Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Diwali 2019

হাতে বানানো বাজির আলোয় উজ্জ্বল হত দীপাবলির রাত

বাজি কেমন তৈরি হচ্ছে তা জ্বালিয়ে পরীক্ষা করার মধ্যে এক আশ্চর্য উত্তেজনা ছিল।

আগে দিন সাতেক ধরে চলত বাজি বানানোর এক প্রকাণ্ড কর্মযোগ্য।

আগে দিন সাতেক ধরে চলত বাজি বানানোর এক প্রকাণ্ড কর্মযোগ্য।

রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:৫৫
Share: Save:

বাজি হল এমনই এক আনন্দ যা একা পেয়ে কোনও সুখ নেই। রেস্তরাঁয় একলা খেয়ে যেমন ঠিক মৌতাত হয় না, একা একা সিনেমা-থিয়েটার দেখায় যেমন কোনও মজা নেই, একলা কোথাও বেড়াতে গেলে যেমন কোনও আনন্দই হয় না, তেমনই একা একা বাজি পোড়ানোরও কোনও মানে নেই। খবরের কাগজ জড়িয়ে আলমারির মাথায় তুলে রাখা আগের বছরের পুরনো বাজি, রোদ্দুরে দিনকতক পাঁপড়ের মতো সেঁকে, প্রথম জ্বালানো হত বিজয়া দশমীর দিন সন্ধেবেলায়। এ দিন হয়তো সাকুল্যে তিনটে তুবড়ি, চারটে রংমশাল, দু-প্যাকেট ফুলঝুরি আর গোটা সাত-আট বসন-চরকি পাওয়া যেত। বিজয়ার দিন ভাগ্নে-ভাগ্নিকে নিয়ে দিদি-জামাইবাবু আসত। মাসি-পিসির সঙ্গে আসত মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনেরা। ওদের সঙ্গে নিয়েই ওইটুকু বাজি পোড়ানো হত। তাতেই কত আনন্দ। ওরা সবাই আবার আসত ভাইফোঁটায়। তাই ভাইফোঁটার রাত্তিরে পোড়ানো হবে বলে বাড়ির বড়রা এ-বছরের কিছু টাটকা বাজি কালীপুজোর দিনই আগাম সরিয়ে রাখতেন।

আগে অনেক বাড়িতেই তুবড়ি বা রংমশাল বানানো হত। সেগুলো বানানো হত বাড়ির কোনও না কোনও দাদু-জ্যাঠা-কাকা বা মামার চূড়ান্ত নজরদারিতে। দিন সাতেক ধরে চলত এক প্রকাণ্ড কর্মযোগ্য। সারা দুপুর ধরে ওই সব বাড়ির ভেতর থেকে ঠং-ঠং করে হামানদিস্তেয় লোহাচুর, গন্ধক, সোরা, অ্যালুমিনিয়াম, কাঠকয়লার মতো জিনিসপত্র গুঁড়োনোর আওয়াজ ভেসে আসত। আগে পেতলের খুদে দাঁড়িপাল্লায় বাজির মালমশলাগুলো আলাদা আলাদা মেপে নিয়ে তারপর সাবধানে মেশানো হত। এর পর বসন-তুবড়ির জন্য মাটির খোলে বুড়োআঙুল ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে, আর রংমশালের জন্য মোটা কাগজের চোঙে পেনসিলের পিছন দিয়ে সেই মশলা ঠাসতে হত। উড়নতুবড়ি ঠাসার জন্য দরকার হত খোঁপার কাঁটা। বাজি কেমন তৈরি হচ্ছে তা জ্বালিয়ে পরীক্ষা করার মধ্যে এক আশ্চর্য উত্তেজনা ছিল। কালীপুজোর আগের হপ্তায় সন্ধের দিকে, এই ভাবে টেস্ট করার জন্যে হঠাৎই জ্বলে ওঠা একটি বসনতুবড়ি বা একটি উজ্জ্বল রংমশাল দেখবার জন্য আমরা পড়িমরি করে ছুটে যেতাম বাইরের বারান্দায়।

আগে কালীপুজোর দিন চারেক আগে বাঙালিরা টাটকা বাজি কিনে আনতেন ক্যানিং স্ট্রিটের চিনেপট্টি থেকে। বড় বড় ক্যাম্বিসের ব্যাগ ভর্তি বাজি নিয়ে বাসে-ট্রামে ওঠারও কোনও ঝঞ্ঝাট ছিল না। সেই ব্যাগ-হাতে কত্তারা যখন বাড়ি পৌঁছতেন, তখন ছোটদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। এখন যেমন পাড়ার পান-বিড়ির দোকানেও কিছু কিছু বাজি পাওয়া যায়, তখন কিন্তু স্থানীয় বাজারের দু’-একটি হাতে-গোনা দোকান ছাড়া আর কোথাও বাজি রাখার রেওয়াজ ছিল না। রকেট, রংমশাল, তুবড়ি বা চরকির মতো দামি বাজি, দক্ষিণ ভারতের শিবকাশীতেই তৈরি হত। ‘কক’ আর ‘পিকক’ এই দু’টিই ছিল প্রধান ব্র্যান্ড। এদের বাক্সে লেখা ঠিকানায় মনে আছে, খুদি-খুদি করে লেখা থাকত ‘শিবকাশী’। ফুলঝুরির বাক্সের ওপর বড় বড় করে লেখা থাকত ‘রাজকুমারী’। নীচে ছবি, এক জন অপ্সরা হাতে একটি ফুলঝুরি নিয়ে নাচছে।

আরও পড়ুন: বাজির আগুনে বেশি পুড়ে গেলে কী ভাবে প্রাণ বাঁচাবেন?

ছোটদের বাজি পোড়ানোর সময় মাথায় দিতে হত কানঢাকা-টুপি, সে যত গরমই লাগুক-না-কেন!

বাড়িতে কিনে আনা বাজি মাটিতে রাখলে পাছে সেঁতিয়ে যায়, তাই ওদের উঁচু কোনও জায়গায় তুলে রাখা হত। আর আমাদের মতো কুচোকাঁচাদের ওপর দায়িত্ব পড়ত রোজ দুপুরে তাদের ছাদের রোদে তাতাতে দেওয়ার আর বিকেলে তুলে নেওয়ার। তাতানো হত যাতে বাজির ভেতরের বারুদগুলো মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের সেন্টার ফরোয়ার্ডের মতো একদম চাঙ্গা হয়ে থাকে। প্রতি বার বাজি ঘাঁটার পর দু’বার করে সাবান দিয়ে হাত-ধোয়াটা ছিল কম্পালসারি।

কালীপুজোর দিনে বাজি পোড়ানোর আগে একটি মোটাসোটা মোমবাতি ও একবাক্স দেশলাই বাজির ব্যাগে রেখে দেওয়া হত। বাড়ির ছাদের পাঁচিল এবং বারান্দার রেলিং-এর ওপরটা সরু সরু মোমবাতি দিয়ে টানা সাজানো হত। বাজির স্টকের ব্যাগটা সিঁড়িঘরে কিংবা এমন কোনও জায়গায় এমন সাবধানে রাখা থাকত, যাতে আগুনের ফুলকি কোনও ভাবেই সেটা ছুঁতে না-পারে। ছোটদের বাজি পোড়ানোর সময় বন্ধ-জুতো পরতে হত। গায়ে দিতে হত সুতির জামা আর তার ওপর হাফহাতা সোয়েটার। মাথায় দিতে হত কানঢাকা-টুপি, সে যত গরমই লাগুক-না-কেন! আর হাতে নিতে হত লম্বা পাটকাঠি। যার মাথায় ফুলঝুরি গুঁজে, যথেষ্ট দূর থেকে তাই দিয়ে রকেট, তুবড়ি বা চরকি জ্বালানোর পারমিশন পাওয়া যেত। এই সাবধানতার কারণ আর কিছুই নয়, যদি কোনও কারণে বাজিটা বার্স্ট করে, তার আঁচ যেন হাত বা মুখের ওপর না-পড়ে। আগে পুজোর ছুটির পরেই স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা হত। তাই আমাদের ইনস্ট্রাকশন দেওয়া থাকত বাঁ হাতে করে বাজি জ্বালাবার। মানে, বাঁ হাত যদি কোনও কারণে জখমও হয় ডান হাতে পরীক্ষা দেওয়াটা যেন না আটকায়!

বাড়িতে কালীপুজোর রাত্তিরের মেনু, লুচি, বেগুনভাজা, ছোলার ডাল, আলু-ফুলকপির ছেঁচকি এবং খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি। এটা বানিয়ে মা-জ্যাঠাইমারা গা-ধুয়ে, সন্ধে-দিয়ে রেডি হয়ে যেতেন। তারপর সবাই মিলে বাড়ির উঠোন বা ছাদে গিয়ে বাজি পোড়ানো শুরু হত। সেরা সেরা বাজিগুলো জ্বালানো হত রাত সাড়ে ন’টার দিকে। সেই সময় আশপাশের বাড়ির সবাই বাজি পোড়ানোর জন্য যে যার ছাদে জড়ো হত। একটা ভাল রকেট আকাশ ফুঁড়ে উঠে গিয়ে, তারার মালা নিয়ে ভেসে গেলে কিংবা একটা তুবড়ির হাইট চার তলার মতো উঁচু হলে, নাটকের গ্যালারির মতো বাড়িগুলোর ছাদ থেকে চটাপট-চটাপট হাততালির আওয়াজ ভেসে আসত।

আরও পড়ুন: বাজির ধোঁয়ায় ত্বকের ক্ষতি হয় মারাত্মক, রুখে দিন এ সব উপায়ে

আগে চকোলেট-বোম (বুড়িমা কম্পানির), দোদমা, বাক্সবোম, আলুবোম— এ সব এনতারসে ফাটত। এখন শব্দ ও বায়ুদূষণের জ্বালায় এগুলো বন্ধ হয়ে খুব ভাল হয়েছে। সেভেন-এইটে পড়ার সময় কালীপুজোর পরের দিন সকালে হরিশ পার্কের বিভিন্ন গাছের তলায়, ছোট্ট-ছোট্ট বেশ কিছু পাখির নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখতাম। দেখতাম নর্দান পার্কে আর মামার বাড়ির পাশে টালা পার্কেও। দেখে একটা অদ্ভুত কষ্ট হত। এখন এই দৃশ্য আর সে ভাবে নজরে পড়ে না। আসলে, দেরিতে হলেও মানুষ যদি নিজের ভুল বুঝতে পারে, সেটাও কিন্তু বড় কম কথা নয়!

কার্টুন: দেবাশীষ দেব

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy