কোলেস্টেরল জমে রক্ত প্রবাহের পথে বাধা। শিল্পীর কল্পনায়। ছবি: আইস্টক
বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা বলছে, এক সময়ে এ দেশের বহু নাগরিক পেটের সমস্যায় ভুগতেন। কিন্তু এখন পেটের রোগ থেকেও হৃদরোগীর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। এর মধ্যে অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে, হৃদপেশির ধমনীতে বাধা তৈরির জন্য অনেকে হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আর এই বাধা তৈরির অন্যতম কারণ রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। বিজ্ঞানীরা বলছেন, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের জন্যই এই মাত্রা বৃদ্ধি।
সবার আগে জেনে নেওয়া দরকার ফ্যাট ও কোলেস্টেরল সম্পর্কে দু’একটি কথা। প্রোটিন বা শর্করার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যোপাদানের থেকে ফ্যাট বা স্নেহপদার্থ শরীরে অনেক বেশি শক্তি জোগাতে পারে। খাদ্যের অভাবে ফ্যাট বা স্নেহপদার্থ শরীরে শক্তির জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই ফ্যাটই আবার এ, ডি, ই, কে ভিটামিনের দ্রাবক হিসেবে কাজ করে। মানুষের দেহের বিভিন্ন অংশে জমা হয়ে সেগুলিকে আঘাতের হাত থেকে বাঁচায়। দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে, দেহকোষের কোষপর্দা তৈরিতে, অন্তঃ ও বহিঃকোষীয় সংবাদ প্রেরণে এবং সহ-উৎসেচক উপাদান হিসেবে ফ্যাট কাজ করে। এই ফ্যাটেরই একটি বিশেষ শ্রেণি হল কোলেস্টেরল। ভিটামিন ডি, পিত্ত, অম্ল, পিত্তলবণ, স্টেরয়েড ও যৌন হরমোন সংশ্লেষ এবং কোষপর্দার উপাদানরূপে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। তবে খাদ্যের উপাদান হিসেবে একে গ্রহণ করার কোনও প্রয়োজন নেই— এমনই বলে থাকেন অনেক চিকিৎসাবিদ। কারণ, মানব শরীরে প্রতিটি কোষ বিশেষ করে যকৃৎ (৭৫ শতাংশ), ত্বক, অ্যাড্রিনাল এবং অন্ত্রের কোষগুলি অন্য ফ্যাট থেকে যে পরিমাণ কোলেস্টেরল তৈরি করে তাই যথেষ্ট বলে মনে করা হয়।
ফ্যাটের জগতে কোলেস্টেরল তখনই ‘সমস্যা’ হিসেবে দেখা দেয়, যখন খাদ্যের মাধ্যমে কোলেস্টেরলের গ্রহণ মাত্রাতিরিক্ত হয়ে থাকে। আবার অধিক পরিমাণে শর্করা জাতীয় খাদ্যগ্রহণ করলেও সেটি শরীরে ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। দেহকোষগুলি তখন অধিক পরিমাণে কোলেস্টেরল তৈরি করে। কিছু পরিমাণ মল ও সিবামের সঙ্গে রেচিত হলেও, জারিত কোলেস্টেরলের একটা বড় অংশ ধমনীর প্রাচীরে জমা হয় রক্তের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এর ফলে হৃৎপিণ্ডের বাম-নিলয়ের প্রাচীর পুরু হয়ে রক্ত উৎক্ষেপণ ক্ষমতা হ্রাস পায়। হৃৎপিণ্ডের পেশিতে রক্ত বহনকারী সূক্ষ্ম ধমনীগুলিতে যখন কোলেস্টেরল ট্রাইগ্লিসারাইড ও অনুচক্রিকা জমা হয়ে পিণ্ডের সৃষ্টি হয়, তখন রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা তৈরি হয়। এ ছাড়া অ্যানজিনা, হার্ট ফেলিওর প্রভৃতি হৃৎপিণ্ড সংক্রান্ত মারণ রোগগুলি রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরলের কারণে ঘটে। চিকিৎসাবিদদের মতে, রক্তে কোলেস্টরলের স্বাভাবিক মাত্রা হল ২০০ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার এর কম।
পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে প্রতি এক লক্ষ লোকের মধ্যে ২৭২ জন মারা যান হৃদরোগে। রক্তে কোলেস্টেরল একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় থাকলে (বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই মাত্রাটি হতে হবে প্রতি ডেসিলিটারে ১৬০ মিলিগ্রামের কম) হৃদরোগ এড়ানো সম্ভব হয়। ‘ট্রান্স ফ্যাটি অ্যাসিড’ সমৃদ্ধ ‘ফাস্ট ফুড’, চিপস, কুকিজ, ধূমপান ও মদ্যপান প্রভৃতি রক্তে এইচডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ায়। চিকিৎসক ও গবেষকদের দাবি, রক্তে এইচডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমা এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ার ফলে কোলেস্টরলের স্বাভাবিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়। তাতেই বাড়ে অসুখের আশঙ্কা। এই কারণে অনেকেই এইচডিএল কোলেস্টরলকে ‘ভাল কোলেস্টেরল’ ও এলডিএল কোলেস্টেরলকে ‘ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল’ বলে অভিহিত করে থাকেন। সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড যুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে এই সমস্যা হয়ে থাকে বলে বিজ্ঞানীরা দাবি করেন।
চিকিৎসকদের দাবি, একক ও বহু অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড (মুফা ও পুফা) যুক্ত খাবার খেলে এই সমস্যাকে এড়ানো যায়। সম্পৃক্ত খাবারে তালিকায় রাখা হয় চর্বি জাতীয় মাংস, নারকেল, মাখন, ঘি, কাজু বাদাম, ডিমের কুসুম, পাম তেল প্রভৃতি। সাধারণত দেখা যায় হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তির অস্ত্রোপচারের পরে এই খাবারগুলি এড়িয়ে চলতে বলেন চিকিৎসকেরা। আগে থেকেই এগুলি এড়িয়ে চললে হৃদরোগের আশঙ্কাও অনেকটা কমতে পারে। বহু অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত খাবারের তালিকায় রয়েছে তুষের তেল, সর্ষের তেল, সূর্যমুখী তেল, মাছ, মাছের তেল এবং সয়াবিন। এই খাবারগুলি খেলে হৃদরোগের আশঙ্কা অনেকটাই কমে বলে দাবি চিকিৎসকদের। এ ছাড়াও অ্যান্টি অক্সিড্যান্ট ও ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার যেমন আনাজ, ফল কোলেস্টেরল বিপাকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইমিউন প্রতিক্রিয়া, প্রদাহ ও রক্ততঞ্চন নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং ‘ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’-এর একটি সমীক্ষা বলছে, খাদ্যে অত্যাবশ্যক ফ্যাটি অ্যাসিড লিনোলেনিক এবং লিনোলেইক এটি নির্দিষ্ট অনুপাতের ব্যবহার (৪:১ থেকে ১০:১) শরীরে কোলেস্টেরলের উৎপাদন কমিয়ে দেয়।
চিকিৎসকেরা মনে করেন, নিয়মিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঞ্চালন, শরীরচর্চা, যোগাসন, ব্যায়াম, জোরে হাঁটা প্রভৃতির মধ্যে দিয়েও কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে অনেকটা দূরে থাকা যায়। সুস্থ মন, সুস্থ শরীর পেতে হলে এক দিকে, যেমন আমাদের জীবনযাপনের ধরনে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে, তেমনই পরিবর্তন আনতে হবে খাদ্যাভ্যাসেও।
এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও। সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের YouTube Channel - এ।
আটাঘর তাজপুর হাই মাদ্রাসার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy