তন্বী সুন্দরীর দিকে তারিফের চোখে তাকাতেন সকলে। ছিপছিপে ফিগার, হিলহিলে কোমরের জন্য প্রশংসা কুড়োতেন পরিচিতদের। বিয়ে এবং বাচ্চা হওয়ার পর বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে মেদ এসে ভরে যেতে লাগল শরীরে। হারিয়ে গেল শরীরের সুদৃশ্য সব বাঁক। অন্যের চোখে আর দেখেন না সেই বাহবা-র ছায়া। হীনন্মন্যতা গ্রাস করতে থাকে মনে অন্দরে।
বছর বিয়াল্লিশের আবিরা চৌধুরী গৃহবধূ। ছেলে ক্লাস সিক্সে পড়ে। এতদিন চেহারাটা চমৎকার ধরে রেখেছিলেন তিনি। হঠাৎ করে গত এক বছরে ফুলেফেঁপে যা তা অবস্থা! রাস্তাঘাটে যাঁর সঙ্গেই দেখা হচ্ছে একই প্রশ্নের সামনে পড়ছেন— ‘‘এ কী! এত মুটিয়ে গেলে কী করে?” ক্রমশ মানসিক ভাবে গুটিয়ে যেতে থাকেন আবিরা। অনুষ্ঠানবাড়ি, আত্মীয়বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা এড়িয়ে যেতে থাকেন। সাজগোজ করাও ছেড়ে দেন।
বাঙালি মেয়েদের মধ্যে চল্লিশ পার করে মুটিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে শরীরের মধ্যপ্রদেশ স্ফীত হওয়ার প্রবণতা মারাত্মক। সেটা সম্ভবত বাঙালি ললনার শরীরের ধাত, খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়ামের প্রতি অনীহা এবং নিজের প্রতি যত্নের অভাবে। অনেকে বলে থাকেন, বয়স হলে স্বাভাবিক নিয়মে শরীরে একটু গত্তি লাগে, সেটা দেখতে মানানসইও লাগে। হয়তো তা কিছু অংশে সত্যি। কিন্তু সামান্য মেদসঞ্চয় এবং শরীর ফুলেফেঁপে ওঠার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এতে যেমন কাজকর্মে সমস্যা হয়, শরীরে নানা রকম রোগ বাসা বাঁধে তেমনই নিজের আত্মবিশ্বাসও চিড় খায়।
দক্ষিণী অভিনেত্রী অমলা কিছু দিন আগে টুইট করেছিলেন যার সারবত্তা বল—‘‘হ্যাঁ, আমার ওজন বেড়েছে এবং আমি তাতে বিন্দুমাত্র ভাবিত নই। আমি ‘এজে়ড গ্রেসফুলি’ ধারণায় বিশ্বাসী।’’ ওজন বাড়ায় ব্যক্তিবিশেষের অসুবিধা না-হলে অন্য কারও ভাবার প্রয়োজন নেই। ‘বডি শেমিং’এর বিরুদ্ধে হোটা পৃথিবী-জুড়ে ‘আমি আমার মতো’ আন্দোলন সাড়া ফেলেছে। এই ধারণার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ না-করেই বলা যায়, যদি কেউ হঠাৎ ওজন বাড়া নিয়ে মানসিক ভাবে বিধ্বস্থ হয়ে থাকে বা শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন প্রতিকারের ব্যাপারে অবশ্যই মন দেওয়া উচিত।
এক টানা বসে বসে সিরিয়াল দেখা বা অল্প দূরের রাস্তাতে অটো বা রিকশায় যাওয়া পরিত্যাগ করুন, ঈর্ষণীয় চেহারার জন্য।
হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং অস্থিসন্ধির সমস্যা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় মোটা হলে। এমনকি, একাধিক গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, ক্যানসারের সঙ্গেও সম্পর্ক
রয়েছে স্থুলতার।
জিনঘটিত কারণে এবং গঠনগত কারণে অনেকে মোটা হয়। সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। বাকি সব কারণ আমাদের নিজের সৃষ্টি করা। যেমন, খাদ্যাভ্যাস, কায়িকশ্রম না-করা, থাইরয়েড, স্ট্রেস, হরমোন এবং জীবনধারণ। এমন কিছু খাবার আমরা নিয়মিত খাচ্ছি যা দেহের মধ্যে প্রচুর ফ্যাটের জন্ম দিচ্ছে। জামাকাপড় কাচা, ঘর পরিষ্কার, উবু হয়ে বসে তরকারি কাটা, বাটনা বাটা বা ঘর মোছার মতো কাজ অনেকেই করি না। সবই যন্ত্রের মাধ্যমে বা কাজের লোকের মাধ্যমে হয়ে যায়। আমরা অনেকে দুপুরে ঘুমোই, বসে বসে সিরিয়াল দেখি, হাঁটাচলা করি না। তার ফল হল স্থুলতা।
মানসিক চাপ বাড়লে অনেকের মধ্যেই বেশি খাওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। যা থেকে ওজন বাড়ে। থাইরয়েডের সমস্যাকে আমরা চিকিৎসকেরা মজা করে বলি— ‘ঘর ঘর কি কাহানি।’ থাইরয়েড থেকেও মোটা হয় অনেকে। আবার চল্লিশের পর মেনোপজের সময় এগিয়ে আসতে থাকে, শরীরে হরমোনজনিত নানা পরিবর্তন ঘটে। তাতেও অনেকের ওজন বাড়ে।
ব্রেকফাস্ট অবশ্যই বাদ দেবেন না। অল্প করে বারে বারে খান। মিষ্টি কমান।
রোজ কায়িক পরিশ্রম কতটা করছি আর কতটা ক্যালরি খাচ্ছি সেটা বুঝতে হবে। মনে রাখবেন, চিত্রতারকারা আমাদের থেকে অনেক গুণ রোজগার করেন। তবুও শরীরের কথা ভেবে খাবারের ব্যাপারে অসম্ভব নিয়ন্ত্রণে থাকেন। লোভ সম্বরণ করতেই হবে। পরিমিত খাওয়া, বার-বার খাওয়া ভাল। মিষ্টি, ঘি, মাখন কম খান। রোড অল্প বলেও ব্যায়াম করুন, কাছাকাছি দূরত্বে যেতে হাঁটুন। সারাদিনে বারে বারে অল্প করে খাওয়াই বিধেয়। এক বার ভারী খাওয়ার চার ঘণ্টা পর পরের খাবার খাওয়া উচিত। আমাদের সাধারণ ভাবে দৈনিক ১৬০০-১৮০০ ক্যালোরির দরকার হয়। সেই হিসাব করে সকালের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, সন্ধ্যায় হালকা টিফিন এবং ডিনারের সময়ের মধ্যে ঘণ্টাচারেক করে গ্যাপ থাকলে ভাল। অনেকে বলেন সকালে খালি পেটে উষ্ণজলে মধু বা পাতিলেবুর রস খেলে ফ্যাট কমে। কিন্তু এই ধারণার কোনও ভিত্তি নেই। আর ভুলেও রোগা হওয়ার ওষুধ খাবেন না। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন মধ্য কুড়ি বা তিরিশের কোঠায় আপনি যতটা খেতে পারতেন সেই পরিমাণটা চল্লিশে পৌঁছে কমাতেই হবে। শাকসব্জি, ফল, প্রোটিনজাত দ্রব্য ডিম-দুধ বেশি করে খান। চায়ে চিনি বর্জন করতে পারলে ভাল। ৭-৮ ঘণ্টা ঘুম এবং মেডিটেশন জরুরি। সন্ধে ৮টার পর যতটা সম্ভব কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বর্জন করুন।
ভুঁড়ি হলে সহজে কমে না মোটেই
• আর্থারাইটিসের কারণে মর্নিংওয়াক, সাঁতার বা কায়িক পরিশ্রম পারি না। তা হলে কি রোগা হওয়া যাবে না?
উত্তর: এ ক্ষেত্রে বিদেশে নানা উন্নত ব্যবস্থা আছে। আমাদের এখানে যোগাসন বা কিছু ফ্রি-হ্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে খাওয়ার উপর। দিনের খাদ্যতালিকা এমন হবে যাতে পুষ্টি থাকবে, কিন্তু যথা সম্ভব কম ক্যালোরি।
• ভাত-আলু খেলে কি সত্যিই মোটা হয়ে যায়? বদলে রুটি খাওয়া কি ভাল?
উত্তর: ভাত আর রুটির মধ্যে বিশেষ কিছু ফারাক নেই। কিন্তু আলুতে কার্বোহাইড্রেট থাকে বলে ক্যালোরির পরিমাণ বেশি। এ ক্ষেত্রেও শরীরের অন্যান্য বিষয়ের উপর নির্ভর করে ক্যালোরি মেপে খেতে হবে।
• মিষ্টি খেতে অনেকে ভালবাসেন। মিষ্টির নেশা ছাড়বেন কী করে?
উত্তর: যে কোনও নেশা কাটাতে গেলেই প্রবল মানসিক জোর দরকার হয়। এ ক্ষেত্রেও সে ভাবেই মিষ্টির অভ্যাস ছাড়তে হবে। সব সময় মিষ্টির ক্ষতিকারক দিকটা চোখের সামনে ভেসে উঠলেই পারবেন।
• খুব মোটা নয়, পরিশ্রমও করেন। তার পরেও শরীরের অন্যান্য অঙ্গের থেকে পেট বেশি মোটা হয়ে যাচ্ছে। তা নিয়ে অনেকে খুব দুশ্চিন্তা করেন। জামকাপড় পরলেও দেখতে খারাপ লাগে। কী করণীয়?
উত্তর: একে পরিভাষায় বলে সেন্ট্রাল ওবেসিটি, এক কথায় ভুঁড়ি। যা ভারতীয়দের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। তেমনটা হলে একেবারে শুরু থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষকের কাছে গিয়ে পেটের মাংসপেশির ব্যায়াম শুরু করে দিতে হবে। একবার ভুঁড়ি হয়ে গেলে তা কমানো মুশকিল।
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য ও তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy