Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Deepika Padukone

কতটা পথ পেরোলে তবে...

মনের তল পাওয়া যায়! অবসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভরসার হাত বাড়ালেন দীপিকা পাড়ুকোন। তামিলনাড়ুর এক গ্রামে তাঁর অভিযানের সঙ্গী পত্রিকা

পারমিতা সাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২২ ০৯:০১
Share: Save:

অক্টোবরের এক মধ্যাহ্ন। চেন্নাইয়ের রোদ রীতিমতো কাঠফাটা। শহর থেকে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের থিরুভালুরের এক গ্রামে সে দিন সারা দেশের মাত্র গোটা কয়েক মিডিয়া আমন্ত্রিত। ধু ধু প্রান্তর, চাষের জমি, ছোট ছোট বাড়ি পেরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছনো গেল। খানিকটা হলঘর সদৃশ সে ঘরটির মাথায় টিনের ছাউনি। চার দিক সবুজে ঘেরা এবং ঘরের মধ্যে কয়েকটি স্ট্যান্ড ফ্যান থাকায় ভিতরে গরম সে ভাবে অনুভূত হচ্ছে না। সে দিন ওই ঘরে হতে চলেছে একটি সাংবাদিক সম্মেলন। মধ্যমণি অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন।

কী কারণে তামিলনাড়ুর এই গ্রামে গ্ল্যামারস্নাত নায়িকার উপস্থিতি? প্রায় সাত বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে দীপিকা প্রথমবার জানিয়েছিলেন তাঁর মানসিক অবসাদের কথা। মেকআপের আবরণ, ক্যামেরার ঝলকানি, ফিল্মি দুনিয়ার ঔজ্জ্বল্যের মধ্যেও ডিপ্রেশন, স্ট্রেস, অ্যাংজ়াইটির চক্রব্যূহ তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। সে দিন তিনি শুধু এ বিষয়ে মুখ খোলার সাহস দেখিয়েই থেমে যাননি, ২০১৫ সালে তৈরি করেছিলেন ‘লিভ লাভ লাফ’ (এলএলএল) নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট, যার মাধ্যমে অবসাদের শিকার হওয়া মানুষের পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন তিনি। শুরুটা করেছিলেন তাঁর শহর বেঙ্গালুরু থেকেই। কিন্তু ক্রমশ হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামের দিকেও। সেই গ্রামীণ কর্মসূচি নিয়েই দীপিকার থিরুভালুরে আসা। তাঁর এ সফরে সঙ্গী ছিলেন বোন অনিশা পাড়ুকোন, মা উজ্জ্বলা পাড়ুকোন, যদিও তিনি এলএলএল টিমের অংশ নন এবং ট্রাস্টির অন্য সদস্যরাও।

প্রথাগত সাংবাদিক সম্মেলন এটি নয়। তাই হয়তো সেই নির্দিষ্ট ছাউনিঘেরা ঘরটিতে মিডিয়া পৌঁছনোর আগেই পৌঁছে গিয়েছেন সেলেব্রিটি। ঠিক তার আগের দিনই তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে বিদেশ থেকে ফিরেছেন। সে দিন সকালে মুম্বই থেকে থিরুভালুরে এসেছেন দীপিকা ও তাঁর মা, অনিশা এসেছেন বেঙ্গালুরু থেকে। পিচ রঙা লিনেনের সালোয়ার, চুল টেনে বাঁধা, পুরু ভুরু দু’টি ছাড়া সে ভাবে তাঁর মুখে মেকআপ ধরা পড়ে না। মেন্টাল হেলথ নিয়ে গ্রামীণ কর্মসূচি বড় সহজ কথা নয়। সেই ভাবনা প্রসঙ্গে গোড়াতেই দীপিকা বললেন, “আমাদের লিভিং রুমে বসে অনিশা, আমি, অ্যানা (চান্ডি, সংস্থার সদস্য) কথা বলতে বলতেই ‘লিভ লাভ লাফ’ গড়ে তোলার ভাবনা আসে। মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করার পক্ষে সাত বছর সময়টা খুবই কম। আমরাই প্রথম, যারা এই বিষয়টা নিয়ে খোলাখুলি কথা বলেছিলাম। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, যাঁরা তারও আগে থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে চলেছেন, তাঁদের কৃতিত্বকে ছোট করছি। সাত বছর আগে কখনওই ভাবিনি আমাদের কর্মসূচিকে গ্রামেও ছড়িয়ে দিতে পারব। এই প্রতিষ্ঠান আসলে আমার আবেগ। প্রথম থেকেই ঠিক করেছিলাম, আমাদের কাজের দ্বারা উপকৃত মানুষের সংখ্যা নয়, আমাদের কাছে বিবেচ্য তার মান।’’

এখনও এ দেশের বহু ‘শহুরে শিক্ষিত’ মানুষও রোগটিকে স্বীকার করতে দ্বিধা বোধ করেন। সেখানে গ্রামে কী ভাবে শুরু হল এই কর্মযজ্ঞ? ‘‘এটা শুধু শহুরে সমস্যা নয় বা কোনও সম্প্রদায়, অর্থনৈতিক শ্রেণি বা বয়সের মধ্যেও সীমাবদ্ধ নয়। আমরা স্থানীয় কিছু মানুষ এবং এনজিও-র সঙ্গে যোগাযোগ করি, যারা ওই অঞ্চলের সঙ্গে পরিচিত এবং আমাদের কর্মসূচি সেখানে ছড়িয়ে দিতে পারবে। তবে কাজ করতে গিয়ে এটাও দেখেছি, শহুরে মানুষেরাও কিছু বদ্ধ ধারণা থেকে বেরোতে চায় না। কিছু ক্ষেত্রে তো গ্রামের চেয়ে বেশি ভুল ধারণা শহুরে মানুষদের মধ্যে,’’ স্পষ্ট উত্তর সংস্থার সিইও অনিশার। এ সংস্থা যতটা দীপিকার, ততটাই অনিশারও। দীপিকার মতো তারকাসুলভ গ্ল্যামারের দ্যুতি নয়, তিনি উজ্জ্বল স্বাতন্ত্র্যে, আত্মবিশ্বাসে। অবসাদ, অ্যাংজ়াইটির মতো মনের চোরাগলিকে ‘শহুরে এবং উচ্চবর্গীয়’ পঙ্‌ক্তিতে বসিয়ে ভুল পথে চালিত করার প্রবণতাও কম নেই। এ ধরনের মানসিকতার সম্মুখীন যে এলএলএল-কে বারবারই হতে হয়েছে, তা উঠে এল অনিশার কথা থেকেই, “সারা পৃথিবীতে এটা প্রমাণিত যে, মেন্টাল ইলনেস আঘাত করতে পারে যে কোনও বয়সি, যে কোনও অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর মানুষকে। অন্যান্য অসুস্থতার মতো এটাও একটা রোগ। আমরা সেটা গোড়া থেকে বুঝলেও, দুঃখের বিষয় এখনও বহু মানুষ সেটা বোঝেন না। আমাদের কর্মসূচির উদ্দেশ্য এই সত্যিটা বোঝানো।”

এলএলএল যে শাখাগুলির মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা হল— মেন্টাল এডুকেশন ফর অ্যাডোলেসেন্স, রুরাল প্রোগ্রাম, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং প্রোগ্রাম (জেনারেল প্র্যাকটিশনারদের প্রশিক্ষিত করা যাতে তাঁরা মেন্টাল ডিসঅর্ডারের লক্ষণ বুঝতে পারেন) এবং ফ্রি টেলি কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম। সে দিন দীপিকা এবং সংস্থার সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন স্থানীয় আশাকর্মী এবং এনজিও-র সদস্যরা, যাঁদের সহযোগিতায় এলএলএল-এর ভাবনা বাস্তব রূপ পেয়েছে। সেই সঙ্গে এসেছিলেন এমন কিছু মানুষও, যাঁরা সংস্থার সাহায্যের ফলে উপকৃত। পর্দার নায়িকাকে এত কাছে দেখতে পেয়ে উচ্ছ্বাস ছিলই, তবে তা ছবি তোলাতেই সীমাবদ্ধ। স্থানীয় ভাষা সকলের ভাল ভাবে বোঝার সুবিধের জন্য ব্যবস্থা ছিল দোভাষীরও, যদিও দীপিকা এলাকার অধিবাসীদের সঙ্গে অনেক সময়ই কথা বলেছেন স্থানীয় ভাষায়। আত্মিক যোগসূত্র কি ভাষা ছাড়া তৈরি হয়? কথায় কথায় উঠে এল দু’টি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গও। সারা পৃথিবী জুড়ে সমীক্ষায় প্রমাণিত যে, মনের এই ব্যাধি নিরাময়ে গোষ্ঠী সাহায্য কতটা জরুরি। এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ দরকার কেয়ারগিভারদেরও, অর্থাৎ যাঁরা রোগীকে দেখভাল করছেন। কেয়ারগিভারদের যদি আর্থিক সংস্থান না থাকে এবং মনের দিক থেকে শক্তিশালী না হন, তা হলে তাঁদের পক্ষে অন্যের পাশে দাঁড়ানো মুশকিল।

দীপিকার জীবনে কেয়ারগিভারদের ভূমিকা কতটা? “এ সব ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আমার জার্নিতে তো বটেই। তার জন্য মা আমার সঙ্গে রয়েছে, আমার বোন এই কাজের সঙ্গে বহু বছর ধরে যুক্ত। তাই যখন আমি কেয়ারগিভারদের কথা শুনি, তখন বুঝতে পারি, যাঁর সাহায্য প্রয়োজন, তার সঙ্গে যিনি সাহায্য করছেন, তাঁরও মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখা ততটাই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁরাই তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমস্যাকে চিহ্নিত করেন। শুধু মেন্টাল ইলনেস নয়, যে কোনও রোগেই যিনি শুশ্রূষা করছেন, তাঁর ভূমিকাও স্বীকৃতি দাবি করে। সেই কারণেই বিশেষত এই থিরুভালুরে কেয়ারগিভারদের নিয়ে একটা মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে তাঁরা একত্রিত হয়ে নিজেদের ভাবনা শেয়ার করেন। এর ফলে রোগীদের পাশাপাশি, যাঁরা তাঁদের যত্ন নিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের সমাজের অংশ বলেই মনে করেন। কমিউনিটি ফিলিংস এক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ,’’ স্পষ্টবাদী নায়িকার কথার মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে তাঁর ভাবনার গভীরতা।

প্রাথমিক ভাবে কর্নাটক ও ওড়িশায় শহরকেন্দ্রিক কাজ শুরু করলেও আপাতত সংস্থার লক্ষ্য বিভিন্ন গ্রামের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ফান্ডিং। বেশ কিছু সংস্থা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেও তা যে যথেষ্ট নয়, ফুটে উঠল দীপিকার কথা থেকেই, “থিরুভালুরের মতো একটা ছোট অঞ্চলেই প্রায় ৫০০ জন রোগী। তার মানে বুঝতে পারছেন, আমাদের প্রচেষ্টা আসলে সিন্ধুতে বিন্দু! এই ছোট্ট টিম নিয়ে কতটা কী করতে পারব জানি না, এর জন্য সরকারি সাহায্য প্রয়োজন,” উত্তর দিয়ে জল খেলেন দীপিকা। কোম্পানির ব্র্যান্ডনেম অবশ্য আগেই বোতল থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে কী ভাবে দেখেন লিভ লাভ লাফের ভবিষ্যৎ? হাসি ঝিলিক দিয়ে যায় তাঁর উজ্জ্বল চোখে, “যত বেশি সংখ্যক লোকের জীবনে প্রভাব বিস্তার করা যায়, সেই চেষ্টা করে যাব। মানুষ যে ভাবে ফিজ়িক্যাল ফিটনেসের গুরুত্ব বুঝেছে, সে ভাবে যেন মানসিক স্বাস্থ্যের কথাও ভাবে। মানসিক সমস্যা হলে রোগী যেন মাথা উঁচু করে ডাক্তারের কাছে যেতে পারে। সাইকায়াট্রিক ট্রিটমেন্ট হোক বা কাউন্সেলিং সেশন, রোগীকে যেন লজ্জা পেতে না হয়।”

এই বৃহৎ দেশে যেখানে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা এখনও কম, সেখানে দীপিকার এই উদ্যোগকে কুর্নিশ করতেই হয়। বিশেষত তাঁর মতো তারকা যখন অবসাদের মতো একটি জটিল ব্যাধির বিষয়ে মুখ খোলেন, তখন তা অনেক সহজে জনমনে প্রভাব বিস্তার করতে পারে বই কি। পশ্চিমবঙ্গে কি এলএলএল-এর এ ধরনের উদ্যোগের কোনও পরিকল্পনা রয়েছে? দীপিকা এবং অনিশা একযোগে বললেন, “হ্যাঁ অবশ্যই আছে।” সেই সঙ্গে দীপিকা যোগ করলেন, “আমাদের এখনও চিকেন অ্যান্ড এগ সিচুয়েশন। ফান্ডিংয়ের ব্যাপার তো রয়েছেই, সেই সঙ্গে সঠিক পার্টনার পাওয়াটাও এ বিষয়ে এগোনোর ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে আমাদের স্কুল প্রোগ্রামগুলো চালু রয়েছে কোভিডের সময় থেকেই।” রোদ কিছুটা পড়তে দীপিকা, অনিশা সহ টিমের বাকিরাও গেলেন গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে, যেখানে কেউ না কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। যে উদ্দেশ্য নিয়ে দীপিকা লিভ লাভ লাফ শুরু করেছিলেন, মানসিক রোগের কারণে কোনও জীবন যেন অকালে ঝরে না যায়, তাঁর সেই যুদ্ধে ক্রমশ যোগ হচ্ছে আরও সৈন্য এবং তারা এগোচ্ছে শত্রুপক্ষকে জয় করতে।

অন্য বিষয়গুলি:

Deepika Padukone Mental Depression
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy