শপিং মল বা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে গেলেই এমন অনেক খাবার হাতে আসে, যার গায়ে ‘সুপারফুড’-এর লেবেল সাঁটা। দামি হোটেলে বা রেস্তরাঁয় লাঞ্চ, ডিনার সারার সময় দেখা হয় মাইক্রোগ্রিনসের সঙ্গে। সে-ও সুপারফুড। কিন্তু একে তারা অপরিচিত, তায় দামও একটু বেশি। তাই অনেকেই ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে হয়তো রেখে দেন। কিন্তু এই সুপারফুড আসলে কী? অন্য খাবারের তুলনায় এতে পুষ্টিগুণই বা কতটা বেশি? সকলের জন্যই কি তা সমান পুষ্টিকর? হানা দেওয়া যাক সুপারফুডের ভাঁড়ারঘরে।
সুপারফুড আসলে কী?
প্রোটিনজাতীয় বা ফ্যাটজাতীয় বলে যেমন কিছু খাবারের ক্যাটিগরি করা যায়, সুপারফুডে তেমন নির্দিষ্ট কোনও ভাগ নেই। বরং সব ধরনের খাবারের গ্রুপেই সুপারফুড থাকতে পারে। ক্লাসের প্রথম-দ্বিতীয় ছাত্রছাত্রীর মতো সুপারফুড সব ক্লাসেই থাকে। ডায়াটিশিয়ান প্রিয়া অাগরওয়াল বললেন, ‘‘এমন কিছু খাবার আছে যাদের পুষ্টিগুণ খুব বেশি। তাদের সুপারফুড বলা যেতে পারে। শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতেও খুব সহায়ক।’’ প্রত্যেক দিনের খাবারে সুপারফুড জুড়লে সেই খাদ্যতালিকা সুষম হয়। কিন্তু ক্লিনিকাল নিউট্রিশনিস্ট হিনা নাফিসের কথায়, ‘‘সব খাবারেরই কোনও না কোনও বিশেষ গুণ আছে। সুপারফুড বলে কিছু খাবারকে কোট করাটা হয়তো ঠিক নয়। জায়গার ভিত্তিতেও সুপারফুড পাল্টে যেতে পারে। ভারতে সকল জায়গাতেই রান্নায় হলুদ দেওয়া হয়। হলুদ দিয়ে দুধ খাওয়ার রীতিও আছে এ দেশের বিভিন্ন প্রদেশে। এই হলুদই আবার পাশ্চাত্যে কিন্তু সুপারফুড। আবার এখানে বেরি (গোজি বেরি, ব্লুবেরি) সুপারফুড হিসেবে বিক্রি হয়, যা বিেদশে সহজলভ্য। মানুষ এমনিই খায়। কিন্তু এখানে দাম বেশি, স্থানীয় বাজারেও পাওয়া যায় না। আসলে আমরা কী খাচ্ছি, তার খাদ্যগুণ জেনে পুরো দিনের খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিলে তাকে বরং বলা যায় সুপারফুড ডায়েট।’’ অর্থাৎ খাদ্যগুণের নিরিখে কিছু খাবার সুপারফুডের মধ্যে পড়লেও শুধু সেগুলি খেলেই চলবে না। সব খাবারের ব্যালান্সেই শরীর সুস্থ থাকবে। ডায়াটিশিয়ান সুবর্ণা রায়চৌধুরীও সহমত, ‘‘কোনও একটি খাবারকে সুপারফুডের ক্যাটিগরিতে ফেলতে চাই না। বাদামে সুপারফুড হওয়ার মতো পুষ্টিগুণ আছে। কিন্তু হাইপারটেনশনের রোগীকে তো বাদাম খেতে দেওয়া যাবে না। তাই যিনি খাচ্ছেন, তাঁর কাছে কোনটা সুপারফুড, কোনটা নয় সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।’’
সোজা করে বললে, কিছু খাবারে পুষ্টিগুণ তুলনামূলক ভাবে বেশি। ওর্যাক ভ্যালুর (অক্সিজেন র্যাডিকাল অ্যাবজ়র্ব্যান্স ক্যাপাসিটি) উপরে নির্ভর করেও কিছু খাবারকে সুপারফুডের ক্যাটিগরিতে ফেলা হয়। খাবারের অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট লেভেল নির্ধারণ করে এই ওর্যাক ভ্যালু। অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস যেহেতু অনাক্রম্যতা তৈরি করে তাই এই ভ্যালুর বিশেষ গুরুত্ব আছে। কিন্তু তাতেও কি প্রয়োজনীয় সব পুষ্টির জোগান সম্ভব? সুতরাং জানতে হবে অন্যান্য খাবার সম্পর্কেও। তবেই বোঝা যাবে কোন কোন খাবারে সব রকমের পুষ্টিগুণ একটু বেশিই আছে। এক দিকে রাখা যাক বাজারে যেগুলো সুপারফুড নামে পরিচিত, সেগুলো। এদের অনেকেই দেশজ নয়, তাই দামও বেশি। আর অন্য দিকে এমন খাবার, যা হয়তো রোজই খাওয়া হয়, কিন্তু তারা যে সুপারফুড সেটা জানা নেই।
বাজারচলতি সুপারফুড
• মাইক্রোগ্রিনস: অঙ্কুরোদ্গম হওয়ার পরে চারা বেরোলে সেটাই খাওয়া হয়। এরাই মাইক্রোগ্রিনস। তবে এই স্প্রাউট মূলত আমন্ড, কুমড়োর বীজ, পিনাট থেকে তৈরি করা হয়। মাইক্রোগ্রিনস তৈরি করার জন্য বীজ কিনতেও পাওয়া যায়। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ই, বি ও কে থাকে। যেহেতু রান্না করা হয় না, কাঁচাই খাওয়া হয়, তাই পুষ্টিগুণও পুরোটাই পাওয়া যায়। তবে মাইক্রোগ্রিনস বাজারে সহজলভ্য নয়। দাম বেশি।
• কিনোয়া: কিনোয়া সিউডোসিরিয়ালস হলেও প্রোটিনে ভরপুর। এ ছাড়া প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকায় শরীরের জন্যও ভাল। কিন্তু কিনোয়াও আমাদের দেশে হয় না, তাই এর দামও বেশি।
• স্পিরুলিনা: এটি এক ধরনের বায়োমাস। অনেকটা শ্যাওলার মতো দেখতে। আর এটি জন্মায়ও জলের মধ্যে। প্রিয়ার কথায়, ‘‘এটি খুব একটা স্বাদু নয়, বরং আর্দি গন্ধ আছে। কিন্তু এর প্রোটিন কনটেন্ট হাই। ভিটামিন বি, ম্যাঙ্গানিজ়ও থাকে প্রচুর পরিমাণে। তাই স্পিরুলিনা খেতে পারলে শরীরের জন্য অনেকটাই ভাল।’’
• বাদাম: আখরোট, আমন্ড, পেস্তা ইত্যাদি বাদামে কিন্তু একইসঙ্গে ফ্যাট, ফাইবার ও প্রোটিন পাওয়া যায়। বাদামের ফ্যাট মোনোস্যাচুরেটেড, তার সঙ্গেই ওমেগা থ্রি ও সিক্স থাকছে। ভিটামিন ই ও ম্যাগনেশিয়ামেরও ভাল উৎস বলা যেতে পারে বাদামকে, যার জন্য ব্রেন ফুড বলা হয়ে থাকে। রোজকার খাবারে অল্প বাদামও রাখতে পারেন।
• বেরি: ওর্যাক ভ্যালু বেশি থাকায় গোজি বেরি, ব্লুবেরি জাতীয় খাবারও পড়ে এই তালিকায়।
রোজকার খাবারে সুপারফুড
হিনা নাফিসের কথায়, ‘‘বিদেশি অনেক খাবারই আমাদের কাছে অপরিচিত। সুপারমার্কেটে বেশি দামে তা সুপারফুড লেবেল সেঁটে বিক্রি হয়। সাধারণের নাগালের বাইরে। কিন্তু ভারতীয় খাবারেই এমন অনেক সুপারফুড আছে, যা হয়তো না জেনেই খাই। হলুদ, অমরন্থ ভারতীয় সুপারফুড। এদের দামও কম, সহজপ্রাপ্য। এমন অনেক আছে।’’ যেমন ফ্ল্যাক্স সিডস। নাম শুনলে মনে হয় নতুন কিছু। এটা হল তিসি। বিহার, উত্তরপ্রদেশে তিসির লাড্ডু খাওয়ার চল আছে।
• স্প্রাউটস: কলওঠা ছোলায় প্রোটিন থাকে প্রচুর পরিমাণে। আর এটি লাইফ ফুড। একটি গাছের চারা বলা যেতে পারে। তাতে জীবনীশক্তি প্রচুর। খাওয়া হয় কাঁচা। পুষ্টিগুণ পুরোটাই বজায় থাকে।
• মশলা: দারুচিনি, লবঙ্গ, হলুদেও প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট থাকে। এদের ওর্যাক ভ্যালুও অনেক। ভারতীয় রান্নায় এর ব্যবহারও কম নয়।
• ডাবের জল: প্রাকৃতিক হেল্থ ড্রিঙ্ক বলা যেতে পারে। এতে তো প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন (থায়ামিন, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ভিটামিন সি) ও মিনারেলস (ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ) থাকে। ১০০ মিলিলিটার ডাবের জলে প্রায় ১৯ ক্যালরি শক্তি পাওয়া যায়। তাই শরীরে ইনস্ট্যান্ট শক্তি বাড়াতেও এর জুড়ি নেই।
• কলা গাছ: শুধু কলা নয়, কলা গাছের ফুল, কাণ্ড সবই কিন্তু এই সুপারফুডের তালিকায় থাকবে। থোড় বাঙালি বাড়িতে হামেশাই হয়ে থাকে। তবে প্রিয়ার কথায়, ‘‘ঘি, মশলা দিয়ে রান্না করে থোড় যে ভাবে খাওয়া হয়, তাতে আর খাদ্যগুণ কিছু অবশিষ্ট থাকে না। থোড় ছাড়িয়ে মাঝের অংশটা বার করে তার রস করে খেতে হবে। মোচাও নুন, হলুদ দিয়ে হালকা সতে করে খেলে বেশি উপকার। কলা তো থাকছেই।’’
এ ছাড়াও ব্রাহ্মী, কুলেখাড়া, ঘি, পাতিলেবু, কুমড়োর বীজ, আমলকী... এ সব খাবারও যথেষ্ট পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। ডিমের সাদা অংশ, মাগুরের মতো জিওল মাছ, রুই, কাতলাও রাখতে হবে রোজকার ডায়েটে।
সকলের জন্য সুপারফুড এক নয়
সুপারফুডের তালিকা নিয়ে বেছে বেছে তা খেলেই কিন্তু চলবে না। ইদানীং অনেকেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে প্রচুর পরিমাণে হলুদ ও আদা খেতে শুরু করেছেন। হিনা নাফিসের কথায়, ‘‘এটা কিন্তু ভীষণ ভুল। অতিরিক্ত পরিমাণে এগুলো খেলে অন্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।’’ যেমন, হলুদ বেশি খেলে ডায়েরিয়া হওয়ার প্রবণতা থাকে। প্রত্যেক দিনের খাবারে যেমন প্রোটিন থাকবে, তেমনই কার্বসও খেতে হবে। জেনারেল ফিজিশিয়ান সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, ‘‘এক খাবারে সব পুষ্টিগুণ থাকে না। মাইক্রো ও ম্যাক্রো নিউট্রিয়েন্টস যা আমাদের শরীরের জন্য ভীষণ দরকার, তা কিন্তু সব খাবারে ছড়িয়ে থাকে। তাই ঘুরিয়েফিরিয়ে সব খাওয়া উচিত। অনেকে রোজই ডাবের জল খেয়ে যান। সে জায়গায় এক দিন ডাবের জল, পরের িদন আপেল, মুসাম্বি ভাগ করে নিতে পারেন। আর সুপারফুডও কিন্তু সকলের কাছে সমান পুষ্টিকর নয়। বিএমআর, বয়স, শারীরবৃত্তীয় সমস্যা আছে কি না সব দেখে খাবার খেতে হবে। দুধ শিশুদের জন্য সুপারফুড। কিন্তু কিডনির অসুখে আক্রান্ত রোগীদের জন্য নয়।’’ মানুষের শরীরের উপরেও নির্ভর করে সেই খাবার তার কাছে আদৌ সুপারফুড কি না।
প্রকৃতি কিন্তু অনেক খাবার দিয়েছে। আনাজপাতি, ডাল সবই ঘুরিয়েফিরিয়ে খান। একই খাবার একটানা খেয়ে যাবেন না। কার্বসও পাল্টাতে পারেন। দিন তিনেক ভাত খেয়ে দু’দিন আটার রুটি খেলেন, একদিন বাজরার রুটি খেলেন, এক দিন ডালিয়া খেলেন। এতে সব রকমের পুষ্টিই শরীরে পৌঁছবে।
মডেল: ডিম্পল আচার্য; ছবি: বিপ্রদীপ চক্রবর্তী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy