জাপানি এনসেফ্যালাইটিস যে উত্তরবঙ্গে ভাল ভাবেই থাবা বসিয়েছে, তা পরিষ্কার হল পুণের ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি এবং কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন থেকে আক্রান্তদের রক্ত ও সিএসএফ পরীক্ষার রিপোর্ট আসার পরে। এই দু’জায়গায় পাঠানো নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট বুধবার পৌঁছেছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
ওই রিপোর্ট পেয়ে স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “ট্রপিক্যাল ও পুণের জীবাণুবিজ্ঞানীদের রিপোর্ট থেকে বোঝা যাচ্ছে ৬০% রোগী জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত। এর প্রকোপই যে উত্তরবঙ্গে ছড়িয়েছে, তা বলাই যায়।”
মঙ্গলবার বিকেল থেকে বুধবার বিকেল পর্যন্ত উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে চিকিৎসাধীন ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাজ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর হিসেব অনুযায়ী, ওই হাসপাতালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৯। চিকিৎসাধীন ৪১ জন।
স্বাস্থ্য দফতরের খবর, ট্রপিক্যালের বিজ্ঞানীরা ৮ জন আক্রান্তের সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড (সিএসএফ)-এর নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন। তার মধ্যে ৫টিতে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস ভাইরাস মিলেছে। ৬ জনের রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছিল ট্রপিক্যাল। ৫টি ক্ষেত্রেই ওই রোগের জীবাণু মিলেছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে ১৪টি রক্তের নমুনা সংগ্রহ করেছিল তারা। একটি ক্ষেত্রে মিলেছে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস।
পুণের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে ১০টি রক্তের নমুনা পাঠানো হয়েছিল। তার ৬টি-তে জাপানি এনসেফ্যালাইটিস জীবাণু মিলেছে। বাড়ি বাড়ি ঘুরে যে ১৪টি রক্তের নমুনা সংগ্রহ হয়েছিল, পুণের রিপোর্টে তাদের একটি ক্ষেত্রে ওই ভাইরাস মিলেছে। স্বাস্থ্যকর্তারা বলছেন, ওই দুই সংস্থার রিপোর্ট থেকে স্পষ্ট, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ ভালই ছড়াচ্ছে।
এত দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে যে রক্ত এবং সিএসএফ-র নমুনা পরীক্ষা হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছিল তুলনায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ কম। কিন্তু এ’দিন দুই সংস্থার রিপোর্টের পরে বোঝা যাচ্ছে আগের ধারণা ভুল ছিল। দুই সংস্থার রিপোর্ট দেখে স্বাস্থ্য কর্তাদের একাংশের প্রশ্ন, তা হলে কি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এত দিন যে সব পরীক্ষা হয়েছে তাতে ভুল ছিল?
ট্রপিক্যালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান নিমাই ভট্টাচার্য বলেন, “উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল থেকে এমন কিছু নমুনা এনেছিলাম, যেগুলিতে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপস্থিতি সম্পর্কে ওরা নিশ্চিত হতে পারেননি। আমরা এখানে পরীক্ষা করে সেগুলি পজিটিভ পেয়েছি। আবার ওখানে পজিটিভ হওয়া কিছু নমুনাও আমরা নিয়ে এসেছিলাম পুরোপুরি নিশ্চিত হতে। সেগুলিও পজিটিভ হয়েছে।”
ট্রপিক্যালের বিজ্ঞানীর দেওয়া তথ্য অবশ্য পুরোপুরি মানতে চাননি রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, “মেডিক্যালে পরীক্ষার পরেও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে নমুনা বাইরে পাঠানো হয়। এটা নিয়ে বিভ্রান্তির অবকাশ নেই। এখানে যে নমুনায় জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের জীবাণু পাওয়া গিয়েছিল সেগুলিই মূলত নিয়ে গিয়েছিলেন দুই সংস্থার বিজ্ঞানীরা। দুটি সংস্থার রিপোর্টেই দেখা যাচ্ছে এখানে পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিকই ছিল।”
কাদের কাদের রক্তের নমুনা পুণে এবং ট্রপিক্যালে পাঠানো হয়েছে, তা অবশ্য জানাতে চাননি স্বাস্থ্য কর্তারা। হাসপাতাল কর্মীদের অনেকে অবশ্য বলছেন, ওই তালিকা পেলে বরং রক্ত পরীক্ষা নিয়ে বিভ্রান্তি এড়ানো যেত। তবে এনসেফ্যালাইটিস পরীক্ষার কিটের অভাবে রক্ত পরীক্ষার কাজ যে যথাযথ হয়নি, তা মেনে নিচ্ছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। জুলাই মাসের গোড়ায় কিটের সঙ্কট ছিল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। তাই এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা ভর্তি হলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তাঁদের রক্ত পরীক্ষা করা যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। সে ক্ষেত্রে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে রোগীর মৃত্যু হলেও, তা সাপ্তাহিক রিপোর্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি বলে অভিযোগ। সেই পরীক্ষা ঠিকঠাক হলে উত্তরবঙ্গের সংক্রমণ চিত্রটাও পরিষ্কার হত। চলতি মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুণে থেকে বেশ কিছু কিট পৌঁছলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল হওয়ায়, যে রোগীদের এনসেফ্যালাইটিসের সব রকম উপসর্গ দেখা গিয়েছে, তাঁদের রক্তের নমুনা কলকাতায় পাঠাতে হয়েছে।
সংক্রমণ চিত্রটা পরিষ্কার হচ্ছে না নার্সিংহোম এবং বিভিন্ন প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি স্বাস্থ্য দফতরকে তাদের রিপোর্ট না জানানোয়। শিলিগুড়িতে ৪৩টি নার্সিংহোম ও অন্তত ১৫০টি বেসরকারি প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি রয়েছে। কিন্তু নার্সিংহোমগুলিতে জ্বরে আক্রান্ত ক’জনের চিকিৎসা চলছে, সেই ব্যাপারে কোনও তথ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে নেই। সরকারি নির্দেশ অনুযায়ী, সংক্রামক রোগের ব্যাপারে যাবতীয় তথ্য নার্সিংহোম ও প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিকগুলির তরফে সরকারকে জানানো বাধ্যতামূলক। অথচ গত এক মাসে এনসেফ্যালাইটিসের প্রকোপ বাড়লেও বেসরকারি ক্ষেত্রের অনেক তথ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছে জমা পড়েনি।
শিলিগুড়ি নার্সিংহোম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, “আমাদের কাছে স্বাস্থ্য দফতর চাওয়া মাত্র সব তথ্য দেওয়া হয়। সরকারি নিয়ম মেনে সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত তথ্যও পাঠানো হয়। তেমন পরিস্থিতি হলে স্বাস্থ্য দফতর বৈঠক করে আমাদের নিয়মিত রিপোর্ট পাঠানোর নির্দেশ দেয়। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে কোনও বৈঠক এখনও হয়নি। পৃথক নির্দেশিকাও পাইনি।”
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “নার্সিংহোম, প্যাথলজিক্যাল ক্লিনিককে কী ধরনের তথ্য সরকারকে জানাতেই হবে, তা নিয়ে নির্দেশিকা রয়েছে। সেটা মানা হচ্ছে কি না দেখতে স্বাস্থ্য দফতর নজরদারি শুরু করেছে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy