কারপাল টানেল সিনড্রোম! নামটা রাশভারী হলেও রোগটি কিন্তু বিরল নয়। যুবক-বয়স্ক, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিশ্বজুড়ে বহু মানুষ এই সিনড্রোমে জর্জরিত। দীর্ঘ সময় ধরে হাতের কাজ করলে, যেমন, কম্পিউটারের মাউজ় চালনা, একটানা মোবাইল হাতে ধরে কথা বলা অথবা খুন্তি নেড়ে রান্না করার পরই কব্জি থেকে ঝিনঝিন করে অসহনীয় যন্ত্রণা প্রসারিত হয় বুড়ো আঙুল, তর্জনী, মধ্যমা পর্যন্ত। কখনও কখনও আঙুল এতটাই অবশ হয়ে যায় যে, মুঠো করে কিছু ধরার শক্তিটুকু পর্যন্ত থাকে না। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। কারপাল টানেল সিনড্রোম নার্ভের বা স্নায়ুর অসুখ। রোগটি থেকে চটপট সেরে ওঠা যায়, যদি সমস্যার সূত্রপাত হতেই চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যায়। কিন্তু অনেকেই যন্ত্রণা সহ্য করে, ঘরোয়া টোটকা অবলম্বন করে ফেলে রেখে হাত প্রায় অকেজো করে তোলেন, তখন চিকিৎসা পদ্ধতি যেমন জটিল হয়ে ওঠে তেমন আরোগ্য পেতেও সময় লাগে।
কেন হয় কারপাল টানেল সিনড্রোম
হাতের কব্জির কাছে সরু ক্যানাল বা টিউব থাকে যাকে কারপাল টানেল বলে। এই টানেলের মধ্য দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ পাস করে। এটা বুড়ো আঙুল, তর্জনী, মধ্যমা ও আংশিক অনামিকাকে নিয়ন্ত্রণ করে। ‘‘কারপাল টানেল অর্থাৎ কব্জির ভিতরে হাড়ের সুড়ঙ্গ দিয়ে মিডিয়ান নার্ভ অতিক্রম করে। হাড়ের পরিখা থাকায় কব্জির নড়াচড়ায় নার্ভ ঘষা খায় না। এক কথায় এই টানেলের মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য মিডিয়ান সুরক্ষিত থাকে। কোনও কারণে যদি ক্রমাগত এই টানেলের উপর চাপ পড়ে বা কোনও কারণে টানেল ছোট হয়ে নার্ভকে চেপে ধরে, তা হলে এই ধরনের যন্ত্রণা শুরু হয়। একে কারপাল টানেল সিনড্রোম বলে। তবে সব সময়ে যে টানেলে চাপ পড়বে বা টানেলের দেওয়াল সরু হয়ে আসবে তা নয়, বিভিন্ন অসুখের জন্য মিডিয়ান নার্ভ মোটা হয়ে যেতে পারে, কারপাল টানেল যে টিসুগুলো দিয়ে তৈরি সেগুলোও মোটা হয়ে গিয়ে এই বিপত্তি ঘটাতে পারে। মোদ্দা কথা, মিডিয়ান নার্ভ যে কোনও কারণেই হোক না কেন ক্ষতিগ্রস্ত হলে এই সমস্যার সূত্রপাত হয়,’’ বললেন স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়ন্ত রায়। গর্ভাবস্থায়, হাইপোথাইরয়েড, ডায়াবিটিস, ওবেসিটি, আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, কব্জিতে চাপ পড়ে দীর্ঘ সময় ধরে এমন কাজ করা ইত্যাদি কারপাল টানেল সিনড্রোমকে ত্বরাণ্বিত করে। গর্ভবতী মহিলারা এই সমস্যায় পড়েন বেশি। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের শরীরে অতিরিক্ত ফ্লুয়িড হওয়ায় শরীর ফুলে যায়। এতে অনেক সময়ে কারপাল টানেলের ভিতর ফুলে গিয়ে মিডিয়ান নার্ভের উপরে চাপ বাড়তে থাকে। তবে শিশুর জন্মের পরে দ্রুত সেরেও ওঠেন তাঁরা। হাইপোথাইরয়েড থাকলে টিসুতে ফ্লুয়িড ডিপোজিশন হয়, ওবেসিটিতে সর্বত্র ফ্যাট বৃদ্ধি পায়। এর ফলে নার্ভের উপরে চাপ পড়ে। এ ছাড়া রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস বা যে কোনও বাতে এমনিতেই জয়েন্টের ব্যথা হয়, যা কারপাল টানেল সিনড্রোমকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
এই রোগের লক্ষণ
কম্পিউটারে কাজ, রান্না করা, ঘর মোছা, হাত দিয়ে মেশিন চালনা, ওজন তোলা ইত্যাদি হাতের কাজ কিছুক্ষণ করলেই কব্জি থেকে বুড়ো আঙুল, তর্জনী, মধ্যমা ও আংশিক অনামিকা পর্যন্ত ঝিনঝিন করে যন্ত্রণা হয়। কোনও কোনও সময়ে আঙুল অবশ হয়ে যায়। বিশেষ করে বুড়ো আঙুল। তখন কোনও জিনিস মুঠো করে ধরাই মুশকিল হয়ে পড়ে।
চিকিৎসা
‘‘বিশেষ করে যন্ত্রণা বাড়ে রাতে, ঘুমের মধ্যে। এতটাই ঝিনঝিন করে যে ঘুম ভেঙে যায়। তখন উঠে হাত ঝাড়লে একটু আরাম পাওয়া যায়। এই ধরনের লক্ষণ নিয়ে যখন কেউ আসেন তখন পরীক্ষা করে দেখতে হয় আদৌ সেটা কারপাল টানেল সিনড্রোম কি না। কারণ আরও কিছু অসুখের লক্ষণ এক। কারপাল টানেল সিনড্রোম হয়েছে নিশ্চিত হলে মিডিয়ান নার্ভ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা পরীক্ষা করে বুঝতে হয়। ক্ষতির সূচক মাইল্ড থেকে মডারেট হলে ওষুধ দেওয়া হয়। স্প্লিন্ট বা রিস্টব্রেস পরে কব্জিকে নিউট্রাল পজ়িশনে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতেই কাজ হয়। কিন্তু সিভিয়র হলে সার্জারি করতে হয়,’’ বললেন ডা. রায়। চিকিৎসা চলাকালীন কব্জি যতটা বিশ্রামে রাখা যাবে তত দ্রুত সেরে ওঠা যাবে। তার জন্য হাতের কাজে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। কব্জি ঝুলিয়ে না রেখে উঠিয়ে রাখলে (বরাভয় মুদ্রার মতো) বিশ্রাম পাবে। চিকিৎসক হাতে পরার যে ব্যান্ড দেবেন তা পরে থাকতে হবে, বিশেষত ঘুমনোর সময়ে। এতে কমপ্রেশন কম হয়, চাপ কম পড়ে, আরোগ্য দ্রুত হয়।
সতর্কতা
ইন্টারনেট ঘাঁটলেই কারপাল টানেল সিনড্রোম নিরাময়ে একাধিক এক্সারসাইজ় পাওয়া যাবে। অনেকেই চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে বা তাঁর পরামর্শ ছাড়াই ঘরে বসে সেই সব ব্যায়াম নিয়মিত করেন। এতে হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কা থাকেই। নার্ভের যে কোনও সমস্যায় চিকিৎসা যত দ্রুত শুরু করা যায় ততই ভাল। কারপাল টানেল সিনড্রোমের ক্ষেত্রেও তাই। সমস্যা ফেলে রাখলে শুধু মিডিয়ান নার্ভ নয়, আঙুলের পেশিগুলো বিশেষ করে বুড়ো আঙুল একেবারে অচল হয়ে যেতে পারে। তখন অপারেশন অপরিহার্য। তাই এ ধরনের লক্ষণ দেখা দিলেই হাতের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে শীঘ্রই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy