অ্যাপ ক্যাবের ভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে নাজেহাল যাত্রীরা। ছবি: সংগৃহীত।
ঘটনা ১। শ্যামবাজার পাঁচ মাথার মোড় থেকে সল্টলেকের পাঁচ নম্বর সেক্টরে যাবেন বলে অ্যাপ ক্যাব বুক করেছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার এক কর্মী। কিন্তু ভাড়া দেখে আকাশ থেকে পড়েন। আগে এটুকু পথ যেতে ২৫০-২৭০ টাকা ভাড়া লাগত। এখন সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪১০ টাকা। গাড়িতে এসি-র হাওয়া খেতে হলে বাড়তি আরও ৩০ টাকা।
ঘটনা ২। বিমানবন্দরের ১ নম্বর গেটের কাছে এইচএমভি মোড় থেকে ক্যাব বুক করেছিলেন এক প্রৌঢ়। গন্তব্য ঢাকুরিয়ার এক হাসপাতাল। সঙ্গে অসুস্থ স্ত্রী। এক সংস্থার ক্যাব বুক করার পর ভাড়া দেখায় ৭১০ টাকা। কিন্তু কিছু ক্ষণ পর জানতে পারেন, গাড়ি নেই। ফের গাড়ি খোঁজা শুরু করেন। দীর্ঘ ক্ষণের চেষ্টার পর ফের অন্য একটি ক্যাব পান। কিন্তু ভাড়া আকাশছোঁয়া।
ঘটনা ৩। দমদম স্টেশনের বাইরে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন এক তরুণী। তাড়াহুড়োয় ভাড়া জানতে চাননি। গিরিশ পার্কে নামতেই ৩২০ টাকা ভাড়া দাবি করেন চালক। তর্ক করেও লাভ হয়নি। স্বাভাবিকের তুলনায় ১২০ টাকা বেশি দিতে হয় তরুণীকে।
উপরের তিনটি ঘটনা অনেকেরই চেনা। গরমে প্রায় দিনই এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে অনেককে। তাপমাত্রা বাড়ছে নিজের খেয়ালে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে অ্যাপ-ক্যাব, হলুদ ট্যাক্সির ভাড়ার দৌরাত্ম্য। গনগনে রোদ আর অসহনীয় গরমে অনেকেই গণপরিবহণ এড়িয়ে চলছেন। রোদে ঝলসে গিয়ে বাস, মেট্রো ধরার বদলে একটু স্বস্তির খোঁজে হলুদ ট্যাক্সি বা অ্যাপ-ক্যাবে যাতায়াত করছেন। গরম বলে নয়, অনেকেই আবার সিংহভাগ সময়ে ক্যাব কিংবা ট্যাক্সিতেই যাওয়া-আসা করে থাকেন। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে যাত্রী ভোগান্তির ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
নিয়মিত যাঁরা ক্যাবে যাতায়াত করেন, ভাড়া সম্পর্কে তাঁদের একটা ধারণা রয়েছে। সাধারণ ভাড়ার চেয়ে ১০-২০ টাকা বেশি দেখালে অনেকেই তা আমল দেন না। কিন্তু ছবিটা একেবারেই অন্য। গরমে স্বাভাবিকের চেয়ে ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ দেখাচ্ছে। বিশেষ করে দিনের বেলায় ভাড়া বৃদ্ধির প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। সন্ধ্যার দিকে নাকি তুলনায় কম। তবে খুব বেশি হেরফের নেই। তেমনটাই জানাচ্ছেন দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা কলেজপ়ড়ুয়া সোহিনী ঘোষাল। তাঁর কথায়, ‘‘আমাকে সপ্তাহে দু’দিন পার্ক স্ট্রিটের এক জায়গায় নাচ শিখতে যেতে হয়। সঙ্গে ভারী ব্যাগ থাকার কারণে ক্যাবেই যাতায়াত করি। অন্য সময়ে যেখানে ৩২০ টাকার মধ্যে মিটে যেত। এখন প্রায় ৪৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। তবে রাতের দিকে সেখানে ৪০০ টাকা দেখাচ্ছে।’’
বেশি ভা়ড়ার দুর্ভোগ তো আছেই। সেই সঙ্গে অ্যাপ ক্যাবে এসি না চালানোর সমস্যাও মাথাচা়ড়া দিয়ে উঠেছে। অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্যাব চালক গাড়িতে এসি চালাতে রাজি হচ্ছেন না। বেসরকারি অ্যাপ ক্যাব সংস্থা এখন গাড়ি বুক করার সময়ে এসি এবং নন-এসি গাড়ি বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয়। গরমে স্বাভাবিক ভাবেই বাতানুকূল ক্যাব বুক করছেন সকলে। কিন্তু অনেক চালকই আগে থেকে ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছেন, এসি চলবে না। নয়তো এসি চালালে দিতে হবে বাড়তি টাকা। ফোনেই যাত্রী এবং চালক জড়িয়ে পড়ছেন বাদানুবাদে। সম্প্রতি মহেশতলা সন্তোষপুর থেকে ধর্মতলা যাওয়ার জন্য অ্যাপক্যাব বুক করেছিলেন অস্মিতা ভট্টাচার্য। এমনিতেই দ্বিগুণ ভাড়াতে রাজি হয়েই গাড়িতে উঠেছিলেন। কিন্তু গাড়িতে উঠে এসি চালাতে বললেই বেঁকে বসেন চালক। অস্মিতা বলেন, ‘‘আমার বাড়ি থেকে ধর্মতলার ভাড়া এমনিতে ২৮০-৯০ টাকা। কিন্তু হঠাৎ করেই তা বেড়ে ৪২০ টাকা হয়ে গিয়েছে। উপায় নেই, ভাড়া বেশি হলেও যেতে হবে। কিন্তু ভাড়া বেশি দিয়েও দেখি এসি চলছে না গাড়িতে। তার জন্য আবার বাড়তি টাকা দাবি করেন চালক। তবে অভিযোগ জানানোর কথা বলতেই এসি চালু করেন।’’
শুধুমাত্র অ্যাপ নির্ভর ক্যাব কিংবা বাইকের কারণেই যে দুর্ভোগ হচ্ছে যাত্রীদের, তা নয়। এক সমস্যা হলুদ ট্যাক্সির ক্ষেত্রেও। ট্যাক্সির ভাড়া এখন আর মিটারের কাঁটার উপর নির্ভর করে না। চালক যা বলবেন, সেটাই দিতে হবে। চালকের কথায় রাজি না হয়েও উপায় নেই। কারণ, সকলেই কমবেশি একই ভাড়া বলবেন। গনগনে রোদে দাঁড়িয়ে ভাড়া নিয়ে তর্ক করারও আগ্রহ পাচ্ছেন না অনেকে। তাই বেশি ভাড়া দিয়েই যেতে হচ্ছে। লেকটাউনের বাসিন্দা সুদীপ্তা সিংহের অভিজ্ঞতা খানিকটা এ রকম। মেট্রোতেই যাতায়াত করেন। তবে অসুস্থতার জন্য কিছু দিন ধরে ট্যাক্সি করে আসছেন। গত মাসেও ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে এসেছেন। এখন সেখানে দিতে হচ্ছে ৩৫০ টাকা। ট্যাক্সিতে এসি নেই। অথচ ভাড়া ক্যাবের মতো। এত বেশি ভাড়া কেন, চালকের কাছে জানতে চাইলেও উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না। সুদীপ্তা বলেন, ‘‘চালকেরা বুঝে গিয়েছেন অফিস যাওয়ার তাড়াহুড়োয় তাঁদের দাবি না মেনে উপায় নেই অনেকের। সব জেনেশুনেই এত বেশি ভাড়া হাঁকাচ্ছে।’’ সে অভিযোগ মানতে অবশ্য রাজি নন ট্যাক্সিচালক রতন তিওয়ারি। তাঁর কথায়, ‘‘অনেক বছর হল ট্যাক্সির ভাড়া বাড়ায়নি সরকার। পেট তো চালাতে হবে। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। তাই নিজেদেরই ভাবতে হবে। তাই সামান্য ভাড়া বাড়াতেই হচ্ছে। না হলে টিকে থাকা মুশকিল।’’ ট্যাক্সির এই মাত্রাতিরিক্ত ভাড়ার কথা কানে গিয়েছে ট্যাক্সি ইউনিয়নের কর্তাদেরও। ‘কলকাতা ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক অরুণ সিংহের কথায়, ‘‘ট্যাক্সি চালকেরা বেশি ভাড়া নিচ্ছেন। সে খবর আমাদের কাছে আছে। বাড়তি টাকা কিন্তু আমাদের কাছে আসে না। চালকদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেও লাভ হয়নি। আগে গোটা কলকাতায় ট্যাক্সির সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার। এখন কমতে কমতে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৫-৭ হাজারে। ২০২৫ সালের মধ্যে খুব বেশি হলে ৪০০-৫০০টি ট্যাক্সি বেঁচে থাকবে। ভাড়া বেশি নিচ্ছে বলে এমন একটি মৃতপ্রায় ব্যবসা নিয়ে, নতুন করে কোনও আন্দোলন করেও লাভ নেই। সেই জন্য সব জেনেও চুপ করে থাকা ছাড়া অন্য রাস্তা নেই।’’
অ্যাপ-ক্যাব, বাইক কিংবা হলুদ ট্যাক্সি— বছরের অন্য সময়ের এই সারথিদের ভরসাতেই যাতায়াত করেন অনেকে। বেশি ভা়ড়া গুনতে হলেও, নিজের মতো যাতায়াত করার আকাঙ্খায় সাধ্যের বাইরে গিয়েও চেপে বসেন গাড়িতে। কিন্তু গরমে যে ভাবে ভাড়া বাড়ছে, তাতে নিত্যদিন কী ভাবে যাতায়াত করবেন, তা নিয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে অনেকের কপালে। কী ভাবে এই সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে, এখনও পর্যন্ত তার কোনও সদুত্তর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy