সব আনন্দ পুজোর চার দিনেই ফুরিয়ে ফেলবেন না।
সারা বছর ধরে যে উৎসবের পথ চেয়ে থাকা, তার আয়ু খুব কম। দুর্গাপুজোর ক’টা দিন, তার পরে কালীপুজোয় এসে শেষ। পুজোর মাসখানেক আগে থেকে শুরু হয় শপিং। তার পর দুর্গাপুজো-লক্ষ্মীপুজো পার হয়ে একটু পড়াশোনা শুরু হতেই আবার কালীপুজো। কিন্তু সে উৎসবও দু’দিনেই শেষ। দীপাবলির আলো কমে যেতেই যেন মনখারাপের অন্ধকার ঘিরে ধরে সকলকে। বড়দেরই কাজে মন বসতে চায় না, ছোটদের কোন মুখে পড়তে বসার কথা বলবেন! কিন্তু সন্তানকে যে একটু একটু করে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে রোজকার রুটিনে। সেই জন্য মা-বাবারও প্রস্তুতি দরকার।
তাড়াহুড়ো করবেন না
রুটিনে ফিরুন ধীরে ধীরে। বড়দের ক্ষেত্রে বলি, সম্ভব হলে পুজোর ছুটির আগে কিছু কাজ এমন ভাবে এগিয়ে রাখার চেষ্টা করুন, যাতে একাদশীতে বাঁধভাঙা কাজের চাপে পড়তে না হয়। যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় কাজের চাপ সামলান। যা এড়ানো যাবে না, তা নিয়ে মাথা গরম করে লাভ নেই। উৎসবের মেয়াদ তো অল্পই। যা সুন্দর, তা-ই ক্ষণস্থায়ী এবং তা ক্ষণস্থায়ী বলেই সুন্দর।
কনসালট্যান্ট সাইকোথেরাপিস্ট জলি লাহা বললেন, “ছোটদের ক্ষেত্রে স্কুলে যাওয়ার কিছু আনন্দ উত্তেজনা থাকে। অনেক দিন পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়া। ছুটি কার কেমন কাটল, কে ক’টা ঠাকুর দেখল, সেই অভিজ্ঞতা নিজেদের মধ্যে শেয়ার করা— এই আকর্ষণগুলো দিয়ে ছোটদের আগ্রহ জাগিয়ে তুলতে হবে। পড়াশোনার ব্যাপারে বাড়ির লোক এবং স্কুলের মিলিত সহযোগিতা দরকার। স্কুল খুলেই যেন অনেকটা চাপ দেওয়া না হয়। এত দিন তো আনন্দ করলে, এ বার বেশি করে পড়তে হবে, দিনে এক ঘণ্টা করে বেশি পড়ে এগিয়ে থাকতে হবে— এ যুক্তি বাচ্চাদের মন গ্রহণ করতে পারে না, বাচ্চারা খুব অনাগ্রহী হয়ে পড়ে। বড়দের এখানে ধৈর্য ধরতে হবে, ধীর গতিতে অল্প অল্প করে কাজে ফেরাতে হবে। আনন্দের রেশটা ধীরে ধীরে কাটতে দিতে হবে এবং ক্রমশ পড়াশোনার রুটিনে ফিরতে হবে।” এই পদ্ধতিতে যেন ভারসাম্যের অভাব না হয়।
বাঁচিয়ে রাখুন আনন্দের রেশ
সব আনন্দ পুজোর চার দিনেই ফুরিয়ে ফেলবেন না। ধরুন, পরিবারের সঙ্গে একটা দারুণ সিনেমা দেখা, কিংবা বড় কোনও রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া, এগুলো রেখে দিন পুজোর পরবর্তী সপ্তাহান্তের জন্য। এতে পুজো পরবর্তী মনখারাপ চেপে বসতে পারবে না। পরিবারের ছোটরাও রিলিফ পাবে। প্রথম ক’দিন ঘণ্টাখানেক কি ঘণ্টাদুয়েকের বেশি পড়ার জন্য জোর করবেন না।
আইআইটি খড়্গপুরের সিনিয়র কাউন্সেলর দেবারতি আচার্য বললেন, “উৎসব-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাচ্চার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে বসে একটা টাইমটেবল তৈরি করতে হবে। এ সময় বাচ্চাদের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বিরতি রাখা খুব দরকার। ৩০-৪০ মিনিট পড়ার পর ভাল না লাগলে, তখনই ১০-১৫ মিনিটের জন্য উঠে পড়তে হবে। সে সময়ে হয়তো পাড়ার দোকান থেকে কিছু একটা কিনে আনল। এতে তার শরীর সঞ্চালন হল, বাইরের লোকের সঙ্গে কথাবার্তা হল, মনটা হালকা হল। আবার ৩০-৪০ মিনিট পড়ার পর হয়তো বন্ধুর সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলে নিল। তার পরের ব্রেকে হয়তো ছোটখাটো খাবার খেল কিংবা বাড়ির বাগানে ফুলগাছের পরিচর্যা করল। এই রুটিনের মধ্য দিয়ে গেলে বাচ্চারা যতটুকু পড়ছে, তা পূর্ণমাত্রায় কার্যকর হয়। একঘেয়েমিও আসে না।”
প্ল্যান প্রোগ্রামের ক্যালেন্ডার
পরিবারের সঙ্গে, বিশেষত ছোটদের সঙ্গে এমন সব পরিকল্পনায় সময় কাটান, যাতে মন ভাল থাকে। কালীপুজো কিংবা ভাইফোঁটার পর দিনকয়েকের জন্য কাছাকাছি কোথাও থেকে ঘুরে আসতে পারেন, শুরু করে দিন তার প্ল্যান। কিংবা ধরুন ডিসেম্বরের শেষ দিকটা আপনার শ্যালিকার বিয়ে। ট্রেনে করে গিয়ে থাকতে হবে তিন-চার দিন। সে সব নিয়ে আলোচনা করুন। বিষণ্ণতার অন্ধকার কাটাতে এই সব আলোর ঝলক খুব কাজ দেয়।
সুস্থ শরীর ও সুস্থ মন
পুজোর কয়েক দিন বেশ অনিয়ম গিয়েছে সকলেরই। তাই এ বার খাওয়াদাওয়া নিয়মমাফিক করুন, শুরু করে দিন ফ্রিহ্যান্ড শারীরচর্চাও। বাড়ির ছোটদেরও নিয়ে আসুন ফিটনেস রেজিমে। তাকে নির্দেশ না দিয়ে, নিজের সঙ্গে সঙ্গেই ব্যায়াম করান। ছোটরা যদি খুব বেশি বায়না করে বা বিরক্ত করে, শান্ত হয়ে সামলান। শান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে তাদের পাঁচ-দশ মিনিট বসে এক থেকে ১০০ এবং আবার ১০০ থেকে এক— এই ভাবে গুনতে বলুন। এতে ধৈর্য বাড়বে। বাড়িতে কম তেল মশলাযুক্ত, পুষ্টিকর খাবার রান্না করলে বাড়ির সকলেই সে খাবার খেতে পারবেন। শরীরও সুস্থ থাকবে।
সাময়িক সমাধান
মনখারাপ বা বিরক্তি চেপে বসলে, যেখানেই থাকুন না কেন, শিরদাঁড়া সোজা রেখে গভীর ভাবে প্রশ্বাস গ্রহণ করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন। অন্তত ১০-২০ বার এমন করলেই দেখবেন মনের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছেন। বাড়ির ছোটদেরও শিখিয়ে দিন এই পদ্ধতি। নিজের মনই হোক কিংবা বাড়ির ছোটদের— জোর করবেন না, অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করবেন না। উৎসবের রেশ মিলিয়ে গেলে মন আবার তার কাজকর্ম বুঝে নেবেই। অনন্ত ছুটি কিংবা অনন্ত উৎসবও খুব সুবিধেজনক অপশন নয়।
শোনা যায়, সম্রাট আকবর নাকি একবার বীরবলকে বলেছিলেন এমন কিছু লিখে দিতে, যা সুখের সময় দুঃখ আর দুঃখের সময়ে সুখ দেয়। বীরবল তৎক্ষণাৎ মুচকি হেসে একটি কাগজে লিখে দিয়েছিলেন—‘এ রকম দিন থাকবে না।’ আবার কেটে যাবে বছর। সারা বছরেই থাকবে টুকরো টুকরো আনন্দ, ছুটি, উৎসব-অনুষ্ঠানের ঝলমলানি। সে সব পেরিয়ে ফের আসবে দুর্গাপুজো-কালীপুজোও। তত দিন পর্যন্ত সময় কাটাতে হবে তো! কাজে ফিরুন, ছোটদেরও পড়াশোনায় ফেরান ধীরে-ধীরে। সময় দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy