পুজোর বাজারের এই চেনা ছবি এ বছর গিয়েছে পাল্টে
পুজো আসতে আর মাত্র মাস দেড়েক বাকি, তা জানান দিতে শুরু করেছে প্রকৃতি। তবে পুজো বা পুজোর প্রস্তুতি যে অন্য বারের চেয়ে এ বছর অনেকটাই আলাদা হতে চলেছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। বৃহত্তর সামাজিক পরিসর বাদ রেখেও যদি শুধু নিজেদের গণ্ডিটুকু নিয়ে ভাবা যায়, তা হলেই বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে যাবে। আনলক পর্ব শুরু হলেও নেহাত প্রয়োজন ছাড়া আমরা কি এখনও বাইরে বেরোতে প্রস্তুত? দোকানপাট, শপিং মল ইত্যাদি ধীরে ধীরে খুলে গেলেও সেখানে গিয়ে কেনাকাটা করতে কতটা স্বচ্ছন্দ ক্রেতারা? দর্জির দোকানে মাপ দিতে যাওয়া বা শপিং মলের ট্রায়াল রুমে ঢোকা— সামাজিক দূরত্ব মেনে কেনাকাটা করা কি আদৌ সম্ভব?
নিউ মার্কেট, গড়িয়াহাট চত্বর ধীরে ধীরে ছন্দে ফেরার চেষ্টা করলেও স্বমহিমায় ফেরেনি এখনও। বড় দোকানের পাশাপাশি ফুটপাতের ছোট-মাঝারি স্টল— সকলেই ক্রেতার আশায়। আবার এ বছরে পুজো হয়তো কারও কাছে আর ততটা আনন্দের নয়। অতিমারির প্রভাবে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, স্বজন হারানো, কাজের অভাব, বেতনে কাটছাঁটের চাপে হয়তো পুজোর বাজার আলাদা করে অর্থবহ হয়ে ওঠে না অনেকের কাছে।
তবু বছরের ওই বিশেষ চারটি দিনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অনেকেই, আশা নিয়ে। একটু ভাল থাকার আশা। দুর্গাপুজো, দীপাবলির উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অগণিত মানুষের রুজি-রোজগারও। ভরসার কথা, অনলাইন ব্যবসার ক্ষেত্র এই পরিস্থিতিতে প্রসারিত হয়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। ছোট-বড় বহু বিপণি, এমনকি অসংগঠিত ক্ষেত্রের ব্যবসায়ীরাও কোনও না কোনও ভাবে ভার্চুয়াল মার্কেটে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। ক্রেতাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করছেন। পাল্লা দিয়ে বেড়ে গিয়েছে ডেলিভারি সার্ভিসের গুরুত্বও। আবার পুজোর মরসুমের পর পরই আসন্ন বিয়ের মরসুম। তার প্রস্তুতিও সাধারণত শুরু হয়ে যায় এই সময় থেকেই। সব মিলিয়ে বছরের যে সময়টা সাজো সাজো রবে মেতে ওঠার কথা, তা যেন থমকে রয়েছে। তা হলে উপায়?
কেনাকাটার নেশা
দুর্গাপুজোকে ঘিরে বাঙালির ভরপুর আবেগ জড়িয়ে। তাই সেই সময়ে অনেকেই ছক ভেঙে বেরোতে চাইবেন, মনে করছেন অধ্যাপক সুহৃতা সাহা। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বললেন, ‘‘এত দিন ঘরবন্দি থাকার পরে ওই ক’টা দিন মনে হবে একটু বেরোই। একটা পর্যায় পর্যন্ত নিয়ম মানার পরে মানুষের মধ্যে তা না মানার প্রবণতা আসতে পারে। যত পুজো এগিয়ে আসবে, সেই প্রবণতা বাড়তে পারে। যার সামর্থ্য আছে, সে হয়তো কেনাকাটাও করবে। মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে কেনার ইচ্ছেটা জিইয়ে রাখা সম্ভব। আর আমরা তো সব কিছু ঠিক প্রয়োজনে কিনি না, কেনার জন্যও কিনি। দোকানে গিয়ে কিনতে না পারলেও অনলাইনে কেনাকাটা চলবে।’’ প্রতিকূল পরিস্থিতি ও মন্দার বাজারেও কী ভাবে ক্রেতার কাছে পৌঁছনো যায়, তার উপায়ও বেরিয়ে যাচ্ছে ঠিক। অনলাইন বিজ়নেসের রমরমাই এর উদাহরণ। ফ্যাশন অ্যাকসেসরিতে মাস্কের অন্তর্ভুক্তিও তার প্রমাণ। এই ভাবে বিভিন্ন ব্যবসা রিস্ট্রাকচারড হলে, তা কেনাকাটার পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ফের সড়গড় করে তুলতে পারে ধীরে ধীরে।
লেক গার্ডেনসের এক নামী বুটিকের কর্ত্রী ইদানীং মাঝেমাঝেই লাইভে আসেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। লকডাউনে বুটিক বন্ধ থাকায় মাঝে ফুড ডেলিভারি বিজ়নেস শুরু করেছিলেন। এখন ধীরে ধীরে ফের চেনা ছন্দে ফিরছেন তিনি, তাঁর ব্যবসাও। তাঁর মতোই আরও বহু উদ্যোগপতি, যাঁরা নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন, সোশ্যাল মিডিয়াকে মাধ্যম করে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছেন ক্রেতাদের কাছে। অনেক সময়ে শপিং মলে গিয়ে কেনাকাটা করার অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে ট্রায়াল রুম কিংবা অল্টারেশন সেকশনগুলি। কারণ সেখানে ফিজ়িক্যাল কনট্যাক্টের বিষয়টি চলে আসে। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুহৃতা সাহা বললেন, ‘‘অনলাইনেও কিন্তু কারও রিটার্ন করা পোশাক রিপ্যাকেজিং হয়ে আপনার কাছে আসতে পারে। ট্রায়াল রুমের মতো তা হয়তো আপনার চোখের সামনে ঘটছে না বলে নিশ্চিন্ত থাকছেন। এই রিমোট নলেজ কিন্তু সব কিছুকে একপ্রকার সিদ্ধতা দেয়।’’ কাজেই, পোশাক, গয়না, জুতো, ব্যাগ, প্রসাধনী— যা-ই কিনুন, তা তিন-চার দিনের জন্য আলাদা কোথাও রাখুন, যেখানে কারও হাত পড়বে না। তার পর ব্যবহার করুন।
চেনা দুঃখ চেনা সুখ
শুধু পোশাক নয়, পুজো-দীপাবলি-ধনতেরাসের মরসুমে অনেকেই নতুন বাসন কিংবা গয়না কেনেন। কেউ ঘরের মেকওভার করেন নতুন পর্দা, বেডকভার কিনে। এই সময়ে জনস্রোতে ঢেকে যায় গড়িয়াহাট, নিউ মার্কেট, হাতিবাগান চত্বর। ছোট-বড়-মাঝারি কেনাকাটার পসরাকে কেন্দ্র করেই সেখানে ছড়ানো রেস্তরাঁ, পার্লার-সহ আরও কত কী! কোনওটাই চেনা মেজাজে নেই, পুজোর চল্লিশ দিন আগেও। গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের মুখে এক বিখ্যাত শাড়ির বিপণির কর্ণধার জানালেন, অগস্ট থেকে ধীরে ধীরে তাঁদের দোকানে ফুটফল সামান্য বাড়তে শুরু করেছে। লকডাউনে যে ব্যবসা শূন্যয় এসে ঠেকেছিল, তার মোটে তিরিশ শতাংশ রিকভার করা গিয়েছে এখনও পর্যন্ত। মহালয়ার পর থেকে আরও ক্রেতা আসবেন, আশায় রয়েছেন তাঁরা। ওয়েবসাইট ডেভেলপ করায় মন দিয়েছে সেই ব্র্যান্ড, যাতে ক্রেতারা সরাসরি অর্ডার করতে পারেন। কর্মীদের ৫০ শতাংশ কম বেতন দিতে বাধ্য হচ্ছে ওই চত্বরেরই আর একটি ঐতিহ্যবাহী বিপণি। এত দিন প্রোডাকশন বন্ধ থাকায় আগে স্টক ক্লিয়ার করতে চাইছেন তাঁরা। ‘‘একমাত্র পুরনো কাস্টমাররাই এর মধ্যেও মাস্ক পরে আসছেন দোকানে। চলতি সপ্তাহ থেকেই নতুন প্রোডাকশন শুরু হচ্ছে আমাদের। শহরের বাইরে ডেলিভারিও শুরু করেছি,’’ জানালেন তার কর্ণধার। ছোট-বড় সব স্টোরই এখন স্যানিটাইজ়েশন ও থার্মাল চেকিংয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছে। ওয়েস্টার্ন কালেকশনের জন্য বিখ্যাত নিউ মার্কেটের এক দোকানের মালিক বললেন, ‘‘আমাদের বেশির ভাগ প্রডাক্টই আউটসোর্স করে আনা হয়। এত দিন সেটা বন্ধ থাকায় খুবই ক্ষতি হয়েছে। এখনও নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই দোকান খোলা রাখতে পারছি।’’
দ্য শো মাস্ট গো অন
কেনাকাটা— তা দরকারে হোক বা শখে, শুরু না হলে যে ব্যবসাবাণিজ্যের উন্নতি হবে না, তা উঠে এল অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের কথাতেও। তবে মার্কেটে ফের ডিমান্ড তৈরি হওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আশাবাদী হতে পারছেন না তিনি, ‘‘এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটাই প্রাধান্য পাওয়া উচিত। যেখানে আমরা প্রত্যক্ষ পরিষেবা নিয়ে থাকি, যেমন রেস্তরাঁ, শপিং মল, হোটেল, সালঁ ইত্যাদি— সেই সব ক্ষেত্রে হয়তো রাতারাতি চাহিদা আগের জায়গায় পৌঁছে যাবে না। বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে যাঁরা ব্যবসা বা পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত, তাঁদের অবস্থাটা চট করে পাল্টাবে না। আর বেশির ভাগ কনজ়িউমারই আগে নিজেদের সুরক্ষার কথা ভাববেন। বরং এই সময়ে অনলাইন সার্ভিস লাভজনক জায়গায় পৌঁছে যাবে।’’ অতিমারি-পরবর্তী সময়ে কত তাড়াতাড়ি আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব, সেটাই আসল চ্যালেঞ্জ— এ কথাও মনে করিয়ে দিলেন তিনি।
পুজোর কাউন্টডাউন শুরু হল বলে। তাই পুজো এ বার যে রূপেই ধরা দিক, তার প্রস্তুতিপর্বে শামিল হওয়ার প্রথম শর্ত, সুরক্ষাবিধি মেনে চলা। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেই জীবন যখন বহমান, উৎসবের আনন্দ তার মধ্যেই লুটে নিতে হবে বই কী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy