Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Coronavirus

উটের হাঁচিতে করোনা বিপদ

বারবার দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। নানা রূপে। নানা স্থান থেকে ছড়িয়ে পড়ে। আর সেই রূপ বদলের বাহক হয়েছে এমন সব প্রাণি যেগুলোর সঙ্গে মানুষের সরাসরি যোগ রয়েছে। বিভিন্ন রূপের করোনাভাইরাস স্বরূপ চেনালেন সুমন প্রতিহার

সতর্কতা: হলদিয়া বন্দরে চলছে পরীক্ষা। ছবি: বন্দর কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে

সতর্কতা: হলদিয়া বন্দরে চলছে পরীক্ষা। ছবি: বন্দর কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে

সুমন প্রতিহার
শেষ আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:১৪
Share: Save:

বিশ্বনাথ দত্ত বালক নরেনকে শেখাচ্ছেন কখনও অবাক হবে না। বিবেকানন্দের বাবা কি ভাইরাসের রকমসকম জানতেন? তাহলে বোধহয় একটু থমকেই যেতেন। ভাইরাস যে আমাদের অবাক হতে শেখায়। চিনের বাসিন্দাদের ডিনারে সয়া সস, আদা রসুন ও অল্প চিনি সহকারে ঝলসানো সিভেট পরিবেশন করা হয়। সিভেট হল আমাদের পরিচিত নিশাচর গন্ধগোকুল। গন্ধগোকুল থেকে মিষ্টি ফলের গন্ধ পান চিনের বাসিন্দারা। তা সে যতই মিষ্টি হোক আমেরিকায় নিষিদ্ধ এই প্রাণী। কারণ এরা সার্স ছড়াতে সক্ষম। সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম।

২০০২ সালের শীতকাল গন্ধগোকুলের দাপটে তপ্ত ছিল পৃথিবী। ২৯টি দেশে ১৮ হাজার সংক্রমণ। ৭৫০টি জীবন নিয়ে থেমেছিল এই সার্স। এরাও একপ্রকার করোনাভাইরাস। বিজ্ঞানীদের মতে, সার্সের সংক্রমণ থেকে দেহে রোগ প্রকাশ পেতে সময় লাগত সাতদিন। কিন্তু এবারে চিনের নতুন করোনাভাইরাসের সময় লাগে প্রায় ১৪ দিন। সংক্রমণ পদ্ধতি, মৃত্যুহার নিয়ে অঙ্ক কষে দেখা যাচ্ছে নতুন বছরের করোনাভাইরাস আগের সার্স ভাইরাসের তুলনায় নিতান্তই নিরীহ।

বিবর্তনের ইতিহাসে যে স্তন্যপায়ী প্রাণী ডানা মেলে আজও উড়ে চলেছে অন্তত পাঁচবার তারা ঘাতক ভাইরাসকে আশ্রয় দিয়েছে। ইবোলা, নিপা, সার্স, মার্স, ২০১৯ সালের নতুন করোনা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাদুড় ‘ভাইরাস ভল্ট’ হিসেবে কাজ করেছে। একের বেশি ঘাতক ভাইরাস বহন করলেও কোনওটাতেই আক্রান্ত হয় না বাদুড়। দিনের বেলায় দেহ শীতল অথচ রাতে জ্বর এটাই কি বাদুরের রক্ষাকবচ? আধুনিক গবেষণা বলছে, বাদুরের রক্তে ইন্টারফেরন-১ এর সন্তোষজনক উপস্থিতি ও ‘ন্যাচারাল কিলার’ কোষের সন্তর্পণে চলাফেরা ভাইরাসকে বাদুড়ের দেহে নিয়ন্ত্রিত ভাবে বাড়তে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে বিবর্তনের কিছুটা আশীর্বাদ বাদুড় পেয়েছে। বাদুড়ের লালা, মল (গুয়ানো) এমনকি মূত্র থেকে রক্তবীজের মতো ছড়িয়েছে ভয়ঙ্কর সব ভাইরাস।

তাহলে উপায়? ২০২০ সালে এসে প্রতিষেধক প্রস্তুতির কাজ শেষ পর্যায়ে। তা বলে ১৮ বছর! সময় লাগে। ভাইরাসের মতিগতি বুঝতেই বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসে। তার পর তো প্রতিষেধক। প্রগতির গাড়িতে চেপে সেই প্রতিষেধক বিজ্ঞানের ‘সাডেন ব্রেক’ সামলে মানুষের উপর প্রয়োগ করতে আরও অনেকটা সময়। এই করোনাভাইরাস বেশিরভাগ সময়ে প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে সেই জন্য সম্ভাব্য প্রতিষেধক নাকে প্রয়োগের কথা বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন।

সার্সের আরও দশটা বছর পর। ২০১২। চিন থেকে প্রায় ছ’হাজার কিলোমিটার দূরে জর্ডনে শুরু হল সারি দিয়ে সর্দি, কাশি, গলা ব্যথার উপসর্গ। এবার কিন্তু সার্স নয়। ভাইরাসেরা নিজেদের বদলে নিয়েছে। এবারের রূপ মাস। পোশাকি নাম মিডল ইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম। উটের হাঁচিতে ছড়িয়ে আরব দেশগুলিতে পড়তে শুরু করল এই নতুন করোনাভাইরাস। শিশু থেকে বৃদ্ধ প্রায় সকলকেই আক্রান্ত করতে শুরু করল মার্স। সার্স-এর ক্ষেত্রে বয়স্করা বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন। উৎস খুঁজতে এবার হন্যে হতে হল না। সূত্রধর বাদুড়। পরিকল্পনার জন্য ভাইরাসের কিছুদিন উটের দেহে অবস্থান। তার পরই প্রাণঘাতী হামলা। প্রশ্ন, উটে ভাইরাস এল কী করে? হতে পারে উটের দুধ পান করে। বা সেই জলাশয় যেখানে উট ও মানুষ দুজনাই যায়। দীর্ঘকায় এই সোমালীয় উটে করোনার প্রবেশ রহস্যজনক। তাহলে কি উটকেও সর্দির হাত থেকে বাঁচাতে মালিককে যত্নবান হতে হবে? অতটা না হলেও বিশেষ যত্ন নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে উটের বাচ্চা হওয়া থেকে শুরুর কয়েকটা দিন। ২০২০ জানুয়ারি মাস পর্যন্ত কোনও উপযুক্ত প্রতিষেধক খুঁজে পাওয়া গেল না এই মার্স করোনাভাইরাসের। পরিসংখ্যান বলছে মার্সে প্রভাবে প্রতি ১০০ জনে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

২০১৪, আফ্রিকা। আবারও বাদুড়, এবারে নাম ইবোলা। দেশের নাম কঙ্গো। সে দেশের একটি নদীর নাম ইবোলা। নদীর নাম দিয়েই পোশাকি নামকরণ। এই ভাইরাসের আক্রান্তদের প্রধান উপসর্গ রক্তক্ষরণ-সহ জ্বর। ১৯৭৬ সালে আবিষ্কৃত এই ভাইরাসের একটিমাত্র উৎপত্তিস্থল ভাবা গিয়েছিল কঙ্গো। তার পর জানা গেল, কঙ্গো থেকে সাড়ে ৮০০ কিলোমিটার দূরে সুদানে পাওয়া যাওয়া নতুন আরেকটি ইবোলা ভাইরাস। কী করে এল? তা খুঁজতে গিয়ে আমরা হন্য হয়ে একে একে গরিলা, শিম্পাঞ্জি প্রায় সকলকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছি। বাদুড় তো অবশ্যই তার পর। হয়তো বা শজারুর মাংস।

২০১৮ সাল, কেরল, ভারত। ১৮ জনের মৃত্যু। আবারও বাদুড়ের ডানায় ভর করে ভাইরাস এল। এবার নাম নিপা। গলা ব্যথা, বমি দিয়ে শুরু হয়ে অসংলগ্ন প্রলাপ এবং মস্তিষ্কের সংক্রমণজনিত স্নায়বিক লক্ষণ দেখা যেতে শুরু করল। শীতকালে খেজুর গাছে ঝুলছে হাঁড়ি, সেই হাঁড়ি থেকে এল নিপা। কিছু বাদুড়ও যে খেজুরের রস ও গন্ধ পছন্দ করে।। মালয়েশিয়ায় আবার শুয়োর থেকে ছড়িয়েছিল এই ভাইরাস। জায়গার নাম, সাংগাই নিপা। সেই স্থানের নাম অনুসারেই এদের পোশাকি নাম নিপা ভাইরাস।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করল, চিনের উহান প্রদেশের যে ফ্লু তার কোনও তথ্য বিজ্ঞানের কাছে নেই। শুধু জানা যাচ্ছে, এটি হল করোনাভাইরাস। সার্স, মার্স আর ইনফ্লুয়েঞ্জার মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু নতুন। সাময়িক নামকরণ ২০১৯ নোভেল করোনাভাইরাস। বাদুড়ের স‍্যুপ না রোস্টেট সাপ কী করে এল এই নতুন করোনা? তা নিয়ে জনতা উত্তাল হতেই পারে। বিজ্ঞানীরা চাইছেন একটা হ্যাঁচকা। যা দিয়ে টেনে থামানো যাবে ভাইরাসের সংক্রমণ। প্রতিষেধক যদি তৈরি করাও যায় মানুষের দেহে প্রয়োগ করতে এখনও অন্তত তিন মাস অপেক্ষা করতে হবে। রোগ ছড়ানোর শুরু থেকে এক মাসের মাথায় পৃথিবীতে ১২ হাজারেরও বেশি আক্রান্ত। তার মধ্যে আবার ১৬ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এখনও পর্যন্ত মৃত্যু আড়াইশো। নোভেল এই করোনাভাইরাস শ্বাসতন্ত্র ও পরিপাক তন্ত্রকে আক্রমণ করে। সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অন্তত কুড়ি সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। সাবানের পরিবর্ত হিসেবে অ্যালকোহল চলতে পারে। আর আক্রান্তের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করা যাবে না। সরাসরি সংযোগ হল, ছ’ফুট বা দু’মিটার দূরত্ব অথবা আক্রান্তের সঙ্গে একই ঘরে থাকা। করোনায় বিভ্রান্ত চিনের উনান প্রদেশের এইচফাইভএনওয়ান ফ্লু-এর বাড়বাড়ন্তে ৪৫০০টি মুরগির মৃত্যু বিজ্ঞানীদের নতুন করে অস্থির করছে।

খেজুরের রস না-ই বা খেলাম। গন্ধগোকুল, সাপ সেদ্ধ নৈব নৈব চ। উটের আর পরের হাঁচি থেকে বাঁচি।

লেখক প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Infection
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy