প্রতি বছরের মতো এ বার শীতেও মধ্য কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে বসেছে শীতবস্ত্র কেনাকাটির মস্ত এক বাজার। ছবি: সংগৃহীত
ডিসেম্বরে ঠান্ডা তেমন না পড়লেও শহর জুড়ে শীতের আমেজ। সকালের মিঠেকড়া রোদ, হিমেল হাওয়া, প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদে রোদে দেওয়া লেপ-কম্বল, খসখসে ত্বক জানান দিচ্ছে শীত এসে গিয়েছে। তবে এ বছর উত্তুরে হাওয়ায় তেমন কোনও ধার নেই। গায়ে কাঁটার মতো বিঁধছে না। তবে জাঁকিয়ে শীত পড়ার তোয়াক্কা না করেই বাহারি সব শীতের পোশাক নিয়ে শহরে হাজির নেপাল-ভুটান, হিমাচল প্রদেশের শীতবস্ত্র ব্যবসায়ীরা।
প্রতি বছরের মতো এ বার শীতেও মধ্য কলকাতার ওয়েলিংটন স্কোয়্যারে বসেছে শীতবস্ত্র কেনাকাটার মস্ত এক বাজার। মাঝের দু’বছর অতিমারির কারণে ভিন্ রাজ্য থেকে কোনও ব্যবসায়ী এ শহরে আসতে পারেননি। ফলে ছেদ পড়েছিল। পরিস্থিতি তুলনায় স্বাভাবিক হওয়ায় নভেম্বরের শুরুতে তিন মাসের জন্য পরিযায়ী পাখির মতো এ শহরে আস্তানা গেঁড়েছেন তাঁরা। কলকাতার মানুষও শীত পড়তেই মুখিয়ে থাকেন পশম সুতোয় বোনা বাহারি শাল, সোয়েটার, কার্ডিগান, স্টোল, মাফলার, পঞ্চুর মতো শীতপোশাকের একরাশ সম্ভারের জন্য।
চলতি সপ্তাহের এক দুপুরে ভুটিয়া বাজারে গিয়ে অবশ্য দেখা গেল অন্য এক চিত্র। কার্যত মাছি তাড়াচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বছর কয়েক আগেও ভুটিয়া বাজারে গেলে ভিড়ের চাপে পা ফেলা যেত না। হইহট্টগোল, ধাক্কাধাক্কিতে একটা শীতকালীন উৎসবের আবহ তৈরি হত। ডিসেম্বরের শুরুতে শীতের পারদ কিছুটা হলেও নেমেছে। তবুও দোকানগুলিতে ভিড় নেই ক্রেতাদের। শীতের খামখেয়ালিপনাই কি এর কারণ? অন্য রাজ্যের ব্যবসায়ীদের দাবি, কলকাতায় শীতের মেয়াদ ক্রমশ কমে আসছে। বছর কয়েক আগেও নভেম্বর থেকে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত ভাল কেনাবেচা হওয়ায় ব্যবসা জমে উঠত। এখন ডিসেম্বর মাস চলে এলেও বেচাকেনায় বেশ ভাটা। সারা দিনে ক্রেতার সংখ্যাও হাতে গোনা। তার মধ্যে আবার কেউ কেউ শীতপোশাক হাতে নিয়ে, দেখেশুনে দরদাম করেই চলে যাচ্ছেন। মুখে অনাবিল হাসি থাকলেও চিন্তার ভাঁজ ব্যবসায়ীদের কপালে।
দীর্ঘ দিন ধরে ভুটান থেকে এসে ওয়েলিংটনে দোকান দিচ্ছেন দোলমা শিরিন। দোলমার কথায়, ‘‘নভেম্বরের শুরুতে কলকাতায় এসেছি। এক মাস হয়ে গেল। অথচ তেমন কিছু বিক্রি করে উঠতে পারিনি। দোকানে ঠাসা মাল রয়েছে। ক্রেতা আসছে না, তা বলব না। কিন্তু দেখাশোনাই সার। আর একটু শীত পড়লে কিনব বলে আশা দেখিয়ে চলে যাচ্ছেন বেশির ভাগ।’’
দার্জিলিং থেকে এসেছেন চমন তামাং। তেইশ-চব্বিশের বেশি হবে না বয়স। ছোট্ট দোকান। পঞ্চু, বাহারি স্টোল, উলের জ্যাকেট সবই রয়েছে। শুধু ক্রেতার ভিড় নেই। তাই মোবাইলে শাহরুখ খানের ফিল্ম দেখছিলেন। তাঁর কাছেই জানা গেল, খুব বেশি মোটা শীতপোশাক কিনতে চাইছেন না বেশির ভাগ ক্রেতাই। সকলেই হালকা, কিন্তু শৌখিন পোশাকের খোঁজ করছেন। বিভিন্ন বয়সের মানুষের মধ্যে স্টোলের বেশ একটা চাহিদা রয়েছে। দোকানে এসে সেগুলিই দেখাতে বলছেন তাঁরা।
শীতের চরিত্র বদলেছে। কমছে স্থায়িত্ব। সেই সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে মানুষের পছন্দ-অপছন্দতেও। বদলেছে রুচি। অনলাইন কেনাকাটার যুগে মাফলার, সোয়েটার কিনতে দোকানে যাওয়ার ঝোঁক অনেকটাই কমেছে। পাঁচটা দোকান ঘুরে কেনাকাটি করার সময়ই বা কোথায়। সময় এবং শ্রম— দুই-ই বাঁচাতে অনলাইনই এখন ভরসা। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন ওয়েলিংটনের শীতবস্ত্র উষ্ণতা জুগিয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালিকে। নামীদামি সংস্থার শীতবস্ত্রের ভিড়ে কোথাও কি চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই উষ্ণতার আঁচ?
বিগত কয়েক বছর ধরে লাদাখ থেকে শীতের পোশাক বেচতে কলকাতায় আসছেন ইয়াসির ভট্ট। তাঁর কথায়, ‘‘মোজা কিংবা মাফলার, এখন আসলে সকলেই ব্র্যান্ডেড পরতেই ভালবাসেন। ভাল দামি পোশাক প্রচুর আছে আমার কাছে। কিন্তু সেগুলির চাহিদা নেই। সকলেই দোকানে এসে মাঝারি দামের পোশাকেরই খোঁজ করেন। একটা স্টোলের দাম ৭০০ টাকা শুনে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু গুণগত মান, সুতো দিয়ে করা স্টোলের কারুকাজ দেখছেন না। সেই সঙ্গে দরদাম তো আছেই। আমাদের প্রত্যেকটি দোকানে পোশাকের দাম বাঁধা। বেশি কিংবা কম কোনওটাই নিতে পারব না। জিনিসের মান বুঝেই দাম রাখা হয়েছে। খুব সস্তার জিনিস আমাদের কাছে পাবেন না। কারণ আমরা যে জিনিসটি দেব তা অনেক বছর পর্যন্ত ভাল ভাবে ব্যবহার করতে পারবেন।’’
ইয়াসিরের সঙ্গে গলা মেলালেন হিমাচল প্রদেশ থেকে আসা কিশোরী লাল গৌতমও। ব্যবসার সূত্রে দীর্ঘ দিন ধরে শহরে আসায় কলকাতার মানুষের পছন্দ সম্বন্ধে একটা সুস্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘কলকাতায় তো এখন আর হাড়কাঁপানো ঠান্ডা তেমন পড়ে না। ফলে হালকা উলের সোয়েটার, হাফ জ্যাকেটের মতো পোশাকই পছন্দ করেন অনেকে। তেমন পোশাকও আমাদের কাছে রয়েছে। তার জন্য তো আসতে হবে।’’
ধর্মতলা চত্বরে অনেক কম দামে ঢেলে বিক্রি হয় শীতের পোশাক। তা ছাড়া শপিং মলগুলিতে চলছে ‘উইন্টার সেল’। অনলাইন পোশাক বিপণিগুলিও এই সময় শীতের পোশাকের উপর বিপুল ছাড় দেয়। অন্য কোথাও সস্তায় পছন্দসই পোশাক পেয়ে গেলে আর কেন ওয়েলিংটন ভুটিয়াবাজারে ভিড় জমাবেন ক্রেতারা? এখানে তো কোনও ছাড়ের ব্যাপার নেই। সব দোকানে এক দাম।
নেপাল থেকে আসা এক মহিলা ব্যবসায়ী বলেন, ‘‘শীতের পোশাক সব সময় টেকসই হওয়া জরুরি। যাতে বহু দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। গলায় জড়ানো স্কার্ফ থেকে শুরু করে ছেলেদের মাফলার— আমরা সব সময় টেকসই জিনিসই বিক্রি করি। সস্তা মানেই যে মান ভাল হবে না, তেমন নয়। আমাদের কাছে কম দামেরও পোশাকও রয়েছে। সেগুলিও অনেক দিন পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারবেন। অন্য কোথায় শীতপোশাকের কী দাম, তা জানি না। আমরা মানুষকে সব সময় ভাল মানের জিনিস দেওয়ার চেষ্টা করি। দীর্ঘ দিন ধরে কলকাতায় আসার ফলে অনেক ক্রেতার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এমন অনেকেই আছেন যাঁরা আমার থেকে শীতের পোশাক কিনবেন বলে অপেক্ষা করে থাকেন। কবে আসছি, জানতে ফোনও করেন কেউ কেউ। পোশাকের মান ভাল বলেই নিশ্চয়ই আমাদের জন্য অপেক্ষা করেন।’’
অক্টোবরের শুরু থেকেই কলকাতায় আসার জন্য মন ছটফট করে কাশ্মীরি দম্পতি খরিমুল এবং খয়রুন্নিসার। বহু বছর ধরে একসঙ্গে শীতে কলকাতায় আসছেন তাঁরা। দু’জনেই অত্যন্ত বিনয়ী। স্পষ্ট না হলেও বাংলা ভাষা কিছুটা রপ্ত করেছেন। বিশেষ করে খয়রুন্নিসার মধ্যে বাংলা ভাষা শেখার একটা বাড়তি তাগিদ রয়েছে। কথায় কথায় টুকটাক দু’একটা বাংলা শব্দ বলার চেষ্টা করেন। হিন্দি সিনেমা, সিরিজ়ের দৌলতে বেশ ঝরঝরে হিন্দিতে কথা বলতে পারেন অনেকেই। তবে সবাই নয়। কেনাকাটা করতে এসে ভাষাগত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়েই। হিন্দিটা যাঁরা একেবারেই বলতে পারেন না, তাঁরা বাংলাতেই নিজেদের চাহিদার কথা জানাচ্ছেন। ঠিক করে বুঝতে না পারার জন্য সঠিক জিনিসটা বার করে দিতেও সমস্যা হচ্ছে দোকানদারের। এ প্রসঙ্গে খয়রুন্নিসা বলেন, ‘‘আমি বাংলা মোটামুটি বুঝতে পারি। কিন্তু বলতে তেমন পারি না। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে সমস্যা হয় না। কারণ তাঁরা অনেকেই ঝরঝরে হিন্দিতেই কথা বলেন। সমস্যা হয় যখন বয়স্ক বা বাড়ির মা-কাকিমাদের মতো কেউ আসেন। তবে আগে অনেক বেশি অসুবিধা হত। এখন ততটাও হয় না।’’
মেয়েকে পাশের স্কুলে দিতে এসেছিলেন যতীন দাস পার্কের বাসিন্দা মহুয়া বসু রায়। ফেরার পথে এক বার তাই ভুটিয়া বাজারে ঢুঁ মেরে গেলেন। কেনাকাটাও করলেন যৎসামান্য। কিনবেন বলেই এসেছিলেন, না কি দেখতে দেখতে হঠাৎ পছন্দ হয়ে গেল? মহুয়ার কথায়, ‘‘কিনতেই এসেছিলাম। করোনা আসার আগে বাবার জন্য এখান থেকে একটা মাফলার কিনেছিলাম। প্রতি শীতে বাবা ওই মাফলারটার পরে। কারণ ওটার মতো গরম নাকি এর আগে কোনও মাফলারে হয়নি। করোনার জন্য আগের দু’বছর সে ভাবে এঁরা আসেননি। তাই এ বছর শ্বশুরমশাইয়ের জন্য একটা মাফলার নিলাম। ওঁর আবার খুব ঠান্ডার ধাত। আর মেয়ের জন্য একটা পঞ্চু কিনলাম।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy