় বিশেষ সম্ভব নয়। ছুটি পেলেও কাজ পিছু ছাড়ে না, তাই অফিস সেরে বেরিয়েছিলাম রাত ১১টা নাগাদ। মালদহ ছাড়াচ্ছি যখন ভোর হয়নি তখনও। প্রথম গাড়ির স্টিয়ারিং আমার হাতে, স্পিডোমিটারের কাঁটা ১২০তে বাঁধা। রাতের এই এক সুবিধা। অহেতুক যানজটের বালাই নেই। নির্ধারিত সময়েই শালুগাড়ায় ঢুকলেও সঙ্গের গাড়িটি খারাপ হয়েছিল। সেটি সারাতে বিকেল হয়ে গেল। আমার সঙ্গীরা অধিকাংশই সত্তরোর্ধ্ব। তাঁদের উৎসাহের অন্ত নেই। পড়ন্ত বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লাম কাঞ্চনজঙ্ঘা আর রাতের দার্জিলিংকে দেখার টানে পাহাড়ি গ্রাম দাওয়াইপানির পথে।

কালিম্পং-এর গা ছুঁয়ে পেশক চা বাগান হয়ে যখন ছ’মাইল পৌঁছলাম তখনই নজরে পড়ল ডানদিকে পাহাড় জুড়ে সেই জোনাক জ্বলা আলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে গাড়ির আলো নিভিয়ে সেই দৃশ্য দেখা – এখনও চোখ বুজলে যেন ভেসে ওঠে। আমরা যারা পাহাড়ে চাকার উপর সওয়ার হতে ভালবাসি তাদের কাছে উত্তর সিকিম বা লাদাখ কঠিন রাস্তা বলে বিবেচিত হলেও দাওয়াইপানি পৌঁছনোটা বেশি রোমাঞ্চকর ছিল। গাড়ি পাহাড়ের ঢালে নামছে মুহূর্তের জন্য হলেও দু’চাকায় ভর করে। অনেকটা, উঁচু দেওয়ালে মই হেলান দিয়ে রাখলে যেমন হয় কিছুটা পথ সেরকম। পিছনের গাড়ির চালক অরূপ ঠিক সামনে থাকা আমার গাড়ির ছাদটুকুও দেখতে পাচ্ছে না। উল্টোদিক থেকে একটা গাড়ি তো দূর, একজন হেঁটে এলেও জায়গা দেওয়ার মতো মাটি নেই। খাদ নেমে গিয়েছে সটান। পিছনের আসনে বসা বাবা-মা আঁতকে উঠছিলেন খাড়া নামতে গিয়ে চাকা স্লিপ করায়। আমিও জানি না কতটা নামতে হবে। শেষ অবধি পৌঁছলাম দীপক হোম স্টেতে। এখানে যসশান্তি, ললিতা, রঞ্জনা, কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো বেশ কয়েকটি হোম স্টে আছে। জায়গাটা ভুটিয়া বস্তি নামে পরিচিত। সব মিলিয়ে ১৩০ ঘর লোকের বাস। একটা সময় দার্জিলিঙের দুধ বাজারে দাওয়াইপানি থেকেই সবথেকে বেশি দুধ যেত। ঘরে ঘরে গরু ছিল। জঙ্গলের গা লাগোয়া এই গ্রামে এখন মাত্র ২৫টি ঘরে গরু আছে। সেগুলিও চরতে বেরোয় না। কারণ, এ গ্রামে চিতা আর ব্ল্যাক প্যান্থার এসে অনেক গরু টেনে নিয়ে গিয়েছে। এমনকি রাতে পথে একটি কুকুরও দেখা যায় না। কোনও না কোনও বাড়িতে আশ্রয় নেয় তারা।

দীপক হোম স্টে’র মালিক প্রমোদ ও শবনম ভাই বোন। চারটি ঘর বেশ ছিমছাম। কাচের জানালা দিয়ে বিছানা থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। অন্য হোম স্টেগুলোতেও তাই। গরম জলে হাত, মুখ ধুয়ে কফি আর পকোড়ার সঙ্গে রাতের দার্জিলিংকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম আমরা। কোনটা ম্যাল, কোনটা টাইগার হিল সব স্পষ্ট মাঝের নিকষ কালো অন্ধকার ছাপিয়ে। রাতের খাবার যেন অমৃত সমান মনে হল। ভোর ভোর কাঞ্চনজঙ্ঘাকে দেখব বলে শুয়ে পড়ব ভেবেছিলাম, কিন্তু না, সবার চোখ আটকে রইল সেই জোনাক জ্বলা আলোয়।

ভোরে ঘুম ভাঙল হালকা রুপোলি আলোয়। জানালা গলে আসছে সেই আলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি রুপোর পাতে মোড়া যেন কাঞ্চনজঙ্ঘা, ঠিক চোখের সামনে। মোবাইল, ক্যামেরা এসব খোঁজার কথা মনে আসেনি, শুধু অপলকে তাকিয়ে থেকেছি দীর্ঘক্ষণ। আমার আগেই অবশ্য মায়েরা উঠে পড়েছিল। মুগ্ধ সকলে। দাওয়াইপানি নামটাতেই বোঝা যায় এখানকার জল ভাল। বলা ভাল জল হাওয়া বেশ ভাল।

সারাটা দিন গ্রামের লোকেদের সঙ্গে কথা বলে তাদের জীবনযাপনে গল্প শুনে, তাদেরই হেঁসেলে ঢুকে কফি বানিয়ে খেয়ে মন্দ কাটল না। এ গ্রামে আলাদা করে কিছু দেখার নেই, দোকান বলতেও একটিই। কিন্তু শুধু কাঞ্চনজঙ্ঘা আর রাতের ওই জোনাক আলোই যেন মন আটকে রাখে এখানে। এক দিনের জন্য দাওয়াইপানি মোটেই ঠিক নয় মনে হলেও পেশাদার সাংবাদিকতার জীবন। কাজের চাপের কাছে সব ভাল লাগাকেই মাথা নোয়াতে হয়।

দিনের আলোয় যখন দাওয়াইপানি থেকে ফিরছি তখন রাতের সেই খাড়া রাস্তাটা দেখে মন বলল এ পথ যখন একবার এখানে এনেছে, আবারও আসবো, আসবোই।

অন্য বিষয়গুলি:

tourism Tourist Spots Dawaipani
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy