সকলে নিজের মতো করে পুতুলকে সাজিয়েছেন। নিজস্ব চিত্র।
সারা বছর বাড়ি ছেড়ে দূরে থাকলেও পুজোর সময়ে সকলে ঘরে ফেরেন। পরিবারকে জড়িয়ে থাকেন। ওঁদের তেমনটা হয় না। কারও বাড়ির ঠিকানা মনে নেই, কারও বা সে ঠিকানায় আর জায়গা নেই। কেউ আবার লাঞ্ছনার ভয়ে বাড়ি ফিরতে চান না। তাই বলে উৎসবের মরসুমে একাও থাকতে চান না। একাকিত্ব দূর করতে দিদিমণি এসেছেন। তাঁর সাহায্যে নিজেরাই বানিয়ে ফেলছেন নিজেদের সঙ্গী!
ওঁরা ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিক। সংখ্যায় ২৩। কারও আগের পুজো কেটেছে পাভলভ মানসিক হাসপাতালে। কারও বা লুম্বিনী পার্কে। মানসিক রোগ সেরে গিয়েছে। তবে বাড়ি ফেরা হয়নি।
গত জুলাইয়ে উদ্বোধন হয়েছে ‘প্রত্যয়’-এর। এখানেই এখন তাঁদের বসবাস। সমাজের মূলস্রোতে ফেরার আগে যে যত্ন এবং সাহায্যের প্রয়োজন, তা-ই এখানে পান তাঁরা। নিয়মিত যোগাসন করেন। রোজের টুকটাক কাজ করাও আবার অভ্যাস করছেন। এর পরে এক এক জন, এক এক রকম কাজ করতে চান। কে কোন কাজে দক্ষ, নানা কর্মশালার মাধ্যমে তা-ও বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তবে একা একা আর কত করবেন? সঙ্গীও তো চাই। মনের মতো সঙ্গী বানানোর জন্য শুরু হয়েছে পুতুল তৈরির ক্লাস। প্রতি সপ্তাহে ব্যারাকপুর থেকে আসেন দিদিমণি অঞ্জনা চক্রবর্তী। তাঁর সাহায্যেই নিজেদের মনের মতো পুতুল বানাচ্ছেন আবাসিকরা।
কারও সঙ্গীর নাম ডলি। কারও বাপি। কারও বা কিটো। কাপড় কেটে, তাতে তুলো ভরে সেলাই করে তৈরি হয়েছে হাত-পা। নিজেদের পছন্দের রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে পুতুলের জামা। কেউ জুতো পরিয়েছেন পুতুলকে। কারও পুতুলের আবার মাথায় স্কার্ফ। সযত্নে রেখেছেন নাম। শিক্ষিকা অঞ্জনা বলেন, ‘‘সকলকে বলা হয়েছিল নিজেদের মতো করে পুতুল বানাতে। আমি কাপড় কাটা, সেলাই করার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছি। তবে সকলে নিজের মতো করে পুতুলকে সাজিয়েছেন। নিজেদের ইচ্ছা মতো নাম রেখেছেন।’’
নাম রাখলেন কেন? সকলকেই বলা হয়েছিল নাম রাখতে। কারণ, এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য হল প্রত্যেক আবাসিকের জন্য নিজের একটি সঙ্গী তৈরি করা, জানালেন ‘প্রত্যয়’-এর প্রোজেক্ট ম্যানেজার অভিজিৎ রায়। বললেন, ‘‘পুতুল বানানোর কাজে পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে সকলেই অংশগ্রহণ করেছেন। তবে কাউকে জোর করা হয়নি। আমাদের এখানে নির্দেশ দেওয়া হয় না কাউকে। নতুন কোনও ভাবনা থাকলে তা জানানো হয়। তার পর আলোচনা চলে। যেমন, পুতুল তৈরি শুরু হওয়ার আগে আলোচনা হয়েছে নিজের মনোর মতো করে এক সঙ্গী তৈরি করার।’’ আর সে কারণেই প্রত্যেক পুতুলের নাম হওয়াও বেশ জুরুরি বলে মনে করছেন ওঁরা সকলেই।
সঙ্গীর রূপ ও নাম এক এক জনের মনে একেবারেই এক এক রকম। যেমন অধিকাংশের পুতুল প্রাপ্তবয়স্কদের মতো দেখতে হলেও এক আবাসিক বানিয়েছেন একটি ছোট্ট পুতুল। অঞ্জনা বলেন, ‘‘ওঁর হয়তো কোনও শিশুর সঙ্গে সময় কাটাতে ইচ্ছা করে। তাই ছোট পুতুল বানালেন।’’
কালো কাপড়ের উপর সাদা আর লাল সুতো দিয়ে তৈরি হয়েছে পুতুলের চোখ-মুখ। কারও পুতুলের কপালে পড়েছে টিপ। কারও নাকে নাকছাবি। সেখানকার আবাসিক কোয়েলের বয়স ৩০-এর আশপাশে। দক্ষিণ কলকাতায় বাড়ি। তবে গত এক বছরে আর ফেরার সুযোগ হয়নি। কোনও দিনও হবে কি না, জানেন না। বাবা-মা আছেন, তবে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার উৎসাহ দেখা যায়নি। এখন অফিসের কাজ শিখছেন। যাতে ধীরে ধীরে আবার কাজকর্মে ফিরতে পারেন। সকলের সঙ্গে বসে সঙ্গী তৈরি করেছেন তিনিও। হলুদ পোশাক পরা সেই আহ্লাদি পুতুলের নাম রেখেছেন ডলি। কাছাকাছি বয়সের শৌভিকের পুতুলের নাম বাপি। বললেন, ‘‘নিজের ডাকনামের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছি সঙ্গীর নাম।’’
তবে সব পুতুলের মোটেই এমন আদুরে নাম নয়। সুমন যেমন নিজের পুতুলের নাম রেখেছেন কিটো। নিজেই বুঝিয়ে বললেন তার কারণ। বললেন, ‘‘কিটো হল এক ধরনের জুতো। লোকে পায়ে পরেন। আমাদের মতোই পদদলিত। আমার সঙ্গীর নামও তাই কিটো। জুতোর মতো।’’ মনের মতো সঙ্গী মনের কাছাকাছি হওয়া চাই। যে নাম আপন মনে হয়েছে, তাই সে নামই রেখেছেন বলে বোঝালেন সুমন।
মনোসমাজকর্মী রত্নাবলী রায় নিয়মিত ‘প্রত্যয়’-এর আবাসিকদের দেখাশোনা করেন। পুতুল তৈরির কর্মশালা যে মনের উপর অনেকটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সে বিষয়ে আশাবাদী তিনি। বলেন, ‘‘মানসিক রোগের একটি বড় অভিঘাত হল নিজের পরিচয় গুলিয়ে ফেলা। এটা শুধু রোগের অভিঘাত নয়। রোগ, তার পারিবারিক ও সামজিক প্রতিক্রিয়া, যদি তিনি মানসিক হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছান, তার প্রতিক্রিয়া সব কিছু মিলিয়ে প্রথম যে সমস্যাটা হয়, জীবনের মানে নিয়ে একটা সংশয় তৈরি হওয়া। সেটা যে সব সময়ে রোগের কারণে হচ্ছে, এমন নয়। রোগের চিকিৎসা প্রক্রিয়ার কারণেও হতে পারে। মানসিক রোগী, মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রসঙ্গে অনেক সময়েই রোগীর বন্দিদশা নিয়ে কথা হয়। কিন্তু এটা অন্য বন্দিদশা থেকে আলাদা। অন্য যে কোনও বন্দিত্বে প্রাথমিক ভাবে, উদ্দিষ্ট ব্যক্তির পরিচয়টাই মূল কারণ। মানসিক হাসপাতালে, বেশির ভাগ সময়েই, পরিচয়হীনতাটা মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুতুল তৈরির এই অনুশীলন, এই পরিচয়হীনতার থেকে বেরোতে সাহায্য করে। এমন নয় যে, সেটা অসুস্থতাপূর্ব সামাজিক পরিচয়ে ফিরে যাওয়াই হবে। অনেক সময়েই, এক জন নিজের পরিচয়টা একদম নতুন করে তৈরি করতে পারেন। তাঁর তৈরি করা পুতুলের কোনও অসম্পূর্ণতা বরদাস্ত করছেন না। আগে তার গোটা অবয়বটা তৈরি হতে হবে, তবে তিনি তাঁর নাম ঠিক করবেন, তার সঙ্গে আলাপ করা শুরু করবেন।’’
রত্নাবলী লক্ষ করেছেন, এই পুতুল তৈরির সময়ে কেউ কেউ নিজের অপছন্দের বিষয়গুলিকে বাদ দিচ্ছেন, কারও পুতুল তাঁর সম্পর্কে এমন একটা পছন্দের গল্প বলছে, যেটা তিনি কখনও ছিলেন না, তাঁর পারিপার্শ্বিকতায় ও রকম কিছু হয়ে ওঠা বেশ কঠিন, এমনকি, সে রকম কাউকে তিনি কখনও দেখেননি, চেনেনওনি।
নিজের হাতে তৈরি করা সঙ্গীদের মাধ্যমে নতুন করে নিজেদের দেখার সুযোগ হবে আবাসিকদের। পরিচয় ঘটবে চারপাশের সঙ্গেও। এমনই আশা সকলের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy