কিডনি থাকুক যত্নে।
প্রবাদে আছে, মানুষ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। কিডনি বা বৃক্কের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা প্রায় একই। দেখতে নেহাতই ছোট, কিন্তু তার কাজ শরীরের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই সময় থাকতেই কিডনির যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। সারাদিনের পরে শহর বা গ্রামের জমা হওয়া জঞ্জাল ঠিক মতো সাফ না হলে, মানুষের পক্ষে সেখানে বসবাস করাই দুষ্কর হয়ে পড়ে। তেমনটাই ঘটে শরীরের ক্ষেত্রেও। দূষিত বা রেচন পদার্থ যদি শরীর থেকে বেরিয়ে না যায়, তা হলে তা জমতে থাকে অভ্যন্তরেই। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শরীরের বাকি সমস্ত অঙ্গ। তাই শরীরকে সার্বিক ভাবে সুস্থ রাখার জন্য কিডনি ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা গুরুত্ব রয়েছে মস্তিষ্ক, হার্টের মতো অঙ্গগুলির।
কিডনির সমস্যা ও তার লক্ষণ
সাধারণত শরীরের অন্যান্য অঙ্গ খারাপ হলে তার লক্ষণ হয় প্রকট। কিন্তু কিডনির সমস্যা হলে আপাতদৃষ্টিতে কিছু বোঝা যায় না। শরীরে সামান্য অবসাদ হয়। ঘুম ঘুম ভাব, মনঃসংযোগের সমস্যা, খিদে নষ্ট, অল্প পা ফোলা, শরীরে রক্ত কমে যাওয়া... সবই দেখা যায়। কিন্তু সে সব পরিবর্তনই হয় খুব মৃদু। ফলে সহজে ধরা পড়ে না কিডনির অসুখ। আর যখন ধরা পড়ে, দেখা যায় অসুখটা গড়িয়ে গিয়েছে অনেক দূর। তাই কিডনির বৈকল্য বা খারাপ হওয়াকে ‘সাইলেন্ট কিলার’ বা ‘নিঃশব্দ ঘাতক’ বলা হয়।
সমস্যার সূত্রপাত
কারও উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সমস্যা থাকলে তার প্রভাব পড়ে কিডনিতেও। জন্মগত কিডনির সমস্যা, ছোটবেলায় নেফ্রাইটিস, পরিবারে কিডনির অসুখের ইতিহাস অথবা অন্য কোনও রোগের জন্য যদি দীর্ঘদিন ব্যথার ওষুধ খেতে হয়, তা হলেও কিডনির সমস্যা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তাই নিয়মিত চেকআপের সময়ে কিডনির পরীক্ষা করাও জরুরি।
কিডনির নানা রোগ
কিডনির সমস্যা মানেই তা আর ভাল হবে না, এ ধারণা ঠিক নয়। ক্রনিক ডিজ়িজ়, স্টোন, গ্লোমেরিউলোনফ্রাইটিস, পলিসিস্টিক ডিজ়িজ়, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন... কিডনির সমস্যা নানা ধরনের। কিছু ক্ষেত্রে ঠিক মতো চিকিৎসা, অস্ত্রোপচারে সেরে যায়। কখনও করতে হয় ডায়ালিসিস। এ ছাড়া অঙ্গ প্রতিস্থাপনও সমাধানের পথ। তবে সবটাই নির্ভর করে রোগীর অসুখের ধরনের উপরে।
প্রসঙ্গ ডায়ালিসিস
কিডনি শুধু শরীর থেকে রেচন পদার্থই বার করে না, তার ভূমিকা আরও বেশি। রক্তে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা, অ্যাসিডোসিস হয়ে রক্তে অ্যাসিডের মাত্রা অতিরিক্ত না বাড়া, হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখা... এ সবই করে কিডনি। কিডনির সমস্যায় প্রাথমিক ভাবে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা চলে। আর ডায়ালিসিস করা হয় সেই পর্যায়ে, যখন কিডনির অসুখ একেবারে অন্তিম দশায় এসে পৌঁছেছে। চিকিৎসার ভাষায় যা ‘এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজ়িজ়’। সাধারণত যখন রোগীর দু’টি কিডনি শতকরা ১০-১৫ ভাগ বা তারও কম কাজ করে, তখনই শুরু হয় ডায়ালিসিস। ডায়ালিসিস মানে কখনওই কিডনি সারানো নয়। এই প্রক্রিয়ায় কিডনি খারাপই থাকে। ডায়ালিসিস শুধুমাত্র কৃত্রিম ভাবে কিডনির কাজ করায়। তা-ও কিডনির সব কাজ ডায়ালিসিস করতে পারে না। কিছু কিছু কাজ করে রোগীকে সচল রাখার চেষ্টা করে।
ডায়ালিসিস ও জল: অনেকেরই ধারণা আছে যে, বেশি পরিমাণে জল খেলে কিডনি ভাল থাকে। এ প্রসঙ্গে নেফ্রোলজিস্ট অভিজিৎ তরফদার বলছেন, ‘‘ধারণাটি ভ্রান্ত। সব কিছুরই মাত্রা থাকা জরুরি। আপাতদৃষ্টিতে একজন সুস্থ মানুষ অতিরিক্ত জল খেলে তাঁর রক্তে সোডিয়ামের মাত্রা কমে যেতে পারে। যাকে বলা হয় হাইপোনেট্রিমিয়া। তাতে অনেক সময়ে মস্তিষ্ক বিকৃতির মতো গুরুতর লক্ষণও দেখা যেতে পারে। ডায়ালিসিস চললে জল কমিয়ে দেওয়া হবে বা জল মেপে খেতে হবে কি না, সেটাও নির্ভর করছে রোগীর শারীরিক অবস্থার উপরে।’’
যে সমস্ত মানুষের কিডনির সমস্যা হয়, তার মধ্যে শতকরা ৭০-৮০ ভাগ মানুষের শরীরে জল জমতে শুরু করে। জল ক্রমাগত জমতে থাকলে তা প্রথম দিকে পা, চোখের পাতা, পরে বুকের মধ্যে, ফুসফুস, তার চারপাশের থলি, হার্ট ইত্যাদিতে জমে। ফলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। শরীরে খুব বেশি জল জমে গেলে প্রাণসংশয়ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে ডায়ালিসিসের মাধ্যমে জল বার করে দেওয়া হয়।
দু’টি ডায়ালিসিসের সিটিংয়ের মাঝে ‘ইন্টার ডায়ালিটিক ওয়েট গেন’ হয়। ধরা যাক, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ডায়ালিসিস করার পরে রোগীর ওজন ৫০ কিলোগ্রাম। পরের বার যখন তিনি ডায়ালিসিস করতে আসছেন, দেখা গেল তাঁর ওজন বেড়ে হয়েছে ৫২ কিলোগ্রাম। অর্থাৎ দু’টি সিটিংয়ের মাঝে ওজন বেড়েছে দু’কেজি। এই মাঝের সময়টায় তিনি বাড়তি জল খেয়েছেন দু’লিটার। তখন দ্বিতীয় সিটিংয়ে বাড়তি জল বার করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি সতর্ক করা হয় রোগীকে। ডা. তরফদার বলছেন, ‘‘ইন্টার ডায়ালিটিক ওয়েট গেনের ক্ষেত্রে মাত্রাটা ছ’-সাত কিলো হলে অবশ্যই জল মেপে দেওয়া হয়। প্রাথমিক ভাবে জল পানের পরিমাণ কমানো হয়। এর পাশাপাশি আবার বাড়িয়ে দেওয়া হয় সিটিংয়ের সংখ্যা। দু’টি ডায়ালিসিসের মাঝের বিরতি বাড়ালে এবং জল জমতে থাকলে রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ফ্রিকোয়েন্সি বাড়ানোর দরকার হয়।’’ তবে কার কত বার ডায়ালিসিস হবে, সেটা একান্তই নির্ভর করে রোগীর শারীরিক অবস্থার উপরে। এমন রোগীও আছেন, যাঁদের প্রত্যেক দিন ডায়ালিসিসের প্রয়োজন হয়। তবে চিকিৎসকেরা বলেন, কমফর্টেবল ডায়ালিসিস ফ্রিকোয়েন্সি হল সপ্তাহে তিনটি করে।
ডায়ালিসিস মানেই কি আয়ু কমে আসছে?
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সাধারণত কোনও নির্দিষ্ট রুল-বুক নেই। কোনও মানুষ ডায়ালিসিস করেও ১৪-১৫ বছর বা তার বেশি সুস্থ থাকতে পারেন। কারও ক্ষেত্রে সময়সীমা তত দিন নয়। তবে কমফর্টেবল ডায়ালিসিসে গড়ে সাড়ে তিন বছর থেকে পাঁচ বছর ভাল থাকেন রোগী।
কিডনি প্রতিস্থাপন
ডায়ালিসিস যেহেতু কখনওই আল্টিমেট ট্রিটমেন্ট নয়, তাই সমাধানের পথ হতে পারে ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা কিডনি প্রতিস্থাপন। সে ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী সরাসরি রক্তের সম্পর্ক, অর্থাৎ মা-বাবা-ভাই-বোন-ছেলে-মেয়ে-স্বামী-স্ত্রী কিডনি দিতে পারেন রোগীকে। এটিই সুরক্ষিত এবং আইনসম্মত পথ। ‘‘একটি মাত্র কিডনি থাকলেও কেউ সম্পূর্ণ সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন। মানুষের শরীরে দু’টি কিডনির একটিই যথেষ্ট। অন্যটি ডোনেট করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে জরুরি অর্গ্যান ডোনেশনের প্রতি মানুষের সচেতনতা বাড়ানো,’’ বলছেন ডা. তরফদার।
ভাল থাকুক কিডনি
তা হলে কী ভাবে যত্ন নেবেন কিডনির? ইউরোলজিস্ট ডা. কল্যাণ সরকার বলছেন, ‘‘নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, রাস্তার খাবার না খাওয়া, অতিরিক্ত তেল-ফাস্ট ফুড বর্জন, নিয়মিত শারীরচর্চা করলে গোটা শরীরই ভাল থাকে। তার সঙ্গে সুস্থ থাকে কিডনিও।’’ এ ছাড়া যখনই হাই-প্রেশার, ডায়াবিটিসের মতো সমস্যা ধরা পড়ে, সেই সব রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি একেবারে প্রথম পর্যায় থেকেই জরুরি কিডনিরও দেখভাল।
কিডনি বিকল হতে সময় লাগে। তাই ফেলে না রেখে, অবহেলা না করে বার্ষিক পরীক্ষা করানো জরুরি। আর তার সঙ্গী হোক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy