প্রতীকী ছবি।
কার্যত লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। তাতেই কি কমবে করোনার সংক্রমণ? ভোটের জন্য কি করোনা বেড়েছে? একান্ত সাক্ষাৎকারে আনন্দবাজার ডিজিটালকে তাঁর মতামত জানালেন আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিমারি বিশারদ ভ্রমর মুখোপাধ্যায়।
গোটা দেশের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিস্থিতি এখন কেমন?
নির্বাচনের ঠিক পরে পরে পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ ছড়ানোর গতি যে অনেকটাই বেড়েছিল, তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এখন খুব সামান্য হলেও সেটা কমতে দেখা যাচ্ছে। হাতে আসা সংখ্যায় যদি বিশ্বাস করি, তবে আমাদের লেখচিত্র বলছে, গত কয়েক দিনে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা গিয়েছে। আংশিক লকডাউনও হয়েছে। নির্বাচনের পর মানুষের বাইরে বেরোনো কিছুটা কমেছে। এ সবই করোনা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করছে।
সংক্রমণ কি খুব দ্রুত ছড়াচ্ছে?
পশ্চিমবঙ্গে ‘টেস্ট পজিটিভ রেট’ ৩০ শতাংশেরও বেশি। অর্থাৎ, পরীক্ষা যতগুলো হয়েছে, তার মধ্যে ৩০ শতাংশ মানুষের করোনা পজিটিভ এসেছে। যা অবশ্যই চিন্তার। তার সঙ্গে আরও একটা চিন্তার বিষয় করোনা পরীক্ষার হার। ৯ কোটি মানুষের রাজ্যে ৬৩ হাজার পরীক্ষা হওয়া একেবারেই ঠিক নয়। আর সেই ৬৩ হাজারের মধ্যে যদি ২০ হাজার জন করোনা পজিটিভ হন, তবে তো চিন্তা করতেই হবে। এই সংখ্যা অত্যন্ত বেশি। ফলে পরীক্ষা যাতে আরও করা যায়, সেটা দেখতে হবে।
গোটা দেশের অবস্থাই কি এক?
সারা ভারতের ‘টেস্ট পজিটিভ রেট’ এখন নেমে এসেছে ১৮ শতাংশে। পশ্চিমবঙ্গকেও তা দ্রুত নামিয়ে আনতে হবে।
পরিস্থিতি সামলাতে কী করতে পারে রাজ্য সরকার?
কয়েক দিন আগেই আমাদের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন সরকারের প্রতিনিধিরা। তাঁরা যা পরিকল্পনা করেছেন, তা বিজ্ঞানসম্মত বলা যায় কি না, সে আলোচনাও হল। আপাতত পরিস্থিতি যেমন, তাতে লকডাউন জরুরি। কয়েকটা দিন এ ভাবে চালাতে পারলে পরিস্থিতি একটু সামলানো যাবে। চিন, কোরিয়া, হংকংয়ের মতো দেশও শৃঙ্খলাবদ্ধ দূরত্ব বজায় রেখেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছে।
লকডাইনই কি একমাত্র ভরসা?
এ ভাবে তো মাসের পর মাস চলতে পারে না। টিকাকরণের কাজ যতটা এগনো যাবে, ততই সুবিধা। খুব দ্রুত রাজ্যের অন্তত ৫০ শতাংশ মানুষকে প্রতিষেধক দেওয়া গেলে অনেকটা কমানো যেতে পারে সংক্রমণের গতি। যেমনটা ব্রিটেন করল। টানা লকডাউন করে ধীরে ধীরে প্রতিষেধক দেওয়ার কাজ সারা হল। পশ্চিমবঙ্গে এখনও টিকাকরণ অনেকটাই বাকি। যথেষ্ট প্রতিষেধক নেই। ফলে আপাতত লকডাউনের নিয়ম মেনে চলতেই হবে।
পশ্চিমবঙ্গে টিকাকরণের হার কি বাকি দেশের তুলনায় খুব কম?
পশ্চিমবঙ্গে মোট ৩. ৬ শতাংশ মানুষের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হয়েছে। তা দেশের বহু রাজ্যের তুলনায় বেশি। কারণ, গোটা দেশে এই অঙ্কটি ৩ শতাংশ। তবে প্রথম ডোজ পেয়েছেন মাত্র ৯.৬ শতাংশ মানুষ। তা আবার বাকি দেশের তুলনায় কম।
মৃত্যুর হার কমানোর জন্য কিছু করণীয় আছে কি?
পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থা আর একটু ভাল করা যেতে পারে। যা দেখা যাচ্ছে, অসুখটা খুব কঠিন কিছু নয়। হাসপাতালে শয্যা পাওয়া গেলে, রোগীকে প্রয়োজনে অক্সিজেন দেওয়া গেলে বেশির ভাগই সুস্থ হয়ে উঠছেন। কেরলে যেমন সংক্রমণের সংখ্যা বেশি। কিন্তু মৃত্যুর হার কম। তার একমাত্র কারণ হল, চিকিৎসা পরিকাঠামো। সংক্রমিতকে যত্নের সঙ্গে নিভৃতবাসে রাখার ব্যবস্থা করা জরুরি। তবে তার সঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ হল সংক্রমণের হার কমানো। প্রথম ঢেউয়ে গোটা দেশে ৮-৯ মাসে যত জন সংক্রমিত হয়েছিলেন, দ্বিতীয় ঢেউ তিন মাসেই প্রায় সেই সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলেছে। এটা হতে দেওয়া যাবে না। খেয়াল রাখা জরুরি, পরিকাঠামো রাতারাতি উন্নত হবে না। আমেরিকায় যেখানে প্রতি হাজার জনের জন্য হাসপাতালের তিনটি শয্যা রয়েছে, ভারতে সেখানে সংখ্যাটা ০.৫।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণ মানুষের সতর্কতা কতটা জরুরি?
সমান জরুরি। প্রথম ঢেউয়ের দাপট সামলে লকডাউনের পরে যখন সকলে কাজ করতে বেরোলেন, তখন তো বেশি সাবধান হওয়া দরকার ছিল! কিন্তু তা কেউই হননি। এটা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশেই এক চিত্র। এ দফায় যখন থেকে মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়ের মতো রাজ্যে সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করল, তখনও কেউ সতর্ক হলেন না। নির্বাচনী প্রচারে গেলেন, বিয়েবাড়ি গেলেন, রেস্তরাঁয় খেতে গেলেন। প্রশাসনও সে দিকে সে ভাবে নজর দেয়নি। পরিস্থিতি বুঝে নির্বাচন কি ছ’মাসের জন্য পিছিয়ে দেওয়া যেত না? নির্বাচনের সময় যে সংক্রমণ বেড়েছে, তা স্পষ্ট। একটা ভাইরাস এসে আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে এখন আর করোনাকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। ফলে জীবনযাপনও বদলাতে হবে।
কীরকম বদল?
রাস্তায় দু’টো মাস্ক পরে বেরোনো কঠিন কাজ নয়। এটা করতে হবে। একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের মধ্যে অজানা মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো যাবে না। ভারতের মতো দেশে খোলা হওয়ায় সময় কাটানো, মিটিং করা সম্ভব। সেটা করতে পারলে করোনা যে কম ছড়াচ্ছে, তা প্রমাণিত। বড় অংশের মানুষের টিকাকরণ যতদিন না হচ্ছে, ততদিন বেশি লোকের জমায়েত একেবারেই মেনে নেওয়া যাবে না। গায়ের জোর দেখিয়ে যে লাভ নেই, দ্বিতীয় ঢেউ তা বুঝিয়ে দিয়েছে।
আপনি আগে বলেছেন, ভারতে করোনা সংক্রমণের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে, বাস্তবে তা অনেক বেশি। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও তাই?
আমরা স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে প্রকাশিত পরিসংখ্যানের উপরে ভিত্তি করে কাজ করি। ভারতের মতো জনবহুল দেশে দৈনিক পরিসংখ্যান পুরোটা ঠিক হওয়া কঠিন। এখনও করোনা পরীক্ষা হচ্ছে খুবই কম। ফলে যার ভিত্তিতে মত প্রকাশ করছি, সংক্রমিতের সংখ্যা তার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি, এটা ধরে নেওয়াই যায়। মৃতের সংখ্যাও দুই থেকে পাঁচ গুণ বেশি।
তা হলে পশ্চিমবঙ্গে যা পরিস্থিতি জানতে পারছি, বাস্তব তার চেয়েও ভয়াবহ?
শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, গোটা দেশেই। অনেক মানুষ রয়েছেন যাঁদের কোনও উপসর্গ নেই বা খুবই হাল্কা জ্বর-কাশি। তাঁরা হাসপাতালেও ভর্তি হচ্ছেন না, পরীক্ষাও করাচ্ছেন না। ফলে সরকারি গণনার মধ্যে থাকছেন না।
ঠিক পরিসংখ্যান বোঝা যাবে কী করে?
যে সংখ্যা হাতে আসছে, তার সবটা ঠিক না হলেও একটা ধারা বোঝা যায়। যে কারণে আমরা ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম থেকে বলছিলাম, আবার একটা বড় ঢেউ আসতে চলেছে। এবং তা সত্যিও হল। এপ্রিল মাসে পশ্চিমবঙ্গের যা সংখ্যা কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছিল, তা হয়তো বাস্তবের তুলনায় কিছুই নয়। কিন্তু সে সময়ের অঙ্কও দেখিয়েছে যে সংক্রমণ বৃদ্ধির হার বেড়ে গিয়েছে অনেকটা। এখন তা অল্প অল্প করে নামছে। এপ্রিলের ৫ তারিখের আশপাশে সেই হার বেড়ে হয়েছিল ২.৩। এখন তা নেমে ১.১ বা ১.২ হয়েছে।
তা হলেএখন লকডাউন কেন?
সংক্রমণ কমতে শুরু করেনি। সংক্রমণ বৃদ্ধির গতি কমতে শুরু করেছে। বৃদ্ধির হার ১-এর নীচে নামলে আশা রাখা যায় সংক্রমণ ছড়ানো কমতে শুরু করবে। আপাতত এটুকু বলতে পারি, এপ্রিল মাসের তুলনায় সংক্রমণ ছড়ানোর গতি সামান্য নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy