Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

কলকাতা কতটা ঠুঁটো, বুঝিয়ে গেলেন নারায়ণ

খিঁচুনির জ্বরে মহানগরে আরও একটি প্রাণহানি। নিছক উপসর্গ নয়, রোগীর রোগ শনাক্তও হয়েছিল। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস। যার সংক্রমণের উৎস কলকাতায় না-হলেও শুক্রবার তাঁর মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এ শহর কত অসহায়! নিজেদের ভেন্টিলেটর না-থাকায় ওঁর জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে যন্ত্রটি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন।

মৃতদেহ নিয়ে অপেক্ষা। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে নারায়ণ সরকারের আত্মীয়-পরিজনেরা।

মৃতদেহ নিয়ে অপেক্ষা। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সামনে নারায়ণ সরকারের আত্মীয়-পরিজনেরা।

সায়নী ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৫
Share: Save:

খিঁচুনির জ্বরে মহানগরে আরও একটি প্রাণহানি। নিছক উপসর্গ নয়, রোগীর রোগ শনাক্তও হয়েছিল। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস। যার সংক্রমণের উৎস কলকাতায় না-হলেও শুক্রবার তাঁর মৃত্যু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, এ শহর কত অসহায়!

নিজেদের ভেন্টিলেটর না-থাকায় ওঁর জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে যন্ত্রটি ভাড়া করে নিয়ে এসেছিল স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন। তাতেও শেষরক্ষা হয়নি। কারণ, বারবার চেষ্টা


নারায়ণ সরকার

করেও সেটি চালানো যায়নি। পরে দেখা গেল, বিকল ভেন্টিলেটরই ভাড়া দিয়েছে মেডিক্যাল! এই টানাপড়েনের মাঝে নষ্ট হয়ে যায় মূল্যবান সময়। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসে আক্রান্ত সেই নারায়ণ (হরিপদ) সরকারের অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হতে থাকে ঘড়ির কাঁটা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে। বৃহস্পতিবার রাতে মুমূর্ষু রোগীকে ফেরত পাঠানো হয় সেই মেডিক্যাল কলেজেই, যেখান থেকে চার দিন আগে তাঁকে ট্রপিক্যালে রেফার করা হয়েছিল। মারণ ভাইরাস ততক্ষণে তাঁর শরীরে অতি সক্রিয় হয়ে গিয়েছে ।

রাত পোহাতে লড়াইও ফুরিয়ে গেল নারায়ণবাবুর। শুক্রবার সকালে মেডিক্যাল কলেজে মারা গেলেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার ওই কর্মী। তুলে দিয়ে গেলেন পশ্চিমবঙ্গের সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবা সম্পর্কে একরাশ প্রশ্ন।

শুরুটা হয়েছিল এক মাস ছ’দিন আগে, গুয়াহাটিতে। কাঁচরাপাড়ার বিক্রমপুর কলোনির বাসিন্দা নারায়ণবাবু কর্মসূত্রে সেখানে ছিলেন। পরিজনেরা জানান, ২৪ জুন তাঁর ধুম জ্বর আসে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় অচেতন হয়ে পড়েন। সে দিনই গুয়াহাটির এক নার্সিংহোম ঘুরে তাঁকে ভর্তি করা হয় গুয়াহাটি মেডিক্যাল কলেজে। সেখানে রক্ত পরীক্ষায় ধরা পড়ে, জাপানি এনসেফ্যালাইটিস। তিন দিন বাদে, ২৭ জুন তাঁকে গুয়াহাটিরই এক বড় নার্সিংহোমে স্থানান্তরিত করা হয়। এক নিকটাত্মীয় এ দিন সকালে মেডিক্যাল চত্বরে দাঁড়িয়ে বলেন, “নার্সিংহোমে উনি দিন পঁচিশেক ছিলেন। সুস্থ তো হনইনি, উল্টে সাড়ে চার লাখ টাকার বিল ধরানো হয়। তখনই আমরা ঠিক করি, ওঁকে বাড়িতে নিয়ে আসব।”

তা-ই এনেছিলেন। ২২ জুলাই নারায়ণবাবুকে কল্যাণীর জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেখানেও অবস্থার উন্নতি না-হওয়ায় সোজা কলকাতা। সেটা ২৩ জুলাই। ভোগান্তির নতুন অধ্যায়েরও সূচনা। কী রকম?

পরিবারের অভিযোগ, একটা বেডের জন্য সে দিন হন্যে হয়ে ঘুরতে হয়েছে। এনআরএস, ট্রপিক্যাল, মেডিক্যাল, আইডি। কোথাও ঠাঁই মেলেনি। রোগীর অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছে। “এনআরএসে বেড ছিল না। ওরা বলল ট্রপিক্যালে যেতে। গিয়ে শুনলাম, আউটডোর বন্ধ হয়ে গিয়েছে, তাই ভর্তি হবে না।” বিবরণ দিচ্ছেন এক আত্মীয়। তাঁদের দাবি: এর পরে ওঁরা মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে শোনেন, এই রোগের চিকিৎসা সেখানে হয় না। অগত্যা দৌড়োন বেলেঘাটা আইডি’তে। সেখানেও জায়গা মেলেনি। আত্মীয়টি জানান, “বিস্তর কাকুতি-মিনতি করে মেডিক্যালেই জায়গা মেলে। মেঝেতে পাতা একটা তোষকে নারায়ণবাবুর ঠাঁই হয়। বলা হয়, এটাই বেড!”

পাঁচ রাত মেডিক্যালে কাটে। ২৮ জুলাই নারায়ণবাবুকে ট্রপিক্যালে রেফার করে দেওয়া হয়। সেখানে দিন তিনেক বাদে অবস্থার অবনতি ঘটলে ফের রক্ত পরীক্ষা হয়। দেখা যায়, সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছে। বৃহস্পতিবার ভেন্টিলেটরের দরকার পড়ে। ভাড়া করে যন্ত্র এনেও কাজ হয়নি। পরিবার-সূত্রের খবর: অন্তিম লগ্নে নারায়ণবাবুর শরীরে সংক্রমণ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, বিভিন্ন অঙ্গ এক-এক করে জবাব দিয়ে দেয়। কিডনি, ফুসফুস ও হৃদ্যন্ত্র বিকল হয়ে যায়। মৃত্যু ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

এ দিন সকালে সব শেষ হয়ে যাওয়ার পরে পরিজনেরা স্বাভাবিক ভাবেই সরকারি হাসপাতালে ‘পরিকাঠামোর দুর্দশা’র দিকে আঙুল তুলেছেন। ভাই শিবশঙ্কর সরকারের অভিযোগ, “রোগীকে বার বার এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে হয়েছে। টানাহ্যাঁচড়ায় অবস্থা ক্রমে খারাপ হয়েছে।” ভগ্নিপতি দেবব্রত সরকারের আক্ষেপ, “এক জনের চিকিৎসা করতেই এতগুলো হাসপাতাল হিমসিম! তা-ও খাস কলকাতায়! এখানে নিয়ে এসেছিলাম সুস্থ করে তোলার আশায়। কিন্তু এদের অব্যবস্থার জন্যই ওঁকে এ ভাবে চলে যেতে হল!”

কী জবাব দেবেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তারা? ট্রপিক্যালের অধিকর্তা নন্দিতা বসু এ দিন বলেন, “মেডিক্যাল থেকে ভেন্টিলেটর ধার করে এনে চালানোর অনেক চেষ্টা করেছিলাম। লাভ হয়নি। তাই আর ঝুঁকি না-নিয়ে রোগীকে মেডিক্যালে স্থানান্তরিত করা হয়।” ভেন্টিলেটর আনার আগে যাচাই করে নেওয়া হল না? নন্দিতাদেবীর উত্তর, “জরুরি অবস্থায় এত কিছু পরখ করা সম্ভব নয়।” এ বার প্রশ্ন উঠছে, মেডিক্যাল কেন অচল ভেন্টিলেটর দিল? যা শুনে মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ির জবাব, “সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলতে স্বাস্থ্য-কর্তারা বারণ করে দিয়েছেন।”

স্বাস্থ্যভবন কিন্তু এ দিন দুপুর পর্যন্ত জানত না যে, ভেন্টিলেটর খারাপ ছিল। ঘটনাটি শুনে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “বৃহস্পতিবার রাতেও খোঁজ নিয়েছি! ভেন্টিলেটর খারাপ থাকার তো কথা নয়!” খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানিয়ে সুশান্তবাবুর আশ্বাস, “আবারও বলছি, দক্ষিণবঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।”

অধিকর্তার আশ্বাসে অবশ্য নিশ্চিন্ত হওয়া যাচ্ছে না। বিশেষত নারায়ণবাবুর পরিজনদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। ওই রকম এক রোগীকে নিয়ে ওঁদের কেন এ ভাবে হাসপাতালে-হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতে হল?

এ জন্য অহেতুক রেফারের প্রবণতাকেই দায়ী করছেন সুশান্তবাবু। বলছেন, “খুবই দুঃখজনক। বেশির ভাগ জায়গায় সমস্ত পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও রেফার করার প্রবণতা রয়েছে। এতে দাঁড়ি টানতে সার্কুলার জারি করেছি।” তাঁর এ-ও হুঁশিয়ারি, “কেউ যদি রোগী রেফার করেন, যথাযোগ্য কারণ দেখাতে হবে। না-পারলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

কর্তার কড়া কথায় হাল ফেরে কি না, সেটাই দেখার।

সহ প্রতিবেদন: সৌমিত্র শিকদার
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE