ছবি: অমিত দাস
আমরা হার্ট, লাংস নিয়ে যতটা চিন্তিত হই, কিডনি নিয়ে ততটা সচেতনতা দেখা যায় না। কিডনি বা বৃক্ক দেখতে নেহাতই ছোট কিন্তু তার কাজ শরীরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শরীর থেকে দূষিত রেচন পদার্থ বার করে দেওয়া এবং রক্ত পরিষ্কার রাখার কাজ করে বৃক্ক। কিডনির অসুখের বড় বিভ্রান্তি হল, এর সমস্যা ধরা পড়তে সময় নেয়। যখন ধরা পড়ে, তখন হয়ত অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। এটি শিশু এবং বয়স্ক— উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ছোটদের ক্ষেত্রে মূলত স্ট্রাকচরাল, জেনেটিক, ইনফেকশন এবং ইমিউনোলজিক্যাল কারণে কিডনির সমস্যা দেখা দেয়। কারও হয়তো একটি কিডনি নেই, এটি স্ট্রাকচরাল সমস্যা। জেনেটিক বা জন্মগত সমস্যাগুলো ধরা পড়তে সময় নেয়।
ইউরিন ইনফেকশন
পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্ট রাজীব সিংহ বলছেন, ‘‘ছোটদের সবচেয়ে চেনা সমস্যা হল ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন (ইউটিআই)। এটা বিভিন্ন বয়সের শিশুর, বিভিন্ন কারণে হতে পারে। একদম ছোট শিশুদের অনেক সময়েই ডায়াপার থেকে সংক্রমণ হয়। মেয়েদের মধ্যে ইউরিন সংক্রমণের প্রবণতা বেশি। মলের জায়গা থেকে নোংরা প্রস্রাবের পথে ঢুকে যেতে পারে। তাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা জরুরি।’’ অনেক সময়েই ছোটরা টয়লেট চেপে রাখে, সেটাও ইনফেকশনের একটা কারণ। আরও একটা সমস্যা হল কনস্টিপেশন। জল কম খেলে কোষ্ঠকাঠিন্য হয় আবার প্রস্রাবের ইনফেকশন হয়— এগুলো একে অপরের সঙ্গে যুক্ত বলে জানালেন ডা. সিংহ। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘ইউরিন ইনফেকশন ছোটদের খুব সাধারণ সমস্যা। লক্ষণ বলতে জ্বর হওয়া। কাঁপুনি দিয়েও জ্বর আসে কখনও। সর্দি-কাশি ছাড়া যদি জ্বর হয়, তখন আমরা ইউরিন ইনফেকশন বলে সন্দেহ করি। ইউরিন পরীক্ষা করালেই সমস্যা ধরা পড়ে।’’ সংক্রমণ বুঝে চিকিৎসকেরা ওষুধ দেন। প্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়। তবে শিশুদের বারবার ইউটিআই হওয়া ভাল নয়। কারও যদি বছরে বারপাঁচেক করে এই সমস্যা হয় এবং তা দীর্ঘকাল চলতে থাকে, তখন কিন্তু কিডনি ড্যামেজ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কেন বারবার এ ধরনের ইনফেকশন হচ্ছে, তার কারণ খুঁজে বার করে চিকিৎসা করতে হবে।
প্রস্রাব বেরোনোর পথে সমস্যা
অনেক সময়ে প্রস্রাবের রাস্তায় ব্লক থাকে। এতে ইউরিন পাস হতে সমস্যা হয়, চাপ পড়ে কিডনির উপরে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বললেন ডা. অপূর্ব ঘোষ, ‘‘অনেকের কিডনি থেকে ইউরিন বেরোনোর পথ সরু থাকে। একে আমরা হাইড্রোনেফ্রোসিস বলে থাকি। ছেলেদের যেমন পেনিসের মধ্যে পস্টিরিয়র ইউরিথাল ভাল্ভ থাকে। পিইউভি থাকলে ইউরিন পাস হতে সমস্যা হয়। এগুলোর জন্যও ইনফেকশন হয়।’’ এই রোগ যত তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে, কিডনির ক্ষতি তত কম হবে। তবে সমস্যা থেকে রেহাই পেতে সার্জারিই একমাত্র উপায়।
ইউরিন উল্টোপথে যাওয়া
পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজিস্ট ডা. রাজীব সিংহ বলছেন, ‘‘খুব ছোট শিশুদের যদি বারবার ইউটিআই হয়, তা হলে রিফ্লাক্সের সমস্যার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকেরা এটিকে ভেসিকিউরিটেরাল রিফ্লাক্স (VUR) বলে থাকেন। এই সমস্যায় ইউরিন উল্টো রাস্তায় অর্থাৎ ব্লাডার থেকে আবার কিডনিতে ফেরত যায়। এটা বারবার হলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভয় থাকে। রিফ্লাক্সের সমস্যা সাধারণত জন্মগত হয়। যে ভাল্ভ মেকানিজ়ম ব্লাডার থেকে প্রস্রাবকে উল্টো পথে যেতে দেয় না, তাতে যদি গোলমাল থাকে, তা হলে রিফ্লাক্সের মতো সমস্যা দেখা যায়।’’ এ ক্ষেত্রেও সার্জারির মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হয়।
শরীর থেকে প্রোটিন বেরিয়ে যাওয়া
শিশুদের কিডনির জেনেটিক বা জন্মগত সমস্যার মধ্যে কনজেনিটাল নেফ্রোটিক সিনড্রোম একটি বড় অসুখ। এ ক্ষেত্রে কিডনি দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যায়। আমাদের কিডনির মধ্যে ছাঁকনির মতো কিছু ফিল্টার আছে। এই রোগে ওই ছাঁকনির ফুটোগুলি বড় হয়ে যায়। তার ফলে ওর মধ্য দিয়ে প্রোটিন বেরিয়ে যায়। এতে শরীর ফুলে যায়, জল জমে যায় শরীরে। চিকিৎসকদের মতে, সাধারণত শিশুর জন্মের মাস দেড়েক পর থেকে এই সমস্যা দেখা যায়। এটি ক্রনিক ডিজ়িজ়, বারেবারে ফিরে আসে। অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে অসুখের প্রতিকার করা সম্ভব। তবে তাতে যদি না সারে, তা হলে সার্জারির পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
ইমিউনলজিক্যাল কারণ
অনেক সময়ে ইমিউনলজিক্যাল কারণে কিডনিতে সমস্যা দেখা দেয়। শরীরের অন্য কোনও অসুখের প্রভাব কিডনির উপরে পড়তে পারে। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ঘোষের মতে, ‘‘কিডনির কোনও সমস্যায় আমরা দেখি ইনফেকশনটা অ্যালার্জিক কি না। কোনও ড্রাগের কারণে হচ্ছে কি না। অন্য কোনও অসুখের জন্য হয়তো কিছু নেফ্রোটক্সিক ড্রাগস ব্যবহার হয়েছে, তার জন্য কিডনির সমস্যা দেখা দিল, এমনটাও হয়ে থাকে।’’
কিডনি ভাল রাখার উপায়
চিকিৎসকদের মতে, কিডনি সুস্থ রাখার বা কিডনির রোগ প্রতিরোধ করার সে অর্থে কোনও নিয়মবিধি নেই। কারণ এই অসুখ ধরা পড়তে সময় নেয়। প্রথম দিকে জ্বর হওয়া ছাড়া লক্ষণও তেমন দেখা যায় না। লাইফস্টাইল এবং হাইজিনের দিকে নজর দিতে হবে। পরিমাণ মতো জল খাওয়া, দু’-তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রস্রাব করা— এগুলো শিশুদের শেখাতে হবে। বাচ্চাদের টয়লেট চেপে রাখার প্রবণতাও দূর করতে হবে। হাইজিনগত কারণে যাতে ইনফেকশন না হয়, সেটা দেখা বিশেষ জরুরি। শরীরে যাতে নেফ্রোটক্সিক ড্রাগস না যায়, সেটা দেখতে হবে। ছোটদের প্যাকেটজাত খাবার দেওয়া যাবে না। ওই ধরনের খাবারে অতিরিক্ত নুন থাকে, সেটা শরীরের জন্য মোটেই ভাল নয়। বাড়ির রান্নায় যতটা নুন প্রয়োজন, ততটাই ঠিক আছে। ‘‘নেফ্রোটিক সিনড্রোমে স্টেরয়েড দিতে হয়, তার কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। সেই কারণে নুন কম খাওয়া, ভাজাভুজি কম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়,’’ মন্তব্য ডা. রাজীব সিংহের।
অনেকে মনে করেন, ছোটরা প্রোটিন বেশি খেলে কিডনির অসুখ হতে পারে। এটি ভ্রান্ত ধারণা। নেফ্রোটিক সিনড্রোম থাকলে, তবেই প্রোটিনে রাশ টানার কথা বলেন চিকিৎসকেরা। নয়তো বয়স অনুযায়ী শিশুদের শরীরে প্রয়োজনীয় প্রোটিন খুবই জরুরি।
কিডনি প্রতিস্থাপন বা ডায়ালিসিস নিয়ে অনেক ধন্দ রয়েছে সাধারণ মানুষের। ডা. অপূর্ব ঘোষের কথায়, ‘‘অনেকের জন্ম থেকেই কিডনি বিকল হয় বা একটা কিডনি থাকে না। তবে এগুলো বিরল ঘটনা। তেমনই ছোটদের মধ্যে ডায়ালিসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের ঘটনাও কম দেখা যায়।’’
কিডনির যে রোগগুলো নিয়ে আলোচনা করা হল, তা সময় মতো ধরা পড়লে ওষুধ ও সার্জারির মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। তবে রোগ ধরা পড়তে বেশি দেরি হলে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। তখন কিন্তু ডায়ালিসিস বা ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy