বেশ কিছু দিন আগে অভিনেত্রী সারা আলি খানের একটি পুরনো ছবি ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছিল। সেই ছবিতে নায়িকার ওজন বেশ বেশিই। পরে একটি সাক্ষাৎকারে সারা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, পিসিওডি-র শিকার হয়ে তাঁর ওজন হয়েছিল প্রায় ৯৬ কিলোগ্রাম পর্যন্ত। আর হরমোনের ক্ষরণ বেশি হওয়ায় ওজন কমানোও তাঁর কাছে সহজ ছিল না। একজন নায়িকার জন্য এই সমস্যাটি বেশ কঠিন। আর পিসিওডি-র সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। দেখা গিয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে পাঁচ জন মেয়ের মধ্যে অন্তত একজন করে ভোগেন এই সমস্যায়। কিন্তু পিসিওডি কী? কেনই বা তা থাবা বসাচ্ছে রোজকার জীবনে?
পিসিওএস এবং পিসিওডি
‘পিসিওএস’ শব্দটিকে ভাঙলে দাঁড়ায় পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম। আর ‘পিসিওডি’ হল পলিসিস্টিক ওভারিয়ান ডিজ়িজ়। এই দু’টি সমস্যাই ওভারি বা ডিম্বাশয় সংক্রান্ত। দু’টি ক্ষেত্রেই হরমোনের সমতা হারায় অর্থাৎ ব্যালান্সের হেরফের ঘটে। একটি সময়ের পর থেকে প্রত্যেক মেয়ের শরীরের দু’টি ডিম্বাশয় বা ওভারি থেকে প্রতি মাসে ডিম বেরোতে থাকে। পিসিওডির ক্ষেত্রে ওভারি সাধারণত অপরিণত কিংবা আংশিক পরিণত ডিমে ভরে যায়। ফলে পরবর্তী সময়ে তা জমে জমে সিস্টে পরিণত হয়। অতিরিক্ত জাঙ্ক খাবার খাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, স্ট্রেস এবং হরমোনাল ইমব্যালান্সের কারণে পিসিওডি হয়। এর ফলে প্রত্যেক মাসের পিরিয়ড নিয়মিত হয় না, পেটে চর্বি জমে ও ওজন বাড়ে, বন্ধ্যত্ব এবং চুল পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়।
পিসিওএস আবার হল মেটাবলিক ডিজ়অর্ডার। এ ক্ষেত্রে ওভারি থেকে অনেক বেশি পরিমাণে মেল হরমোন নির্গত হয়। সিনিয়র কনসালট্যান্ট গাইনিকলজিস্ট চন্দ্রিমা দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘ওভারিতে পলিসিস্টিক অ্যাপিয়্যারেন্স থাকে। তার সারফেস জুড়ে অনেকটা ছোট ছোট ফোসকার মতো দেখতে লাগে। খানিকটা পার্ল ইন আ নেকলেসের মতো। ওভারি ভারী হয়ে যায়। মেল বা পুরুষালি হরমোনের আধিক্যের কারণে ফেসিয়াল হেয়ার, অবাঞ্ছিত রোম বাড়ে। ব্রণ, অ্যাকনের মতো সমস্যা দেখা দেয়। চুল পাতলা হয়। ওজনও বাড়ে। এ ছাড়াও আছে প্রজননের সমস্যা। ভবিষ্যতে হাই কোলেস্টেরল, ডায়াবিটিস হওয়ারও আশঙ্কা দেখা দেয়।’’
লক্ষণ
অনিয়মিত পিরিয়ডস, অবাঞ্ছিত হেয়ার গ্রোথ, ত্বকে ব্রণ কিংবা অ্যাকনের মতো সমস্যা তো আছেই। এ ছাড়াও যখন-তখন মুড সুয়িং এর অন্যতম লক্ষণ। ওজন অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যায়। চুল পাতলা হয়, ঝরে যায়। এমনকি অনিয়মিত থাকার পরে যখনই পিরিয়ডস হয়, যন্ত্রণা, ক্র্যাম্প এবং ব্লাড ক্লটের নির্গমনও অস্বাভাবিক নয়। অনেকের আবার পিরিয়ডস চার-পাঁচ দিনে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা সপ্তাহ ছাড়িয়ে ২০-২৫ দিনও হতে পারে। আবার রোগা হলেও এই সমস্ত সমস্যার শিকার হতে পারেন কেউ। সে ক্ষেত্রেও কিন্তু বদলাতে হবে জীবনযাপনের ধারা। আলট্রা সোনোগ্রাফির মাধ্যমে ধরা পড়ে ওভারিতে থাকা সিস্ট।
সমাধানের উপায়
এই ধরনের রোগ থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় লাইফস্টাইল মডিফিকেশন। জীবনযাত্রায় যদি বদল আনা যায়, তা হলে আপনাআপনিই রোগের লক্ষণ দূর হবে।
ডা. দাশগুপ্ত বলছেন, ‘‘এই রোগ সেরে যায় না। কিন্তু ঠিক মতো ডায়েট এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে বাগে আনা যায় এই রোগকে। কারণ এই সব করে যদি মাত্র পাঁচ শতাংশও ওজন কমে, তা হলে ফার্টিলিটি রেট বাড়ে। অনেকেই ব্যায়াম কিংবা নির্দিষ্ট ডায়েট চার্ট ফলো করার পরে দেখেন, তাঁর পিরিয়ডস নিয়মিত হচ্ছে। এ ছাড়া একেবারে নির্দিষ্ট কোনও ওষুধও নেই। কার কেমন সমস্যা, তার উপরে নির্ভর করে
ওষুধ দেওয়া হয়। হরমোনাল ট্যাবলেট, ওরাল কনট্রাসেপটিভ পিল দেওয়া হতে পারে। সেগুলি খেলে প্রত্যেক মাসে পিরিয়ডস হবে। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, রোগ সেরে গেল। তাই জীবনযাপনে বদলই এর একমাত্র উপায়।’’
অনেক সময়েই প্রেগন্যান্সির ক্ষেত্রে বাদ সাধে এই ধরনের সমস্যা। তখন রোগীর সমস্যা এবং চাহিদার উপরে বিবেচনা করে অনেক ক্ষেত্রে ফার্টিলিটি বাড়ানোর ওষুধ দেওয়া হয়। তবে পিসিওএস, পিসিওডি সামলে নিয়েই কনসিভ করার কথা ভাবা ভাল।
ত্বকের নানা সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য গাইনিকলজিস্টরা আবার অনেক ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেনের সঙ্গে অ্যান্টি মেল হরমোনাল ওষুধও দেন। রোগী পরামর্শ নিতে পারেন ডার্মাটোলজিস্ট এবং কসমেটোলজিস্টের কাছ থেকেও।
এ ছাড়া সাধারণত পিসিওএস এবং পিসিওডির ক্ষেত্রে সার্জারির দরকার পড়ে না। তবে চিকিৎসকেরা রোগীর অবস্থা বুঝে ল্যাপ্রোস্কোপিক ওভারিয়ান ড্রিলিং ট্রিটমেন্ট করতে পারেন।
খাবারদাবার ও শারীরচর্চা
পিসিওডি ও পিসিওএস মোকাবিলা করার জন্য ঠিকঠাক ডায়েট মেনে চলা উচিত। যে খাবার খেলে ওজন অতিরিক্ত বাড়বে না অথচ শরীর থাকবে সুস্থ। ডায়াটিশিয়ান সুবর্ণা রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘লো কার্ব, হাই ফাইবার, স্বাস্থ্যকর ফ্যাট এবং পরিমিত প্রোটিন খেতে হবে। সাধারণ ভাত-রুটির বদলে ব্রাউন রাইস, আটার রুটি, ব্রাউন ব্রেড খেতে হবে, যাতে আছে লো গ্লাইসেমিক রেট। রান্না করা যেতে পারে অলিভ, ক্যানোলা, পিনাট বা আমন্ড অয়েলে। সেটা সম্ভব না হলে রান্নায় ব্যবহৃত তেলের পরিমাণ কমাতে হবে। সবুজ শাক, আনাজপাতি রাখা দরকার। তবে আম, কলা, আতা, আঁখ, কাঁঠাল বাদ দিলে ভাল হয়। ভাল মানের প্রোটিনও জরুরি। ডিম খেতে হলে কুসুম বাদ দিয়ে খেতে পারেন। অতিরিক্ত তেলযুক্ত মাছ নয়। দুধ খেলে লো ফ্যাট মিল্ক নিন। ডাল, ব্রকোলি, বেরি রাখুন খাদ্যতালিকায়।’’
ব্যায়াম, শারীরিক কসরতের মাধ্যমে যতটা সম্ভব অ্যাকটিভ থাকলে, তা সাহায্য করবে রোগ মোকাবিলায়। ব্রিস্ক ওয়াকিং, যোগাভ্যাস, জগিং, স্কিপিং, সাঁতার কাটা... যে কোনও কিছু রোজ করতে হবে নিয়ম মেনে। ওজন যত কমবে, অ্যাবডোমিনাল এরিয়ায় মেদ যত ঝরবে, ততই সুস্থ থাকবে শরীর। তাই পিসিওডি এবং পিসিওএস রুখতে হাতিয়ার করুন নিয়মিত খাওয়াদাওয়া এবং সংযত জীবনযাপনকে।
মডেল: রিয়া বণিক, মুনমুন রায়
ছবি: সুপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়, অমিত দাস (মুনমুন)
মেকআপ: নবীন দাস, মৈনাক দাস (মুনমুন)
লোকেশন: আইবিস, রাজারহাট
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy