Advertisement
০২ নভেম্বর ২০২৪

বুঝেশুনে যোগব্যায়াম করুন, না হলে সমূহ বিপদ

ধরুন, আপনি ঘোরতর আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত৷ চেয়ার–টেবিলে খান, পড়াশোনা–আড্ডা বা কাজকর্ম চলে চেয়ারে বা সোফায় বসে৷ জন্ম থেকে কমোড ব্যবহার করেন৷ সিঁড়ি চড়া ধাতে নেই৷

সুজাতা মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৮ ১৭:৩২
Share: Save:

ভাল যোগ শিক্ষক আপনার শরীর বুঝে প্রেশক্রিপশন করে দিলে ও কিছু দিন ফলোআপ করার পর কেমন থাকছেন দেখে তাকে দৈনিক রুটিনে ফেলে দিলে, ঠিক আছে৷ কিন্তু তা না করে যদি ব্যথা–বেদনা সারাতে কি সুগার–প্রেশার–কোলেস্টেরল কমাতে, হার্ট–লাং ভাল রাখতে বা ফিটনেস বাড়াতে, স্ট্রেস ও ঘুমের সমস্যা কমাতে, যৌন জীবন ভাল করতে কি মনে শান্তি পেতে ৫০ জনের ক্লাসে ভর্তি হয়ে যান ও দলে পড়ে সব রকম ব্যায়াম শুরু করেন, বিপদ যে হবে না সে গ্যারান্টি নেই৷ কারণ যোগব্যায়াম কোনও ফ্যান্সি ফ্যাশন স্টেটমেন্ট বা ছাদে পায়চারি করার মতো নিরীহ ব্যাপার নয়, এক ধরনের চিকিৎসা৷ অন্য প্যাথি–র মতো প্যাথি৷ পুরনো যুগে, যখন আধুনিক–না-আধুনিক কোনও চিকিৎসা ছিল না, তখন মূলত যোগের সাহায্যেই মুনি–ঋষিরা শরীরে–মনে সুস্থ থাকতেন৷ মানসিকতাকে নিয়ে যেতে পারতেন উচ্চ মার্গে৷ সেই অর্থে একে ফিজিক্যাল মেডিসিন, এমনকী সাইকোসোমাটিক মেডিসিনও বলা যেতে পারে৷ সব ওষুধ যেমন সবার জন্য নয়, যোগও সে রকম৷ কাজেই ৮ থেকে ৮০, রোগী থেকে সুস্থ, সবাই এক জিনিস করতে গেলে বিপদ বাড়ার আশঙ্কা খুবই প্রবল৷

ধরুন, আপনি ঘোরতর আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত৷ চেয়ার–টেবিলে খান, পড়াশোনা–আড্ডা বা কাজকর্ম চলে চেয়ারে বা সোফায় বসে৷ জন্ম থেকে কমোড ব্যবহার করেন৷ সিঁড়ি চড়া ধাতে নেই৷ বয়সটাও গুটি গুটি পায়ে এগোচ্ছে৷ হঠাৎ প্রবল পরাক্রমে মাটিতে বসে–শুয়ে, নেচে–কুঁদে শুরু করলেন যোগ৷ পদ্মাসন, বজ্রাসন, সর্বাঙ্গাসন, মৎসেন্দ্রাসন, সূর্য নমস্কার থেকে অ্যাডভান্স প্রাণায়াম, বাদ রইল না কিছুই৷ শরীরের যেখানে যেখানে হাত–পা পৌঁছয় না, সেখানে তাদের পাঠানোর জন্য ব্যকুল হয়ে পড়লেন৷ শরীরে–মনে কোনও লুকনো ব্যাধি আছে কি না, বাতের সূত্রপাত হয়েছে কি না, হাড়গোড় নরম হতে শুরু করেছে কি না, সে সব খোঁজও নিলেন না৷ কারণ, আপনার ধারণা, যোগব্যায়ামে ক্ষতি হয় না৷

আরও পড়ুন: শুধু আর্ন নয় বার্নও করুন

আপনার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে হাঁটু, কোমর, ঘাড়, পিঠ, কব্জি তথা শরীরের যে কোনও সন্ধি বা পেশীতে যে মারাত্মক ব্যথা শুরু হয়ে যাবে না, সে গ্যারান্টি নেই৷ সে ব্যথার মূলে থাকতে পারে সাধারণ মাসল পুল, লুকনো আর্থ্রাইটিসের প্রকাশ্যে আসা, স্লিপ ডিস্কের বাড়াবাড়ি, লিগামেন্ট বা ট্যান্ডন ছিঁড়ে যাওয়া ইত্যাদি৷ হাড় পাতলা হলে তাতে চিড় ধরেও সমস্যা হতে পারে, যা সারাতে পরে প্রচুর কাঠ–খড় পোড়াতে হয়৷ বা ধরুন হজমের গোলমাল সারাতে উড্ডীয়ান করছেন, ও দিকে হাইপ্রেশার, হৃদরোগ বা হাঁপানিতে যে উড্ডীয়ান ঠিক নয় তা জানা নেই৷ পদহস্তাসন করার আগে জেনে নিলেন না যে গ্লকোমা বা খুব বেশি প্রেশার থাকলে তা করা যায় না৷ কোমর বা ঘাড় ব্যথার ধাত থাকলে যে সামনে ঝুঁকে ব্যায়াম করলে তা বেড়ে যেতে পারে, তা না জেনে ব্যথা বাড়িয়ে ফেললেন৷ মানসিক স্থিতি ঠিক না থাকলে যে দীর্ঘ সময় ধরে মেডিটেশন বা যোগনিদ্রা চলে না, তা না জেনে বাড়ালেন সমস্যা৷

‘এ রকম রোগী আমরা প্রচুর পাই’, জানালেন অর্থোপেডিক সার্জেন ইন্দ্রজিৎ সরদার৷ ‘‘ধরুন ফ্রোজেন শোল্ডার হয়েছে, অনেক সময় যোগে তা কমে ঠিকই, কিন্তু সব সময়েই কমবে এমন নয়৷ কারণ, এ হল পেরিআর্থ্রাইটিক শোল্ডার, অর্থাৎ কিছু ক্ষেত্রে এর মধ্যে এমন কিছু সমস্যা লুকিয়ে থাকতে পারে, যার উত্তর অপারেশন বা অন্য থেরাপি৷ তখন যোগব্যায়াম করলে কী হবে বুঝতেই পারছেন৷ হাঁটু–কোমর–পিঠ–কাঁধ, সব ক্ষেত্রেই এক কথা৷ কী কারণে ব্যথা হচ্ছে তা না জেনে যোগ করলে সমস্যা বেড়ে যেতে পারে৷ আবার ব্যথা নেই বলেই সব আসন করতে পারবেন, এমনও নয়৷ বয়স, অনভ্যাস, লুকনো হাড়–পেশীর সমস্যা, অন্য অসুখ, ওজন, ফিটনেস, নমনীয়তা— সব কিছু বিচার করে তার পর ঠিক করতে হবে কোনটা করতে পারবেন আর কোনটা নয়৷ তবে হ্যাঁ, ক্রনিক অসুখে ভুগলে অনেক সময় দেখা যায় রোগের উন্নতি হলেও রোগী ঠিক ভাল বোধ করেন না৷ রোগ তাঁর মনেও অসুস্থতার ছাপ ফেলে৷ এ সব ক্ষেত্রে চিকিৎসার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে প্রাণায়াম ও মেডিটেশন করলে রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠেন৷’’

বিভিন্ন স্টাডি থেকেও সে রকমই দেখা যায়৷ ২০০৮ সালে ফিনল্যান্ডের ১১০ জন অষ্টাঙ্গ যোগা প্র্যাকটিশনারের উপর সমীক্ষা করে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ যোগা থেরাপিতে যে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, তাতে দেখা যায় এঁদের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশের পেশী–সন্ধি ও হাড়ে এমন ধরনের চোট লেগেছে যা সারাতে সময় লেগেছে মাসখানেকেরও বেশি৷ আবার নিয়মিত যোগাভ্যাস করেন এমন ২৫০০ জন অস্ট্রেলিয়াবাসীর উপর ২০১২ সালে সমীক্ষা করে দেখা যায়, এই সংখ্যাটা নেমে এসেছে ২১ শতাংশে৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টাঙ্গ যোগব্যায়ামের অভ্যাস করা কিছুটা কষ্টসাধ্য বলে ঠিক ভাবে করতে না পারলে আঘাত লাগার আশঙ্কা বেশি থাকে৷

সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে, সব ধরনের স্পোর্টস ইনজুরি মিলেমিশে যে সংখ্যাটা দাঁড়ায়, যোগ আজ একাই সেই সংখ্যাটা ছুঁয়ে ফেলেছে৷ শুধুমাত্র ভুল ভাবে ও ভুল কারণে যোগ করার জন্য হাতে নানা রকম ব্যথা হচ্ছে প্রতি ১০ জন মানুষের মধ্যে এক জনের৷ অনেকে আবার এই ব্যথার উপরেই প্র্যাকটিস চালিয়ে সংখ্যাটাকে প্রায় ৫ গুণ বাড়িয়ে ফেলেন৷

কিছু কিছু যোগের ভঙ্গিমা আছে, বিশেষ করে হঠ যোগে, যা করলে কিছু ক্ষেত্রে পেটের সমস্যা হয়৷ পর পর যে সিকোয়েন্সে আসনগুলি করার কথা, তা না করলেই সমস্যা হয় সচরাচর৷ কিছু যোগের ভঙ্গিমা এতই জটিল যে আমআদমি সহজে তা রপ্ত করতে পারেন না৷ ট্রেনার দক্ষ না হলেও বিপদ হয়৷ কুণ্ডলিনী যোগে বিশেষ করে৷ এখানে ভুলভাল হলে তার প্রভাবে মনের নানা সমস্যা হতে পারে৷ যাকে বলে কুণ্ডলিনী সিনড্রোম৷ সে তালিকায় উদ্বেগ, দুঃখ, ডিপ্রেশন, ভ্রান্তি, অনিদ্রা ইত্যাদির আশঙ্কা প্রবল৷ মানসিক সমস্যা থাকলে তা বেড়ে যেতে পারে৷ বাড়াবাড়ি ক্ষেত্রে তা পৌঁছে যেতে পারে পাগলামির দোরগোড়ায়৷ আত্মহত্যপ্রবণ হয়ে পড়তে পারেন মানুষ৷

এ বার আসি বিক্রম যোগ বা হট যোগের প্রসঙ্গে৷ ওজন কমাতে ও নমনীয়তা বাড়াতে এই পদ্ধতি এত কার্যকর যে তার আকর্ষণে মজেছেন বহু সেলিব্রিটি, বিশেষত পাশ্চাত্যে৷ এতে ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় পর পর ২৬টি পোজ করতে হয়৷ প্রচুর ঘাম হয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হয় কাজ৷ শারীরিক সক্ষমতা তুঙ্গে না থাকলে হয় কিছু অকাজও৷ গা–বমি করতে পারে৷ গ্রাস করতে পারে প্রবল ক্লান্তি৷ গুরুতর চোট লাগতে পারে৷ এমনকী মাথা ঘুরে, রক্তচাপ কমে শক-এ চলে যেতে পারেন মানুষ৷

কথা বলছিলাম যোগ বিশেষজ্ঞ দিব্যসুন্দর দাশের সঙ্গে৷ তিনি বললেন, ‘‘আজকাল যে মঞ্চে, টিভিতে ঢালাও যোগের প্রদর্শন চলছে, তা হল জেনারেল যোগ৷ কমবয়সী, নীরোগ ছেলেমেয়েরা করলে উপকার পাবে৷ তবে অসুখবিসুখ সারাতে গেলে বা বয়সে ভাটির টান ধরলে এই যোগা চলবে না৷ তখন প্রশিক্ষিত যোগবিদের কাছে করতে হবে থেরাপিউটিক বা রেমিডিয়াল যোগ৷ রোগ হলে যেমন ডাক্তার দেখিয়ে প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসেন, এ হল তেমন ব্যাপার৷’’ তাঁর কথায়: ‘‘ট্রেনারের কাছে পদ্ধতি বুঝে বা কিছু দিন প্র্যাকটিস করে তবে নিজে করবেন৷ ফলোআপে আসতে হবে৷ ব্যায়ামের ফলে ভাল হচ্ছে না মন্দ, ডোজ বাড়াতে হবে না কমাতে, কিছু যোগ করতে হবে কি না সে সব বুঝে তবে ফাইনাল প্রেসক্রিপশন হবে৷ তার সঙ্গে যুক্ত হবে জীবনযাপনের নিয়ম৷ তবে আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন৷’’

আজকের দ্রুতগতির জীবনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিব্যসুন্দরবাবু চালু করেছেন এগজিকিউটিভ যোগ৷ ধরুন হাঁটু ব্যথা হচ্ছে, এ দিকে ব্যায়াম করার সময় নেই৷ অফিসে কাজের অবসরে মাঝে মাঝে টেবিলের নীচে বা গাড়িতে বসে পা সোজা মেলে দিয়ে থাইয়ের পেশী শক্ত করুন, ২০ সেকেন্ড পর ঢিলে করুন৷ সারা দিনে যত বার পারেন করবেন৷ বসে বসে কোমর ব্যথা? মাঝেমধ্যে উঠে দু’–একটা হালকা স্ট্রেচিং করুন৷ ভুঁড়ি বেড়ে যাচ্ছে? চলতে–ফিরতে বা বসে থাকার সময় পেটের পেশীকে টাইট করে ভিতরের দিকে টেনে রাখুন৷

‘আজকাল একটা বিপজ্জনক ট্রেন্ড দেখা দিয়েছে৷’ জানালেন তিনি। ‘‘ডিপ্রেশন বা অন্য কোনও জটিল মনোরোগে ভুগছে, এমন ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসছেন বাবা–মায়েরা৷ কারণ তাঁরা মনে করেন যোগ বা মেডিটেশন সর্বরোগহর৷ এ সব রোগীদের আমরা পত্রপাঠ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠিয়ে দিই৷ ওষুধে–কাউন্সেলিংয়ে সুস্থ হলে তবে তাকে নিয়ে আসতে বলি৷ তখন অল্প করে যোগ ও প্রাণায়াম করালে বেশ ভাল ফল পাওয়া যায়৷’’

অন্য বিষয়গুলি:

Yoga Sujata Mukhopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE