Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
lifestyle section

ভারতীয় সংস্থাগুলি অল্প সময়ে প্রচুর টিকা বানাতে পারবে কি না তা নিয়ে ধন্ধ

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

গ্রাফিক: তিয়াসা দাস।

নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৫:৫৭
Share: Save:

টিকা উৎপাদনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরেও দ্রুত হারে সংক্রমণ রুখতে অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় সংস্থাগুলি কোভিড টিকা বানিয়ে উঠতে পারবে কি না তা নিয়ে যথেষ্টই সংশয়ে বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের আরও সন্দেহ, উৎপাদন যদিও বা প্রয়োজনের কাছাকাছি পৌঁছয়, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দুর্গম রাজ্যগুলির গ্রামাঞ্চল ও প্রত্যন্ত অঞ্চল আর অত্যন্ত দুর্গম হিমালয়ের লাদাখের সর্বত্র তা সহজে পৌঁছে দেওয়া যাবে না। যথাযথ যোগাযোগব্যবস্থার অভাবে। তার ফলে, এই মুহূর্তেই কম করে যে ৪০ কোটি ভারতীয় নাগরিককে কোভিড টিকা দেওয়া প্রয়োজন, তা সম্ভব না হওয়ারই আশঙ্কা প্রবল।

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার’ এই খবর দিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের সংক্রামক রোগের টিকা সরবরাহে একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে ভারতীয় সংস্থাগুলি। গত দু’-তিন দশক ধরেই। অল্প আয়ের দেশগুলিতে যত ধরনের টিকা পাঠানো হয় বিভিন্ন দেশ থেকে, তার ৬০ শতাংশেরই প্রস্তুতকারক সংস্থা ভারতীয়।

‘‘এর ফলে, তা সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রোজেনেকার যৌথ উদ্যোগে বানানো টিকাই হোক বা ফাইজার অথবা মডার্না, জনসন অ্যান্ড জনসনের বানানো টিকা, এ দেশে তৈরি করে সেই সব টিকা অল্প আয়ের দেশগুলিতে পাঠানোর বরাতটা যে প্রথম ভারতীয় সংস্থাগুলিই পাবে, তা নিয়ে অন্তত কোনও সন্দেহ নেই’’, বলছেন পুণের ‘সিপিসি অ্যানালিটিক্স’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাহিল দেও। ভারতে কী ভাবে কত তাড়াতাড়ি কোভিড টিকা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব, আপাতত তা নিয়েই কাজ করছে সংস্থাটি।

কিন্তু সংশয় দেখা দিয়েছে, ভারতীয় টিকা সংস্থাগুলির পক্ষে তা কতটা সম্ভব হবে?

গত ৩০ অগস্ট ভারতে এক দিনে নতুন করে ৭৯ হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। যা ভারতে একটি রেকর্ড। সরকারি পরিসংখ্যানেরই আভাস, সংক্রমণ এই হারে হলে আগামী বছরের গোড়ার দিকে করোনা সংক্রমিত মানুষের সংখ্যার নিরিখে ভারত বিশ্বে এক নম্বর জায়গায় পৌঁছে যাবে।

সংক্রমণের এই হারের গতিতে রাশ টানতেই ভারতের বাজারে যত তাড়াতাড়ি যত বেশি সংখ্যায় সম্ভব কোভিড টিকা নিয়ে আসা জরুরি। যাঁরা ইতিমধ্যেই ভয়ঙ্কর ভাবে সংক্রমিত হয়েছেন বা বহু মানুষের সংস্পর্শে আসছেন, তাঁদেরই কোভিড টিকা দেওয়ার প্রয়োজন সকলের আগে।

গ্রামে অন্যান্য টিকাদান। সামাজিক দূরত্বের প্রয়োজন নেই যেখানে। -শাটারস্টকের সৌজন্যে।

‘‘মূল সমস্যাটা এখানেই। কারণ, দ্রুত সংক্রমণের হারে লাগাম পরাতে গেলে সবচেয়ে আগে টিকা দিতে হবে যাঁরা ইতিমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের। তার পর টিকা দিতে হবে তাঁদের, যাঁরা অন্যান্য রোগে ভুগছেন দীর্ঘ দিন ধরে। আর টিকা দিতে হবে প্রবীণদের। সেই সংখ্যাটাই ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। ৪০ কোটি। তার মানে, অন্তত প্রয়োজনের তিন গুণ (১০০ কোটি) টিকা বানাতে হবে ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলিকে। কারণ, উৎপাদিত টিকার বেশ কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাবে। তা ছাড়াও চুক্তি অনুযায়ী, অন্য অল্প আয়ের দেশগুলিকে কম দামে সেই টিকা সরবরাহ করতে হবে ভারতকে। ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির পক্ষে খুব অল্প সময়ে এত টিকা বানানো সম্ভব নয়। তা ছাড়াও সেই টিকা অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও দুর্গম এলাকাগুলিতে। যা আরও অসম্ভব’’, বলছেন ভেলোরের ক্রিশ্চান মেডিক্যাল কলেজের ভ্যাকসিনোলজিস্ট গঙ্গাদীপ কাঙ।

আরও পড়ুন- আমেরিকাতেও কি ট্রায়াল শেষের আগেই ভ্যাকসিন!

আরও পড়ুন- ২০২১-এর মাঝামাঝির আগে ব্যাপক হারে কোভিড টিকা আসার সম্ভাবনা কম

এই পরিস্থিতিতে ভারত যে অল্প আয়ের দেশগুলিতে কোভি়ড টিকা সরবরাহের দায় এড়াতে পারবে, তা-ও নয়। গত জুলাইয়েই একটি অনলাইন সম্মেলনে ‘লন্ডন স্কুল অফ হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন’-এর অধিকর্তা পিটার পায়ট বলেছেন, ‘‘ভারতকে বাদ দিয়ে বিশ্বকে কোভিড সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।’’ কেন্দ্রীয় সরকারই ছিল সেই অনলাইন সম্মেলনের আয়োজক।

কী ভাবে এই সমস্যার সুরাহা হয়, তার উপায় খুঁজতে একটি টাস্ক ফোর্স গড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। যার শীর্ষে রয়েছেন সরকারি থিঙ্কট্যাঙ্ক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউশন ফর ট্রান্সফর্মিং ইন্ডিয়া’-র সদস্য বিনোদ পল। টাস্ক ফোর্সে রয়েছেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির বিভিন্ন এজেন্সির প্রতিনিধিরাও।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা প্রস্তুতকারক সংস্থাটি ভারতীয়। পুণের ‘সিরাম ইনস্টিটিউট’। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রোজেনেকার সঙ্গে সিরামের চুক্তি হয়েছে, ১০০ কোটি কোভিড টিকা বানাতে হবে সিরামকে। অল্প সময়ের মধ্যে। যদি তা ব্যবহারের জন্য সরকারি অনুমোদন পায়। অক্সফোর্ডের এই টিকার এখন ফেজ-থ্রি পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ব্রিটেন, ব্রাজিল ও আমেরিকায়।

‘‘সেই টিকা কার্যকরী প্রমাণিত হলে, উৎপাদনের অর্ধেক পরিমাণ টিকা অল্প আয়ের দেশগুলিকে সরবরাহ করার ব্যাপারে ভারত সরকার ও সিরাম প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’’, বলছেন সিরামের চিফ এগজিকিউটিভ আদর পুনাওয়ালা।

তিনি এও জানিয়েছেন, ওই টিকা বানানোর জন্য ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০০ কোটি টিকা বানোনোর লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। তবে সবটাই সরকারি অনুমোদনসাপেক্ষ।

আদরের কথায়, ‘‘সংস্থা এই মুহূর্তে মাসে ৬ থেকে ৭ কোটি টিকা বানাতো পারে, পূর্ণ সক্ষম অবস্থায়। সংস্থার দু’টি কারখানাকে বলা হয়েছে, অন্যান্য টিকা বানানোর কাজের গতি কিছুটা শ্লথ করে সেখানেও কোভিড টিকা বানানো হোক।’’

আদর এও জানিয়েছেন, অক্সফোর্ডের কোভিড টিকা ভারতে কার্যকরী প্রমাণিত না হলে বিকল্প উপায়ের কথাও ভেবে রাখা হয়েছে। আরও চারটি কোভিড টিকা নিয়েও কাজ হচ্ছে। তার মধ্যে দু’টি ভারতে বানানো হয়েছে। একটি বানানো হচ্ছে মেরিল্যান্ডের বায়োটেকনোলজি সংস্থা ‘নোভোভ্যাক্স’-এর সঙ্গে। অন্যটি বানানো হচ্ছে নিউ ইয়র্কের সংস্থা ‘কোডাজেনিক্স’-এর সঙ্গে।

গ্রামে অন্যান্য টিকা দেওয়া হয় এই ভাবেই। ছবি- শাটারস্টকের সৌজন্যে।

‘‘তবু ভারতের ৪০ কোটি নাগরিকের জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে কোভিড টিকা বানিয়ে ফেলা যাবে বলে মনে হচ্ছে না। অনেক বেশি সময় লাগবে। আর ওই সময়ে সংক্রমণ শহরগুলি থেকে ভারতের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে যাবে। কারণ সেই সব জায়গায় স্বাস্থ্য পরিকাঠামো খুবই দুর্বল’’, বলছেন পুণের ‘সিপিসি অ্যানালিটিক্স’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাহিল দেও।

একই কথা বলেছেন দিল্লির ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেস (এমস)’-এর অধিকর্তা রণদীপ গুলেরিয়াও।

দেশের বিশিষ্ট ভ্যাকসিনোলজিস্ট গঙ্গাদীপ কাঙ বলেছেন, ‘‘টিকা দিয়ে ভারতে কোভিড নির্মূল করার কাজটা খুব সহজ হবে না। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে সেটা কয়েক বছর লেগে যাবে। সাড়ে ৪০ কোটি শিশুকে হাম আর রুবে লার টিকা দিতেই লেগে গিয়েছে তিন বছর।’’

গুলেরিয়া অবশ্য বলেছেন, ‘‘যে ভাবে গত বছর দেশের দুর্গম, প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও পৌঁছে গিয়ে ভোটগ্রহণ সম্ভব করে তুলেছিলেন ভোটকর্মীরা, সেই ভাবে এই সমস্যা মেটানো যায় কি না, দেখতে হবে।’’

যদিও গঙ্গাদীপ সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘টিকা দেওয়ার কাজটা আরও কঠিন। টিকা ঠান্ডা জায়গায় রাখতে হবে। যাঁরা টিকা দেবেন তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেই প্রশিক্ষণের জন্য নিড্‌ল ও সিরিঞ্জ কেনারও খরচ অনেক। সেই খরচ কে জোগাবে সেটাও দেখতে হবে।’’

সরকার? বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করেন, এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার সেই দায় নেবে না। নিতে চাইবে না। সাহিল বলেছেন, ‘‘সরকার শুধুই সমাজের দুর্বলতম অংশটিকেই টিকা দেওয়ার খরচ জোগাবে বলে আমার মনে হয়।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy